জাতীয়

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে মাস্টারপ্ল্যান তৈরির কাজ চলছে

৫ আগস্টের দুদিন আগেই দেশ ছাড়েন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এতে করপোরেশনের সব কার্যক্রমে নামে স্থবিরতা। সম্প্রতি মেয়রের সব ধরনের প্রশাসনিক কাজ সচল রাখতে প্রশাসক হিসেবে যোগ দিয়েছেন মো. শাহজাহান মিয়া। তিনি নাগরিক সেবা কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে কাজ করছেন।

Advertisement

সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড, আসন্ন বর্ষায় করণীয়, ডেঙ্গু দমনে পদক্ষেপ প্রভৃতি বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুসা আহমেদ।

জাগো নিউজ: জলাবদ্ধতা ঢাকা সিটির অন্যতম প্রধান সমস্যা। আগের মেয়ররা বারবার প্রতিশ্রুতি দিলেও কোনো সুফল জনগণ দেখতে পায়নি। মেয়রের অনুপস্থিতিতে প্রশাসক হিসেবে আসন্ন বর্ষায় জলাবদ্ধতা নিরসনে আপনার প্রস্তুতি কী?

শাহজাহান মিয়া: জলাবদ্ধতা ঢাকার একটি বড় সমস্যা। এ বিষয়ে আমাদের প্রকৌশল বিভাগ এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে বসেছিলাম। জলাবদ্ধতা বেশি এমন কিছু এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। যেগুলো আমরা অল্প সময়ের মধ্যে সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যাতে বর্ষায় জলাবদ্ধতা তৈরি না হয়। আমরা এখন যা করছি সেটি অস্থায়ী সমাধান। আমরা চাচ্ছি স্থায়ী সমাধান। এ কারণে তিনভাবে স্বল্প-মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে- ১৫টি খাল ও কালভার্ট পরিষ্কার করা। এগুলো ময়লা-আবর্জনা ফেলে ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এমনটা হলে বর্ষার বৃষ্টির পানি কোথায় যাবে। ফলে বৃষ্টি হলে খালে পানি প্রবাহ থাকে না। পানি উপচে রাস্তায় জমে। তৈরি হয় জলাবদ্ধতা।

Advertisement

আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি আশা করছি তাতে আগামী বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা আগের মতো হবে না। হলেও আমরা প্রয়োজনে পাম্প বসিয়ে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করবো

 

এবার আমরা উদ্যোগ নিয়েছি বর্ষা আসার আগেই এই ১৫টি খাল পরিষ্কার করে ফেলবো। এরই মধ্যে এ কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। ঠিকাদাররা কাজও শুরু করে দিয়েছেন। আজ (৪ মার্চ) আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা, আঞ্চলিক নির্বাহী প্রকৌশলী, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে কয়েকটি সভা করেছি। এর সমন্বয় করছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ। আমি সময় বেঁধে দিয়েছি আগামী এপ্রিল থেকে মে তথা বর্ষা আসার আগে সবগুলো খাল পরিষ্কার করতে হবে। কালভার্টগুলোর কাজও দ্রুত করতে হবে।

আর মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি কাজের মধ্যে রয়েছে- ঢাকা শহরে আসলে কোনো ‘মাস্টার ড্রেন’ নেই। যে ড্রেনেজ নেটওয়ার্ক আছে তারও কোনো ম্যাপ নেই। কোন ড্রেনটা কোনদিকে গেলো, কোনটার সঙ্গে মিলিত হলো জানা যায় না। আমি সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে দায়িত্ব দিয়েছি এসব আপডেট করতে। প্রয়োজনে ওয়াসার কাছে কোনো তথ্য থাকলে সেগুলোর সহায়তা নিতে। আর সেটার ভিত্তিতে আমরা কাজ করবো।

আরও পড়ুন

Advertisement

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খননের বিকল্প নেই টানা বৃষ্টিতে রাজধানীতে জলাবদ্ধতা, পথে পথে নানা দুর্ভোগ মশার উপদ্রবে নাজেহাল নগরবাসী পরিত্যক্ত পণ্য কিনে ডিএনসিসির ডেঙ্গু প্রতিরোধ কার্যক্রম বন্ধ

এখন ঢাকা দক্ষিণে বৃষ্টির পানি অপসারণে মাত্র তিনটি আউটলেট বা পানি বের হওয়ার পথ আছে। যে আউটলেট দিয়ে শহরের পানি বুড়িগঙ্গা নদীতে যায়। এখন ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার সমাধান যদি আমরা চাই তাহলে কমপক্ষে ৯ থেকে ১০টি আউটলেট তৈরি করতে হবে। সেটার জন্য আমাদের আলাদা মাস্টারপ্ল্যান লাগবে। এসব বিষয়েও সভা শুরু হয়েছে।

সেখানে একটি কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটি ওয়াসা আগে কীভাবে পানি ব্যবস্থাপনার কাজ করেছে, আমরা কী কাজ করেছি এসব পর্যালোচনা করে ১৫ দিনের মধ্যে একটি প্রতিবেদন জমা দেবে যে কীভাবে স্থায়ীভাবে মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে এর সমাধান করতে পারে। এছাড়া এখানে অর্থের বিষয়ে ভাবতে হবে। কোন কাজ আমরা করতে পারবো, কোনটা সরকারের সহায়তা নেওয়া হবে আর বড় হলে বিশ্বব্যাংক বা বিদেশি সংস্থার দারস্থ হতে হবে। আমি এ কাজটা প্রাথমিকভাবে উদ্যোগ নিয়েছি।

জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে আমরা কমবেশি সবাই জানি। একটা সময় জুন-জুলাইতে বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি হতো। এখন সেটি অক্টোবর নভেম্বরে চলে গেছে। ছোটবেলায় দেখতাম টানা সাত-আটদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হতো। বৃষ্টির পানি ধীরে ধীরে চলে যেত। এখন হঠাৎ ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে, যা জলাবদ্ধতার কারণ। আমাদের অবকাঠামো ঝিরিঝিরি বৃষ্টির জন্য করা হয়েছিল।

আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি আশা করছি তাতে আগামী বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা আগের মতো হবে না। হলেও আমরা প্রয়োজনে পাম্প বসিয়ে সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করবো।

একটা কাজের গ্যাপের কারণে মশার ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ওয়ার্ক অর্ডার (কার্যাদেশ) হয়নি। এখন আমি এসেই অর্ডার করেছি। প্রতি ওয়ার্ডে অ্যাডাল্টিসাইড, লার্ভিসাইড এবং ফগিং মেশিন দিয়ে ব্যাপকভাবে মশার ওষুধ ছিটানো হবে

জাগো নিউজ: প্রতি বছর বর্ষায় নগরে এডিস মশার উপদ্রব বাড়ে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গবেষণা বলছে, বিগত বছরগুলোতে ঢাকা দক্ষিণে ডেঙ্গুরোগী বেশি ছিল। চলতি বছরও রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গু সংক্রমণের আশঙ্কা রয়েছে। এডিস মশা নিধনে আপনারা কী ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন?

শাহজাহান মিয়া: এডিস মশা সাধারণত বদ্ধ পানিতে জন্মায়। আমরা যদি ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার না করি তাহলে মশা বাড়বে। কারণ এসব হচ্ছে মশার জন্য কম্ফোর্ট জোন। তাই আমরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে বেশি নজর দিয়েছি। আমি গত কয়েকদিন ভোরবেলা সেহরি খেয়েই বিভিন্ন ওয়ার্ড পরিদর্শন করছি। ওয়ার্ড সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে সভা করছি। তাদের দীর্ঘদিন কাজ না করার যে মানসিক অবস্থা সেটা থেকে ফেরাতে চেষ্টা করছি। যাতে তারা কাজে উদ্বুদ্ধ হয়। আশা করি এবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ জোরালোভাবে চলবে। এরই মধ্যে কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করছে।

জাগো নিউজ: বেশ কয়েক মাস ধরে ঢাকা দক্ষিণে মশার ওষুধ সংকট রয়েছে। এ বিষয়ে কী উদ্যোগ নিয়েছেন?

শাহজাহান মিয়া: আজ (৪ মার্চ) আমাদের মশার ওষুধ চলে এসেছে। একটা কাজের গ্যাপের কারণে মশার ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ওয়ার্ক অর্ডার (কার্যাদেশ) হয়নি। এখন আমি এসেই অর্ডার করেছি। প্রতি ওয়ার্ডে অ্যাডাল্টিসাইড, লার্ভিসাইড এবং ফগিং মেশিন দিয়ে ব্যাপকভাবে মশার ওষুধ ছিটানো হবে।

জাগো নিউজ: ঢাকা দক্ষিণের বেশকিছু মার্কেট, পার্কের অবকাঠামো উন্নয়নকাজ বেশ ধীরগতিতে চলছে। আবার কিছু জায়গায় কাজ বন্ধ আছে। বিষয়গুলো আপনি অবগত আছেন কি না?

শাহজাহান মিয়া: জুলাই অভ্যুত্থানের পর সব কাজেই কিছুটা স্থবিরতা চলে এসেছিল। সিটি করপোরেশনেও দেখা গেছে, প্রশাসক থাকলে নির্বাহী ছিলেন না, নির্বাহী থাকলে প্রশাসক ছিলেন না। তাই বিভিন্ন কাজ আটকে ছিল। এখন আমরা সব জটিলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। সরকারের উদ্যোগে সব জায়গায় গতি এসেছে।

জাগো নিউজ: ঢাকা দক্ষিণে সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস স্থানীয় সরকার আইন পাশ কাটিয়ে নিজস্ব সার্ভার থেকে ৭৮ হাজার জন্মনিবন্ধন বিতরণ করেছিলেন, যা দিয়ে বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি, পাসপোর্ট বা এনআডি করাতে পারছেন না অভিভাবকরা। এখনো জন্মনিবন্ধন করতে গিয়ে নানান হয়রানির শিকার হচ্ছেন নাগরিকরা। এ সমস্যা সমাধানে কী উদ্যোগ নিয়েছেন?

শাহজাহান মিয়া: স্থানীয় সরকার আইন অনুযায়ী, জন্মনিবন্ধনের দায়িত্ব রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের। এ কার্যালয়ের সার্ভার থেকেই সারাদেশে জন্মনিবন্ধন বিতরণ করা হয়। সেখানে ঢাকা দক্ষিণে নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল। যদিও ৫ আগস্টের পর তা বন্ধ। এখন আমরা নতুন কোনো জন্মনিবন্ধন দিচ্ছি না। যে নিবন্ধনগুলো করা হয়েছিল তা কীভাবে জাতীয় সার্ভারে যুক্ত করা যায় সে বিষয়ে চেষ্টা করছি। কারণ ন্যাশনাল সার্ভারে মাইগ্রেট করা যাচ্ছে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তি বা পদ্ধতি না রাখায় এমন পরিস্থিতি হয়েছিল।

এখন আমরা নতুন কোনো জন্মনিবন্ধন দিচ্ছি না। যে নিবন্ধনগুলো করা হয়েছিল তা কীভাবে জাতীয় সার্ভারে যুক্ত করা যায় সে বিষয়ে চেষ্টা করছি। কারণ ন্যাশনাল সার্ভারে মাইগ্রেট করা যাচ্ছে না

জাগো নিউজ: মেয়রের চেয়ারে প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন। কেমন উপভোগ করছেন?

শাহজাহান মিয়া: আপনারা জানেন সিটি করপোরেশন সব সময় রাজনৈতিক ব্যক্তি দিয়ে পরিচালিত হতো। কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের একটা বিরাট প্রভাব থাকতো। অনেক সময় মেয়র পরিবর্তন হলে কারও কাজে শিথিলতা দেখা যায়। আবার কেউ কাজে যোগ দেন না। সব কাটিয়ে আমরা এখন একটা পর্যায়ে চলে এসেছি। এখানে আমার কোনো পিছুটান নেই। আমি সেবা দিতে এসেছি। আমার বেতনও আমি সিটি করপোরেশন থেকে নেই না। আমি মন্ত্রণালয়ের যে বেতন পাই সেটিই নেই।

জাগো নিউজ: জাগো নিউজকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শাহজাহান মিয়া: জাগো নিউজকেও ধন্যবাদ।

এমএমএ/এএসএ/এমএস