দেশজুড়ে

দুঃখের সাগরে থেকেও হাসিমুখে দিন-রাত কাজ করছেন প্রতিবন্ধী সালমা

ছোট্ট হাত-ছোট্ট পা। উচ্চতা মাত্র ৩ ফুট। তবে জীবন সংগ্রামে বহুদূর এগিয়ে যাওয়ার ভাবনায় পথচলা থেমে নেই সালমা খাতুনের (৩৫)। পরিবারের বোঝা না হয়ে মনোবলকে কাজে লাগিয়ে কাজ করছেন বহু বছর। চলার পথকে নিজেই মসৃণ করে নিয়েছেন ক্লান্তিহীন এই নারী। তবে শরীরের গঠন অন্য সব নারীর মতো না হওয়ায় এখনো তাকে চলতে হচ্ছে নানা প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে।

Advertisement

সালমা ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার রূপসী ইউনিয়নের চৌরাস্তা পাগলা বাজার এলাকার চাঁনু মিয়া ও রাশিদা বেগম দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে দ্বিতীয়।

বাবা চাঁনু মিয়া স্থানীয় বাজারে ছোট্ট একটি মুদির দোকান করতেন। সারাদিনে যা রোজগার হতো, তা দিয়েই কোনোভাবে চলছিল সংসার। অভাবের সংসারে সালামকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করিয়েছেন৷ তবে দারিদ্র্যের কষাঘাতে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয়নি। এমতাবস্থায় পরিবারের বোঝা না হয়ে চাকরি করতে চলে আসেন ময়মনসিংহ শহরে। চরপাড়া এলাকার একটি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি নেন তিনি। যা বেতন পেতেন নিজের থাকা-খাওয়ার খরচ বাদে সবই তুলে দিতেন পরিবারের হাতে। এভাবে দিন যেতে থাকে।

বড় ভাই আর ছোট বোনের বিয়ে হলেও দৈহিক উচ্চতা কম হওয়ায় বিয়ে হচ্ছিলো না সালমার। এসময় এক যুবক প্রেমের ফাঁদে ফেলে বিয়ে করেন তাকে। পরে দুই বছরের মধ্যে সালমাকে ফেলে চলে যান। এর মাঝে মারা যান বটগাছের মতো ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়ানো বাবা। এতে কষ্টের সাগরে পড়েন সালমা। একমাত্র বড় ভাই নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। মায়ের খোঁজখবর নেন না। মা-মেয়ের সংসারের হাল শক্ত হাতে ধরে রাখেন সালমা। আগের মতোই অসুস্থ মায়ের সব খরচ বহন করাসহ সংসারের যাবতীয় খরচ চালিয়ে যান তিনি। সময় পেলেই গ্রামের বাড়িতে ছুটে যান তিনি। গিয়ে মায়ের সেবাযত্ন করেন। জীবিকার যুদ্ধের পাশাপাশি স্বামীর কাছ থেকে নিজের প্রাপ্য অধিকার ফিরে পেতেও চেষ্টা চালাচ্ছেন সালমা।

Advertisement

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সালমা ১৭ বছর ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে চাকরি করছেন। প্রথমে যৎসামান্য বেতন পেলেও ধীরে ধীরে বেতন বাড়ে। প্রতিদিন ১২ ঘণ্টা কাজ করেন তিনি। বর্তমানে মাস শেষে তিনি বেতন পাচ্ছেন ১০ হাজার টাকা। এই হিসেবে প্রতিদিন রোজগার হচ্ছে ৩৩৩ টাকা। একই সময় পর্যন্ত কাজ করে আরও পুরুষ সহকর্মীরা আরও বেশি পাচ্ছেন। তবে এতে হতাশ নন সালমা। নিজের পরিশ্রমে যা রোজগার হয় তাতেই খুশী তিনি। হাসিমাখা মুখে প্রতিদিন যথাসময়ে কাজে যান তিনি। বিশ্ব নারী দিবস কখন আসে-যায় দারিদ্র্যের লড়াই আর কর্মব্যস্ততায় টেরই পান না জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত এই নারী।

স্থানীয়রা জানান, ছোটবেলা থেকেই দারিদ্রতার সঙ্গে যুদ্ধ করে বড় হয়েছেন সালমা। কষ্টে উপার্জিত টাকা ব্যয় করছেন পরিবারে। বুকফাটা কষ্ট নিয়েও হাসিমুখে পথ চলেন তিনি। এভাবে জীবনের পথ পাড়ি দেওয়ার মধ্যেই রাকিবুল ইসলাম নামের এক যুবক তাকে প্রেম নিবেদন করে। বিয়ের পর সুখী জীবনে আশ্বাসে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন সালমা। তবে তার আশা দুরাশায় পরিণত করে ওই যুবক। উদ্যমী এই নারীকে যুবকের লালসার শিকার বানিয়ে সটকে পড়েন।

স্থানীয় আব্দুল মোতালেব নামের একজন জাগো নিউজকে বলেন, সালমার কষ্ট দেখলে আমরাও কষ্ট পাই। ছোট্ট শরীর নিয়ে গুটি গুটি হাত-পায়ে অনেক কষ্ট করে চাকরি করছেন। সে সমাজ কিংবা পরিবারের বোঝা হতে নারাজ। জীবন সংগ্রামে এগিয়ে যেতে তার চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই। সালমা সবসময় ভালো থাকুক, এটাই আমাদের চাওয়া।

আরও পড়ুন যশোরে প্রান্তিক নারীদের দিন বদলের গল্প সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় প্রথম হওয়ার গল্প শোনালেন সাদিয়া শত শত প্রতিবন্ধীকে স্বাবলম্বী করে চলেছেন ৩৯ ইঞ্চির অদম্য হোসনা

কথা হয় সালমা খাতুনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, এক সপ্তাহ সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চাকরি করলে পরের সপ্তাহ রাত ৮টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত চাকরি করি। ডাক্তারের কাছে রোগী নিয়ে যাওয়া, রোগীদের দেখাশোনাসহ অফিসের আনুষঙ্গিক কাজ করি। বেতন পাই মাত্র ১০ হাজার। আমার শক্তি সামর্থ্য কম থাকাসহ শারীরিক গঠনে আমি দেখতে অন্য স্বাভাবিক নারীদের মতো না। বয়স হলেও আমার উচ্চতা মাত্র ৩ ফুট। শরীরের গঠন ছোট হলেও আমাকে দেওয়া সব কাজই যথাযথভাবে পালন করি।

Advertisement

তিনি বলেন, বহু বছর ‘দি-কেয়ার ডায়াগনস্টিক সেন্টার’ এ চাকরি করলেও এখন ‘সময় ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতাল’ এ চাকরি করছি। আমাকে যে টাকা বেতন দেয় তা বাধ্য হয়েই নিতে হয়। তবে আমার মতো একই কাজ করে বিভিন্ন ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিকে থাকা অন্যান্য নারী-পুরুষ বেশি টাকা পাচ্ছেন। তবুও আমার মনে কষ্ট নেই।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে সালমা বলেন, আমার জীবনটা নষ্ট করেছে রাকিবুল। সে আমাকে বলেছিলো, ভালোবাসে, আমি খাটো বলে কখনো অবহেলা করবে না, আমাকে অনেক সুখে রাখবে। এমন আশ্বাস দিয়ে দেড় বছর আগে বিয়ে করেছে। তবে গত পাঁচ মাস আগে হঠাৎ আমাকে বাসায় ফেলে চলে যায়। সে বিয়ের নামে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে। এজন্য আমি সম্প্রতি আদালতে মামলা করেছি।

তিনি বলেন, নারীদের স্বাধীনতা, এগিয়ে যাওয়ার গল্প শুনানোসহ প্রতিবছর নারী দিবসও পালন করা হয়। নারীরা আগের চেয়ে স্বাধীন, নারীরা এখন সবকিছুতেই পারদর্শী এবং সবক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ রয়েছে। এটি আমাদের জন্য প্রশান্তি হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য, নিপীড়ন, কাজ অনুযায়ী পুরুষের সমান বেতন এখনো নিশ্চিত হয়নি। পুরুষ নামের কিছু নরপিশাচদের অন্তরও পরিষ্কার করতে হবে। তাহলে নারীদের এগিয়ে যাওয়া কেউ ঠেকাতে পারবে না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সময় ডায়াগনস্টিক ও হাসপাতালের একজন পরিচালক জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে সালমা খাতুনসহ অন্য নারীরা যথাযথ সম্মানের সঙ্গে কাজ করছেন। বেতনে তাদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করা হচ্ছে না। তবে বেতন বাড়ানোর পরিকল্পনা চলছে। আমরাও চাই, সব নারীরা প্রশান্তি নিয়ে কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকুক।

নারী নেত্রী ও উদ্যোক্তা সৈয়দা সেলিমা আজাদ বলেন, সমাজের একটি বড় অংশ নারীকে দুর্বল হিসেবে দেখে। নারীদের অধিকার ও মর্যাদাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে না। তবে বাস্তবতা হলো, নারীরা এখন সবকিছুতেই পারদর্শী এবং সবক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ রয়েছে। আমরা চাই নারীর প্রতি সহিংসতা কমে আসুক এবং নারীরা যেন সাহসী হয়ে ওঠে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ময়মনসিংহ মহানগরে সম্পাদক আলী ইউসুফ বলেন, নারীর সমতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে হবে। নারীরা নিরাপদে থাকলে কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়বে। এতে দেশ উন্নয়নের দিকে আরও এগিয়ে যাবে।

ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার কাজী আখতার উল আলম বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা, যৌন হয়রানি কিংবা ধর্ষণের মতো ঘটনার অভিযোগ পেলে পুলিশ অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। সমাজের প্রত্যেকটি মানুষকে নিরাপদে রাখতে ও অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশ কাজ করছে।

এমএন/জিকেএস