হারুন অর রশিদ
Advertisement
একটা সময় ছিল, যখন গ্রামবাংলার প্রতিটি সকাল শুরু হতো গরুর গাড়ির চাকার ঘর্ষণ, রাখালের বাঁশির সুর আর শিশির ভেজা পথের শিউলি ফুলের সুবাসে। মাঠের সবুজ চাদরে ছেলেরা গরু চরাতে যেত, আর মাটির পথ ধরে হেঁটে যাওয়া কৃষকের মুখে থাকতো নতুন স্বপ্নের আলো। বিকেল হলেই উঠোনজুড়ে শুরু হতো শিশুদের হাসি-আনন্দের কোলাহল। অথচ সময়ের পরিবর্তনে সেই চিত্র এখন শুধুই স্মৃতির পাতায় বন্দি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার সেই চির চেনা রূপ, বদলে যাচ্ছে জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য। এখন কি ঘুরতে গেলে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে?
রাখাল আর বাঁশির সুরআগে গ্রামের মাঠে গেলে দেখা যেত, রাখালেরা গরু চরাতে গিয়ে বাঁশি বাজাচ্ছে। সেই সুরে বিমোহিত হতো পথচলতি গ্রামের মেয়েরা। কিশোর বয়সের এক অদ্ভুত ভালো লাগা লুকিয়ে থাকতো সেই সুরে। কিন্তু এখন? আধুনিক কৃষি ব্যবস্থায় ট্রাক্টর আর পাওয়ার টিলারের দখলে চলে গেছে মাঠ। রাখালদের জায়গা দখল করেছে বড় বড় খামার, যেখানে গরু চরানোর প্রয়োজন হয় না। ফলে বাঁশির সেই সুরও থেমে গেছে অনেক আগেই।
ধান ক্ষেতে কৃষকের পদচিহ্ন কমছেএকসময় কৃষকেরা মাথায় পান্তা নিয়ে ভোরবেলায় বেরিয়ে যেতেন ধান ক্ষেতে। পা মাটির কাদায় মিশে থাকতো, মাঠের আইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে গুনগুন করতেন কোনো সাদামাটা লোকগান। এখন আর সেই দৃশ্য দেখা যায় না। কৃষিকাজ অনেকটাই যান্ত্রিক হয়ে গেছে। আধুনিক সেচব্যবস্থা, কীটনাশক আর উচ্চফলনশীল বীজের ব্যবহার কৃষিকাজের চেহারা বদলে দিয়েছে। ফলে কৃষকের সেই সহজ-সরল জীবনযাত্রা এখন প্রায় অতীত।
Advertisement
শিশুদের খেলাধুলার পরিবর্তনপড়ন্ত বিকেলে গ্রামের পথে ছেলেমেয়েদের হৈ-হুল্লোড় ছিল চির চেনা দৃশ্য। দড়ি লাফ, গোল্লাছুট, বউচি, কানামাছি, হাডুডু—এসব খেলার মধ্য দিয়েই কেটে যেত গ্রামের শিশুদের শৈশব। বর্ষাকালে কাদা মেখে ফুটবল খেলার যে আনন্দ, তা ছিল অনন্য। তালগাছের পাতা দিয়ে তৈরি পাখির ডানা গায়ে বেঁধে কেউ কেউ ‘উড়বে’ বলে দৌড়াতো মাঠের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে। কিন্তু এখন? মোবাইল ফোন আর ভিডিও গেমের আসক্তিতে শিশুরা মাঠে যাওয়ার বদলে ঘরেই বন্দি।
আরও পড়ুন রঙের ক্যানভাসে জিয়াউরের স্বপ্নের সংগ্রাম হারুন মিয়ার ৩০ বছরের শিল্পসত্তাসন্ধ্যার উঠোন আর জোনাকির আলোআগে সন্ধ্যার পর প্রতিটি বাড়ির উঠোনে সবাই একসঙ্গে বসতো। দাদু-নানুরা রূপকথার গল্প শোনাতেন, শিশুরা মনোযোগ দিয়ে শুনতো। উঠোনে বসে সন্ধ্যার নরম বাতাস গায়ে মেখে গল্প করার যে আবহ, তা ছিল একদম অন্যরকম। আর জোনাকির আলো? আজকের প্রজন্ম হয়তো বিশ্বাসই করবে না, একসময় গ্রামের রাতে অসংখ্য জোনাকি উড়ে বেড়াতো, যা রাতের অন্ধকারে ছড়িয়ে দিতো এক রূপকথার সৌন্দর্য। এখন অতিরিক্ত কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জোনাকির সংখ্যা কমে গেছে।
সংস্কৃতির পরিবর্তনগ্রামের প্রতিটি উৎসব ছিল একত্রিত হওয়ার উপলক্ষ্য। বৈশাখী মেলা, নবান্ন উৎসব, পৌষসংক্রান্তি, হালখাতা—এসবই ছিল গ্রামীণ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু এখন এসব উৎসব কেবল আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ। গ্রামীণ লোকগান, পুঁথিপাঠ, যাত্রাপালা হারিয়ে যেতে বসেছে। টেলিভিশন, ইন্টারনেট আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সহজলভ্যতা গ্রামীণ বিনোদনকে শহুরে বিনোদনের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলেছে।
প্রযুক্তির ছোঁয়ায় গ্রামবাংলাঅবশ্য পরিবর্তন মানেই সবকিছু খারাপ নয়। আধুনিক প্রযুক্তির কারণে গ্রামীণ জীবনযাত্রা সহজ হয়েছে। কৃষি উৎপাদন বেড়েছে, যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে, বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে প্রতিটি ঘরে। কিন্তু এসব উন্নয়নের মাঝেও হারিয়ে যাচ্ছে সেই নিখাদ, প্রাণবন্ত গ্রামবাংলা।
Advertisement
সময় বদলেছে, বদলেছে গ্রামীণ জীবনধারা। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সুবিধা বেড়েছে, কিন্তু নস্টালজিয়া আর আবেগ হারিয়ে গেছে। এখনো যদি কেউ সত্যিকারের গ্রামীণ পরিবেশ খুঁজতে চায়, তবে তাকে ফিরে যেতে হবে কয়েক দশক আগে, স্মৃতির পাতায়। নতুন প্রজন্মের কাছে সেই গল্প এখন শুধুই কল্পনা, কিন্তু যারা সেই সময়টা দেখেছেন, তাদের মনে আজও বাজে সেই রাখালের বাঁশির হারিয়ে যাওয়া সুর।
এসইউ/জিকেএস