প্রবাস

ধর্ষণ ও সমাজের অবস্থান

বিশ্বজুড়ে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের পরিসংখ্যান মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়, যা সমাজের জন্য ভয়াবহ বার্তা বহন করে। বিভিন্ন জরিপে বিভিন্ন দেশ শীর্ষস্থানে উঠে আসে, যা নির্ভর করে গবেষণার পদ্ধতি ও বিবেচ্য বিষয়ের ওপর। এসব জরিপে সাধারণত নারীদের শিক্ষা, আইনি, রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। যেমন, অনেক দেশে ১৮ বছরের আগেই অর্ধেক মেয়ের বিয়ে হয়ে যায় এবং দশজনের মধ্যে আটজনই গৃহিণী হন।

Advertisement

ধর্ষণ পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই কম-বেশি ঘটে। কেউ কেউ দিল্লিকে ‘ধর্ষণের রাজধানী’ বলে অভিহিত করে, কিন্তু বাস্তবে উন্নত দেশগুলোও ধর্ষণের পরিসংখ্যানে অনেক এগিয়ে আছে। অনেক গবেষণা দেখায়, অনুন্নত দেশে ধর্ষণের ঘটনা প্রায়ই পুলিশে রিপোর্ট করা হয় না, ফলে সেসব অপরাধ অন্ধকারে রয়ে যায়।

জাতিসংঘের এক সমীক্ষা অনুসারে, ইউরোপীয় দেশগুলোতে ১৫ বছরের আগেই ৩৩ শতাংশ মেয়ে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। বিশ্বের ৩৫ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন, যাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ চুপ থাকেন এবং মাত্র ১০ শতাংশ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সহায়তা চান।

অনেকে বলে, ধর্ষণের তালিকায় মুসলিমপ্রধান দেশগুলো নেই, তবে প্রতিবেশী ভারত পঞ্চম এবং সুইডেন তৃতীয় স্থানে রয়েছে। সুইডেনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ধর্ষণের হার বেশি। অনেকেই মনে করেন, বিয়ের পর সবকিছু স্বেচ্ছাধীন, কিন্তু স্বামী বা স্ত্রীর অনিচ্ছায় কোনো সম্পর্ক হলে তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হয়, যা সম্পর্কের অবনতি ঘটায় এবং আইনত শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

Advertisement

অবিবাহিত বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অনেকেই ধর্ষণের মতো অপরাধে লিপ্ত হয়। ইউরোপ ও আমেরিকায় এসব ঘটনা প্রকাশ্যে আসে এবং যথাযথ তদন্ত হয়, কিন্তু অনেক দেশে পরিবার, সমাজ বা দুর্বল বিচারব্যবস্থার কারণে ঘটনাগুলো গোপন থাকে।

ধর্ষণ ও সামাজিক ব্যাধিঅনেকের ধারণা, সুইডেন ‘ফ্রি সেক্স’ এর দেশ, যেখানে সবকিছু সম্ভব। কিন্তু আসলে, ‘ফ্রি সেক্স’ বলতে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে সম্পর্ক বোঝানো হয়, যেখানে কাউকে জোর বা বাধ্য করা যায় না। এজন্য সুইডেনে ধর্ষণের সংজ্ঞা ব্যাপকভাবে বিস্তৃত এবং অনেক ক্ষেত্রেই রিপোর্ট করা হয়।

বাংলাদেশের ধর্ষণের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। চার দশক আগেও ধর্ষণ ছিল, কিন্তু বর্তমানে তা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে, বিশেষ করে শিশু ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। এখন ছেলে-মেয়ে কেউই নিরাপদ নয়।

আরও পড়ুন মালয়েশিয়ায় সাংবাদিকদের সম্মানে ইফতার মাহফিল  সাড়ে ৩ হাজারেরও বেশি বাংলাদেশির দ্বিতীয় নিবাস 

ধর্ষণ বাংলাদেশে নতুন কিছু নয় এবং দুঃখজনক হলেও সত্য, এটি যে আর হবে না, সেটাও নিশ্চিত করে বলা কঠিন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিশু ধর্ষণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে এবং এ পরিস্থিতিতে ছেলে-মেয়ে কেউই নিরাপদ নয়। অপরাধীরা ধরা না পড়া পর্যন্ত নির্দোষ, কিন্তু যখন অপরাধ প্রমাণিত হয়, তখন কী বিচার নিশ্চিত হচ্ছে? নাকি অপরাধীরা রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে?

Advertisement

শিশু ধর্ষণ: বিচারহীনতার নির্মম বাস্তবতাজাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই বছরে ২৩৩ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসেই সবচেয়ে বেশি, ৩৫টি ঘটনা ঘটেছে, যা গড়ে প্রতিদিন এক শিশুর ধর্ষণের সমান। ২০১৯ সালের প্রথম ছয় মাসে ৭-১২ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে ধর্ষণের হার ছিল সর্বোচ্চ।

এই পরিসংখ্যান কেবল রিপোর্ট হওয়া ঘটনাগুলোর চিত্র তুলে ধরে। বাস্তবে, ধর্ষণের শিকার অনেক শিশু ও তার পরিবার সামাজিক লজ্জা, হুমকি ও বিচারহীনতার কারণে মামলা করতেই পারে না। ফলে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে।

রাজনীতি নাকি মানবিকতা?

সম্প্রতি ৮ বছরের একটি শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। শিশুটি হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়লেও, রাজনৈতিক মহল একে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার বানিয়েছে। এক পক্ষ অপর পক্ষকে দোষারোপ করছে, অথচ প্রকৃত সমস্যা, অর্থাৎ অপরাধীদের বিচার ও ভুক্তভোগীর পুনর্বাসনের বিষয়টি আড়ালে থেকে যাচ্ছে।

হাসপাতালের পরিবেশ, নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন উঠছে। সেখানে কীভাবে শত শত মানুষ ভিড় করছে? যেখানে কঠোর নিরাপত্তার প্রয়োজন, সেখানে কীভাবে রাজনৈতিক নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে? সেফটি, সিকিউরিটি, হাইজিন ম্যানেজমেন্ট কি এই হাসপাতালগুলোতে আদৌ কোনো গুরুত্ব পায়? যদি বিএনপির কোনো হাই-প্রোফাইল ব্যক্তি শিশুটির চিকিৎসার খরচ বহন করেও থাকে, তাহলে সেটি কি নিছক মানবিকতা নাকি অন্য কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য?

এই প্রশ্নগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ঘটনাটির মূল উদ্দেশ্য যদি সত্যিই মানবিক হতো, তাহলে এটি মিডিয়া সার্কাসে পরিণত হতো না। বিশ্বের উন্নত দেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও, হাসপাতালের ভেতরে ভুক্তভোগীকে ঘিরে এমন রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডার নজির খুব কমই দেখা যায়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি ও ভয়াবহ ভবিষ্যৎবাংলাদেশে যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুরা ন্যায়বিচার কতটুকু পায়? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হয়, প্রভাবশালী অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর গলে বেরিয়ে যায়, আর ভুক্তভোগী পরিবার সামাজিক লাঞ্ছনার শিকার হয়। ফলে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হয়।

আমরা কি নিজেদের সন্তানদের এই পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছি? আজ যদি ভুক্তভোগী শিশু আমাদের ঘরের কেউ হতো, তাহলে কি আমরা এমন রাজনৈতিক প্রপাগান্ডা সহ্য করতাম?

সমাধান কী?• অপরাধীদের দ্রুত গ্রেফতার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।• হাসপাতালে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যেন সেখানে কোনো ধরনের অরাজকতা সৃষ্টি না হয়।• শিশু ধর্ষণের ঘটনাগুলোকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে, প্রকৃত বিচার ও পুনর্বাসনের দিকে নজর দিতে হবে।• সমাজের সচেতন অংশকে এগিয়ে আসতে হবে, যেন ধর্ষণের শিকার শিশুরা ন্যায়বিচার পায় এবং তাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা যায়।

ধর্ষণ ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে একমাত্র কার্যকর পথ হলো বিচার ও শাস্তির নিশ্চয়তা। আর রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, দোষারোপের খেলা ও মিডিয়া প্রপাগান্ডা বন্ধ না হলে, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ হবে ভয়াবহ এক সমাজ, যেখানে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মও নিরাপদ থাকবে না। এখন সময় এসেছে ঘৃণা, প্রতিহিংসা ও নাটক থেকে বেরিয়ে এসে ন্যায়বিচারের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার।

রাষ্ট্র কি সত্যিই এসব অমানবিকতা বন্ধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে? সাহসী নেতৃত্বের প্রয়োজন মানে কি সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে রাজনীতি করা?

উলার শিক্ষা এসব ভাবতে গিয়ে আমার মনে পড়ে সুইডেনের ৮৪ বছর বয়সী বিধবা উলার কথা। তিনি পশুপালন করেন এবং ভেড়াগুলোর জন্মের পর সেগুলোর মধ্যে যেন অস্বাভাবিক সম্পর্ক না গড়ে ওঠে, তা নিয়ন্ত্রণ করেন। কারণ, পশুরা আপন ভাইবোনের সম্পর্ক বোঝে না।

উলার এই চিন্তা আমাকে ভাবায়—আমাদের সমাজে কি এমন কেউ নেই যে ধর্ষকদের আলাদা করে নিয়ন্ত্রণ করবে? সমাজ কি সত্যিই এতটাই ব্যর্থ যে মানুষ নামের দানবগুলোকে থামাতে পারছে না?

সমাজে ঘৃণা ছড়ানো নয় বরং ভালোবাসা দিয়ে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করতে হবে। শুধু অতীত টেনে আনা নয় বরং নতুনভাবে ভাবতে হবে। সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার—কে মানুষ, আর কে অমানুষ।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন) Rahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/জিকেএস