বণ্টন নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই অস্তিত্বহীন ও নামসর্বস্ব সংস্থাকে আর্থিক অনুদান দিয়েছে রংপুর শহর সমাজসেবা অধিদফতর। ২০২৩-২৪ অর্থ বছরের উন্নয়ন প্রকল্পের টাকা এভাবেই হরিলুট করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যেখানে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা করে প্রায় ৬ লাখ টাকা চেকের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে।
Advertisement
বাংলাদেশ জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের নীতিমালা অনুযায়ী সাধারণ নিবন্ধীকৃত স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে অনুদান বণ্টন নীতিমালা রয়েছে। সেই নীতিমালায় সংস্থা বা সংগঠনের নিজস্ব বা ভাড়া করা অফিসঘর থাকতে হবে, অনুদান গ্রহণের সমপরিমাণ অর্থ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল থেকে ব্যয় করতে হবে, অডিট রিপোর্ট ও পূর্ণাঙ্গ কার্যকরী পরিষদ থাকতে হবে।
তবে এসব নিয়ম অনুসরণ না করেই অনুদান দিয়েছে সমাজসেবা অধিদফতর। এমন নামসর্বস্ব সংগঠনের একটি তালিকা হাতে পেয়েছে জাগো নিউজ।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যে সংস্থাগুলোকে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, নীতিমালা অনুযায়ী অনুদান গ্রহণের কোনো যোগ্যতা তাদের নেই। তাছাড়া নাগরিকদের সহযোগিতার ক্ষেত্রে প্রাপ্ত অনুদানের অর্থ প্রতিশ্রুত জনকল্যাণমূলক কাজে সঠিকভাবে ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি।
Advertisement
সংস্থাগুলোর অনুমোদন, কাগজপত্র যাচাই ও চেক বিতরণ করেন শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা আরিফুর রহমান এবং পুরো প্রক্রিয়ার অনুমোদন দেন উপপরিচালক মো. আব্দুল বাতেন। তারা দুজনই এ অনিয়মগুলোর সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে।
অনুদান পাওয়া ২৮টি সংগঠনের মধ্যে রয়েছে শ্যামা সুন্দরী সামাজিক সংস্থা। ঠিকানা- কলেজ রোড, আলমনগর, রংপুর। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ওই সংস্থার সাইনবোর্ড, অফিস বা কোনো অস্তিত্ব নেই।
মনি বেগম নামে স্থানীয় এক নারী বলেন, এই নামে এখানে কোনো সংগঠন নেই।
আমিনুল ইসলাম নামে আরেক স্থানীয় বলেন, আপনার কাছে এই সংগঠনের নাম প্রথম শুনলাম। যদিও থাকে এই সংগঠনের কোনো কার্যক্রম আমাদের চোখে ধরা পড়েনি কখনোই।
Advertisement
সংগঠনের সভাপতি পারভিন আক্তার মুঠোফোনে জানান, সমাজসেবার অনুদানের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সবকিছু আমার সাধারণ সম্পাদক দেখাশোনা করেন, তার সঙ্গে কথা বলেন।
এদিকে ওই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক বলেন, টাকার বিষয়টি হয়ত সভাপতি ভুলে গেছেন। সমাজসেবা থেকে আমরা টাকা পেয়েছি। আসলে আমাদের সংগঠনের কার্যক্রম সেভাবে চলছে না। আমরা চেষ্টা করছি কার্যক্রম চালানোর। অনুদানের টাকা দিয়ে দুস্থদের সাহায্য করা হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
তালিকায় থাকা আরেকটি সংগঠন রংপুর জেলা সৈনিক কল্যাণ সংস্থা একটি রেস্তোরাঁর ভেতরে। প্রতিষ্ঠানের দরজার সামনে শুধু সাইনবোর্ড নজরে পড়ে। এছাড়া আর কোনো সাইনবোর্ড চোখে পড়েনি।
ওই রেস্তোরাঁর মালিক মাসুদ রানা বলেন, মাসে মাত্র একদিন বসেন এখানে সবাই। এছাড়া কাউকে কখনোই চোখে পড়ে না। তারা কী সংগঠন করেন সেটাও জানা নেই আমার।
সংগঠনের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর নাসিম বলেন, সমাজসেবা থেকে অনুদান পেয়েছি, কিন্তু কত টাকা জানা নেই। মাসে একদিন বসি সংগঠনে।
অপর সংগঠন সমাধান সংস্থার ঠিকানায় গিয়ে কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। স্থানীয় শাহজাহান মিয়া বলেন, সমাধান নামে একটি সংগঠন আছে। যেখানে কোনো কমিটি নেই। মাহাবুবুর রহমান নামে একজন সবকিছুই দেখাশোনা করেন। উনি সভাপতি, উনিই সেক্রেটারি, উনিই সবকিছু।
মুঠোফোনে সংগঠনের সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, টাকা-পয়সার বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে চাই না। সমাজসেবা অধিদফতরে গিয়ে আপনারা জেনে নেন টাকা পেয়েছি কি না।
আপনার সংগঠনের ঠিকানা কোথায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার সংগঠনের ঠিকানা দিয়ে আপনি কী করবেন। আমার সংগঠনের কোনো ঠিকানা নেই।
বরাদ্দ পাওয়া গোল্ডেন ফিউচার সোসাইটির সভাপতি তৌহিদুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, টাকা পেয়েছি তবে কত টাকা জানা নেই। অফিসে বসি প্রতি সপ্তাহে।
আপনার অফিস কোথায় এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অফিস আছে, আমি একটু রংপুরের বাইরে আছি। আপনার সঙ্গে পরে কথা হবে।
এছাড়া প্রবাহ সামাজিক সংস্থা নামে কোনো সংগঠন পাওয়া যায়নি। তবে প্রবাহ কো-অপারেটিভ নামে একটি সংস্থা পাওয়া গেছে, যারা লোন দেন। ওই সাইনবোর্ড ব্যবহার করেই মূলত প্রবাহ সামাজিক সংস্থার নামে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থার ম্যানেজার মতিলাল মুকুল।
মুকুল বলেন, আমাদের অডিট রিপোর্ট রয়েছে। যা সমাজসেবা থেকে করা হয়েছে। কিন্তু গত বছরের রিপোর্ট দেখাতে পারেননি তিনি।
তিনি বলেন, ২০২৩-২৪ এর অডিট রিপোর্ট শহর সমাজসেবা অফিসার আরিফুর রহমানের কাছে আছে। তিনি এখন পর্যন্ত রিপোর্ট আমাদের হাতে দেননি।
ওই সংস্থার সভাপতি আজারুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, সবকিছু ঠিক আছে। আমরা বিভিন্ন সময় মানুষদের সাহায্য করে থাকি। অনুদানের টাকা পেয়েছি। তবে কত টাকা আমার জানা নেই।
বেগম রোকেয়া ফোরামের মুঠোফোন নম্বর ভুল দেখানো হয়েছে। তালিকায় উল্লেখ করা ঠিকানায় গিয়ে কোনো সংগঠন পাওয়া যায়নি। স্থানীয় হামিদুর রহমান বলেন, এমন কোনো সংগঠন আছে কি না জানা নেই।
কম্পিউটার আলোর পথে নামে যে সংগঠন রয়েছে সেই সংগঠনের উপদেষ্টা দেলোয়ার হোসেন জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা আবদুল মতিনকে নিজের মামা বলে পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়াও সংগঠনের সভাপতি মনোয়ার হোসেনের দাবি, অনুদানের টাকা দিয়ে টিভি কিনেছেন তারা।
হেলথ এডুকেশন অ্যান্ড এগ্রিকালচার সোসাইটি নামের সংগঠনটি আগে নগরীর জিএল রায় রোডে থাকলেও বর্তমানে সাগর পাড়ায় স্থানান্তরিত হয়েছে। কিন্তু জিএল রায় রোডের ব্যবসায়ীদের দাবি এমন সংগঠনের নাম এর আগে তারা শোনেননি।
সংগঠনের সভাপতি মাসুদার রহমান নিজেকে একটি স্থানীয় পত্রিকার ম্যানেজিং সম্পাদক হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলেন, আমাদের সব কিছু ঠিক আছে। কিন্তু সংগঠনের কাজ এখন কিছুটা কম।
প্রতিবন্ধী ফাউন্ডেশনের দেওয়া মুঠোফোনে কল দিলে এক নারী রিসিভ করে জানান, ওই নামে কোনো সংগঠনের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা নেই। এছাড়া উল্লেখিত ঠিকানায় গিয়েও কোনো সংগঠনের হদিস মেলেনি।
মাই ভিশন নামে কোনো সংগঠনের হদিস মেলেনি। আর উল্লেখিত ফোন নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যায়। ইউনাইটেড ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে এক নারী কল রিসিভ করে আরেক ব্যক্তিকে ধরিয়ে দেন। অফিসের ঠিকানা জানতে চাইলে কল কেটে দিয়ে নম্বর বন্ধ করে দেন তিনি। প্রভাতী সমাজকল্যাণ সংঘের উল্লেখিত ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে ফোনের অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তি ওই সংগঠন চেনেন না বলে জানান।
রাজেন্দ্রপুর সমাজ কল্যাণ সংস্থার সভাপতি ফেরদৌসি বলেন, আমরা সমাজ সেবা থেকে ২২ হাজার টাকা পেয়েছি। অথচ সমাজ সেবার তথ্য বলছে, ওই অর্থ বছরে ওই সংগঠনের জন্য বরাদ্দ ছিল ২০ হাজার টাকা।
এদিকে ডাক্তার ওয়াসিম ওয়ালেদা বহুমুখী কল্যাণ ফাউন্ডেশন এবং মিতালী সংঘে একই মোবাইল নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাধারণ সম্পাদকসহ অন্যান্য পদের ব্যক্তিরা জানিয়েছেন, দীর্ঘ কয়েক বছর আগে নিবন্ধন নিয়েছেন তারা। সেই থেকে শহর সমাজসেবায় কিছু কমিশন দিয়ে অনুদান নেওয়া হচ্ছে। শহর সমাজসেবা অফিস তাদের জনবল দিয়ে কাগজপত্র ঠিক করে প্রতি বছর অনুদানের চেক প্রদান করে। এর বিপরীতে কাগজপত্র ঠিক করা বাবদ ১ থেকে ২ হাজার টাকা দিতে হয় এবং চেক নেওয়র সময় ৫ থেকে ১০ হাজার উৎকোচ দিতে হয়। এই টাকা না দিলে তারা অন্য সংস্থার নাম ঢুকিয়ে দেয়। বাধ্য হয়ে উৎকোচের টাকা দেন তারা।
এ বিষয়ে শহর সমাজসেবা কর্মকর্তা আরিফুর রহমান বলেন, আমি চেক বিতরণের দায়িত্বে ছিলাম। তথ্য পেয়েছি, আমরা যাচাই-বাছাই করবো।
অস্তিত্বহীন সংগঠনের বিষয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, অস্তিত্ব না থাকলে আইনগত নীতিমালা অনুযায়ী কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপপরিচালক আব্দুল মতিন বলেন, এমনটা হওয়ার কথা নয়। যদি হয়ে থাকে তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে অবশ্যই তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেউ আত্মীয় পরিচয় দিলে সে দায়ভার আমার নয়।
এফএ/এএসএম