এক যুগেও নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি চুয়াডাঙ্গার দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানির আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদনের জন্য অটোমোশনের কাজ। ফলে শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন বিএমআরই প্রকল্পে কেরু কারখানায় আখ মাড়াই সম্ভব হলো না এ মৌসুমেও। এরই মধ্যে ৯ মার্চ শেষ হলো এবারের মাড়াই মৌসুম।
Advertisement
জানা গেছে, দেশের সবকটি চিনিকলের আখ মাড়াই কার্যক্রম শুরু হয় ২০২৪ সালের নভেম্বরের শুরু থেকে। পর্যায়ক্রমে ডিসেম্বরের শুরুতে কেরু চিনিকলে ২০২৪-২৫ আখ মাড়াই মৌসুম শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ২০ ডিসেম্বর কেরুজ আখ মাড়াই কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হয়। দেরিতে আখ মাড়াইয়ের কারণে একদিকে যেমন আখ শুকিয়ে লোকসান গুনেছে, অন্যদিকে অন্যান্য ফসল চাষে হয়েছে বিলম্ব। ফলে চরমভাবে দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে কৃষকদের।
এরমধ্যে চলতি মৌসুমে (৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) ৬০ হাজার ৪৩৮ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে চিনি উৎপাদন হয় ৩১২৮ মেট্রিক টন। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৫৬ হাজার ৪১৩ মেট্রিক টন আখ মাড়াই করে ২ হাজার ৬০৮ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়েছিল। গত ১০ ফেব্রুয়ারি ৫২ মাড়াই দিবসে আখ মাড়াই কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়। সেসময় পর্যন্ত কেরুর নিজস্বসহ কৃষকদের প্রায় ১ হাজার ৪০০ একর জমিতে আখ ছিল। ওই আখ ২৫ ফেব্রুয়ারি বিএমআরই (আধুনিকায়ন) চিনি কারখানায় মাড়াইয়ের মাধ্যমে উদ্বোধন করার প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু গত ২৫ ফেব্রুয়ারি সে গুড়ে বালি পড়ে।
আরও পড়ুন প্রস্তুতি ছাড়াই পরিত্যক্ত চিনিকল চালুর উদ্যোগ জয়পুরহাটে বেড়েছে আখচাষআধুনিকায়নকৃত কারখানার পাওয়ার টার্বাইন সমস্যা জনিত কারণে তা সম্ভব হয়নি। নির্ধারিত সময়ের আগেই ২০২৪ সালের শেষের দিকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি। ফলে অটোমোশন পদ্ধতিতে মাড়াই ও চিনি উৎপাদন সম্ভব হয়নি।
Advertisement
বিএমআরই কেরুজ প্রকল্প পরিচালক ফিদাহ হাসান বাদশা বলেন, পাওয়ার টার্বাইন সমস্যা দ্রুত নিরসনকরণে জোরেসোরে কাজ চলছে। আশা করা যাচ্ছে এ কাজ সম্পন্ন করা হলে ওয়াটার ট্রায়ালের মাধ্যমে প্রস্তুত করা হবে। ফলে এবার না হলেও আগামী আখ মাড়াই মৌসুমে আধুনিকায়নকৃত এ কারখানায় আখ মাড়াই করতে পারবে কেরুজ চিনিকল কর্তৃপক্ষ।
এ প্রজেক্টের সঙ্গে যুক্ত এমন একজন প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করে বলেন, এই প্রজেক্টে সব ভারতীয় প্রযুক্তি। ভারতীয় প্রযুক্তির কারণেও জটিলতা বাড়ছে।
দর্শনা কেরু সূত্রে জানা গেছে, ১৯৩৮ সালে প্রতিষ্ঠিত দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের উন্নয়নের লক্ষ্যে ভারসাম্য, আধুনিকীকরণ, পুনর্বাসন ও সম্প্রসারণে ১০২ কোটি ২১ লাখ ৩৮ হাজার টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। ২০১২ সালে ব্যালেন্সিং মর্ডানাইজেশন রেনোভেশন অ্যান্ড এক্সপেনশন (বিএমআরই) প্রকল্পের অনুমিত পায়। এরপর ২০১৩-২০১৪ সালে চুক্তি হয় বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেডের সঙ্গে। তবে প্রকল্পটির মূল কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালে। ২০১৬ সালে শেষ হয় প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ। পরবর্তীতে কিছু কাজ সংযোজনের জন্য ২০১৮ সালে প্রকল্পটি সংশোধনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে নতুন মিল হাউজ, আধুনিক আরও একটি টার্বাইন বসানো, সুগার জার স্থাপন, সুগার প্যান বসানোসহ অনেক কিছু সংযোজন করা হয়।
ওই বছরের ৪ নভেম্বর সংশোধিত প্রকল্পটির অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। পরে আবারও চুক্তি হয় বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেডের সঙ্গে। ১০২ কোটি ২১ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে এ প্রকল্পটির। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে কাজ শেষ হচ্ছে না। একটার পর একটা সমস্যা লেগেই আছে। ভারতীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করায় জটিলতা দীর্ঘ হচ্ছে। হাতের স্পর্শ ছাড়াই অটোমোশন পদ্ধতিতে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির আখ মাড়াই ও চিনি উৎপাদন কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়েছে। যন্ত্রপাতি ও মেশিনে ত্রুটি থাকায় দীর্ঘদিনেও চালু করা সম্ভব হচ্ছে না।
Advertisement
এদিকে একদিকে আখ মাড়াই দেরিতে শুরু, অন্যদিকে মাড়াইয়ের মাঝপথে ১৫ দিন মিল বন্ধ থাকায় চিনি উৎপাদন হ্রাস ও কৃষকরা লোকসানের মুখে পড়লেন। কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয়ে মাড়াই কার্যক্রম শেষ করতে ব্রিটিশ আমলের ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে ফেরে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে বারবার অটোমোশন পদ্ধতিতে চিনি কলটি চালুতে ব্যর্থ হচ্ছে। মিলটি আখ মাড়াই করে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা লোকসানের মুখে পড়ছে।
৮৭ বছরের পুরাতন এ মিলটি জোড়াতালি দিয়েই প্রতি মাড়াই মৌসুমে চালু করা হয়ে থাকে। যে কারণে চিনি আহরণের গড় হার স্বাভাবিকভাবে কমে যাচ্ছে বলেও মন্তব্য কারখানা শ্রমিক-কর্মচারীদের।
কেরু অ্যান্ড কোম্পানির শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ সবুজ বলেন, অটোমেশন পদ্ধতিতে মিল চালু করা সম্ভব হলে ভালো হতো। কৃষকরা ক্ষুব্ধ। তারা আখ ও মুড়ি আখ ভেঙে ফেলছেন। আখ চাষ আবার নতুন করে ফিরিয়ে আনতে হলে ২-৩ বছর সময় লেগে যাবে। হেড অফিসসহ এখানকার ম্যানেজমেন্ট ব্যর্থ। যন্ত্রপাতি দেখে নেওয়া উচিত ছিল করপোরেশনের। কিন্তু তারা পারেনি। দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কেরু মিলে কর্মরত অনেক কর্মকর্তা ও কর্মচারী অভিযোগ করে জানান, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মিলে যোগদানের পর কেরু জৌলুস হারাতে বসেছে। তিনি অফিসে একবার ঢুকলে আর চেয়ার থেকে ওঠেন না। মিলের ভালো-মন্দ নিয়ে কোনো চিন্তা ভাবনা নেই। এর আগে যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন সেখানেই নাজুক অবস্থা তৈরি হয়েছে। ডিস্টিলারি বিভাগের উৎপাদনও হ্রাস পাচ্ছে। মিল ক্যাম্পাসে বার বার ককটেল উদ্ধার হচ্ছে। সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। প্রশাসনিক ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে।
এ বিষয়ে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান বলেন, ঐতিহ্যবাহী কেরু অ্যান্ড কোম্পানিতে বিএমআরই প্রকল্পের মাধ্যমে বয়লার ও মিলহাউজ নতুনভাবে বসানো হচ্ছে। এটা সরকারের একটা উন্নয়ন প্রজেক্ট। এই প্রকল্প করপোরেশন থেকে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এটা দেখভালের জন্য এই প্রকল্পের একজন প্রজেক্ট ডিরেক্টর (পিডি) আছেন। তারা মূলত সবকিছুর করছে। এই প্রকল্প শেষ হওয়ার দুই বছর পর কেরু অ্যান্ড কোম্পানি কর্তৃপক্ষ কাজ বুঝে নেবে। তাই এই প্রকল্পের বিষয়ে প্রকল্পের পিডি ও করপোরেশন সবকিছু তদারকি করছে। আমরা অর্থাৎ কেরু কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো কিছুই মন্তব্য করতে পারি না।
এফএ/জিকেএস