কানাডায় জাস্টিন ট্রুডোর উত্তরসূরি হিসেবে দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন মার্ক কার্নি। আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই শপথ নেবেন তিনি। রোববার তাকে নির্বাচিত করেছে ক্ষমতাসীন লিবারেল পার্টি।
Advertisement
নির্বাচিত হওয়ার পর জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে দেশটির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপের সমালোচনা করেন মার্ক কার্নি। যুক্তরাষ্ট্র মুক্ত বাণিজ্যের প্রতিশ্রুতি না দিলে মার্কিন পণ্যের ওপর প্রতিশোধমূলক শুল্কারোপ বহাল রাখার অঙ্গীকার করেন তিনি।
কানাডা ও যুক্তরাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর কার্নি লিবারেল পার্টির প্রতিদ্বন্দ্বী তিন প্রার্থীকে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত করেন। বিজয়ী ভাষণে কার্নি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কড়া সমালোচনা করেছেন।
ট্রাম্প কানাডার ওপর শুল্ক আরোপ করেছেন এবং দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম রাজ্যে পরিণত করার কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জয়ের পর মি কার্নি বলেন, আমেরিকানদের কোনো ভুল করা উচিত নয়। হকির খেলার মতো বাণিজ্যের খেলায়ও জিতবে কানাডা।
Advertisement
আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার কথা রয়েছে কার্নির। এছাড়া তিনি লিবারেল পার্টির নেতৃত্বে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে অংশ নেবেন। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই নির্বাচন হওয়ার কথা।
সদ্য নির্বাচিত কার্নি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার আগে কখনো রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নির্বাচিত হননি। লিবারেল পার্টির নেতৃত্বের নির্বাচন শুরু হয়েছিল গত জানুয়ারিতে। এর আগে প্রায় এক দশকের মতো ক্ষমতায় ছিলেন জাস্টিন ট্রুডো।
ভোটারদের মধ্যে জনপ্রিয়তা হ্রাস পাওয়া এবং অভ্যন্তরীণ চাপের মুখে জাস্টিন ট্রুডো পদত্যাগ করেন। তার সময়ে কানাডায় আবাসন সংকট ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে জনগণের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়।
রোববার সন্ধ্যায় প্রথম ভোটেই কার্নি জয়ী হন। যেখানে তিনি ৮৫ দশমিক নয় শতাংশ ভোট পেয়ে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ডকে পরাজিত করেন তিনি।
Advertisement
রাজধানী অটোয়ায় লিবারেল পার্টির প্রায় দেড় হাজার সমর্থকের উপস্থিতিতে ফলাফল ঘোষণা করা হয়। তখনই চারিদিকে উল্লাসধ্বনি ছড়িয়ে পড়ে।
দলের পক্ষ থেকে দেওয়া এক ঘোষণায় জানানো হয়, এই নির্বাচনে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ ভোট দিয়েছেন। জয়লাভের পর সংসদে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করবেন কার্নি। এরপর তার সামনে দুটি সুযোগ থাকছে, হয় তিনি নিজেই একটি দ্রুত সাধারণ নির্বাচন ডাকবেন কিংবা বিরোধী দলগুলোর আস্থা ভোটের মাধ্যমে চলতি মাসেই তাকে নির্বাচনের মুখোমুখি হতে হবে।
জাস্টিন ট্রুডোর পদত্যাগের পর থেকে লিবারেল পার্টির রাজনীতিতে বেশ নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাণিজ্য হুমকি এবং কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একীভূত করা নিয়ে তার অবস্থানের কারণে কানাডিয়ানদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ উজ্জীবিত হয়েছে, যা লিবারেলদের প্রতি সমর্থন বাড়িয়েছে।
চলতি বছরের শুরুতে লিবারেলরা বিরোধী কনজারভেটিভ পার্টি থেকে প্রায় ২০ পয়েন্ট পিছিয়ে ছিল। তবে সম্প্রতি সেই ব্যবধান অনেকটাই কমে এসেছে। কিছু জরিপে দেখা গেছে যে, লিবারেল ও কনজারভেটিভরা এখন প্রায় সমান অবস্থানে রয়েছে।
কার্নির বিজয়ী ভাষণের একটা বড় অংশজুড়েই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কানাডার ওপর করা ‘অযৌক্তিক শুল্ক’ নিয়ে সমালোচনা। যদিও কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবেই পরিচিত।
গত মঙ্গলবার কানাডিয়ান পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে কয়েক দিনের মধ্যেই তারা নিজেদের অবস্থান কিছুটা পরিবর্তন করে এবং বিদ্যমান বাণিজ্য চুক্তির শর্ত মেনে চলা কিছু পণ্যকে শুল্কমুক্ত করার ঘোষণা দেয়।
এর প্রতিক্রিয়ায় কানাডাও পাল্টা শুল্ক আরোপ করে। শুল্ক নিয়ে ট্রাম্পের ঘোষণার পর জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ করে বলেছিলেন যে, ট্রাম্প কানাডার অর্থনীতি ধ্বংস করতে চাচ্ছেন।
কার্নি তার বিজয়ী ভাষণে ওই বক্তব্যই পূর্নব্যক্ত করে বলেন, ট্রাম্প কানাডার শ্রমিক, পরিবার ও ব্যবসা-বাণিজ্যকে আক্রমণ করছেন। এসময় তিনি আরও বলেন, আমরা তাকে সফল হতে দেব না। তার এই ঘোষণার পরই ভিড় থেকে তীব্র প্রতিধ্বনি ওঠে।
কার্নি এসময় ঘোষণা দেন, তার সরকার মার্কিন আমদানির ওপর শুল্ক অব্যাহত রাখবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সিদ্ধান্ত না বদলায়। তিনি বলেন, আমি জানি, এটি এক অন্ধকার সময়। একটি দেশের কারণে যাকে আমরা আর বিশ্বাস করতে পারি না, এই অন্ধকার নেমে এসেছে।
কার্নি মঞ্চে ওঠার কিছু আগে জাস্টিন ট্রুডো আবেগঘন বিদায়ী ভাষণ দেন। তিনি তার ১২ বছরের লিবারেল নেতৃত্বের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং সতর্ক করে বলেন, কানাডা এখন ট্রাম্প শাসিত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অস্তিত্বের সংকটের মুখোমুখি।
ট্রুডোর পদত্যাগের পর কনজারভেটিভ পার্টিকে রাজনৈতিকভাবে নতুন কৌশল নিতে হয়েছে। তারা এখন আক্রমণ করছে কার্নিকেও। কনজারভেটিভ পার্টি অভিযোগ করে বলছে যে, কার্নিও ঠিক জাস্টিন ট্রুডোর মতোই। লিবারেলদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে প্রতিপক্ষরা বলছে যে, লিবারেলরা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতা ধরে রাখার ‘গোপন কৌশল’ করছে এবং তারা সেটি করছে শুধুমাত্র নেতা পরিবর্তন করে।
কার্নির সমর্থক ফেডারেল জননিরাপত্তা মন্ত্রী ডেভিড ম্যাকগিন্টি বিবিসিকে বলেন, কার্নি চুপচাপ থাকেন কিন্তু দৃঢ় সংকল্পের দক্ষ মানুষ তিনি। যে কোনো বড় সংকট মোকাবিলা করার সক্ষমতা তার আছে।
পরবর্তী নির্বাচনে লিবারেলরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে পিয়েরে পয়লিয়েভ্রের কনজারভেটিভ পার্টির বিরুদ্ধে। দলটি হাউজ অব কমন্সে ১২০টি আসন নিয়ে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে রয়েছে।
কার্নির মূল নীতিগুলো কী?সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকার কার্নি মূলত মধ্যপন্থি এজেন্ডাগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তার প্রচারণার সময়। যা জাস্টিন ট্রুডোর তুলনায় লিবারেল পার্টিকে কিছুটা ডানপন্থি অবস্থানে ফিরিয়ে এনেছে।
তিনি বড় আকারের জ্বালানি প্রকল্প, বিশেষ করে পাইপলাইন নির্মাণ এগিয়ে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাজনৈতিক বাধার মুখে পড়েছে।
কার্নি উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আবাসন খাতে এবং পরিচ্ছন্ন জ্বালানি প্রকল্পে। যা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অন্যদিকে কানাডার বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে বাণিজ্য সংক্রান্ত বিদ্যমান সংকট কাটিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারকে আরও উন্মুক্ত ও সহজ করার পরিকল্পনা করেছেন।
আরও পড়ুন: কানাডার নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি সৌদির গ্রান্ড মসজিদে রোবোট চালু, উত্তর দেবে বিভিন্ন প্রশ্নের রমজানে ভিক্ষা করা প্রবাসীদের ফেরত পাঠাচ্ছে কুয়েততিনি কানাডার অর্থনীতিকে শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভরশীল না রেখে আরও বৈচিত্র্যময় করতে চান, যাতে অন্যান্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানো যায়। দলের মধ্যে নেতৃত্ব নির্বাচনের সময় কার্নি ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, তিনি ফেডারেল সরকারের আকার সীমিত রাখবেন। ট্রুডোর শাসনামলে সরকারি ব্যয় ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেটি কমানোর পরিকল্পনা করেছেন কার্নি।
টিটিএন