জাতীয়

ঘোষিত ‘নীরব এলাকায়’ হর্নে কান ঝালাপালা

শব্দদূষণ রোধে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও এর সামনের তিন কিলোমিটার মহাসড়ককে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করেছিল পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। পাঁচ মাস যেতে না যেতেই আগের অবস্থানে ফিরে গেছেন যানবাহনের চালকরা। কারণে-অকারণে তাদের বাজানো হর্নে কান রীতিমতো ঝালাপালা। বিষয়টি তদারকির কেউ নেই।

Advertisement

রাজধানীর সচিবালয়, আগারগাঁও, সংসদ ভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ ১০টি এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করার কথা বলেছিল সরকার। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করেনি। শুধু সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রেখেছে।

তবে পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, বিমানবন্দর ও এর সামনের মহাসড়ককে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণার পর শব্দদূষণ কিছুটা কমেছিল। কিন্তু কয়েক দিন না যেতেই তা ফিরে গেছে আগের অবস্থানে। সার্বিকভাবে বিমানবন্দর এলাকায় শব্দদূষণ পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হয়নি। উল্টো মাত্রাতিরিক্ত হর্নে কান রীতিমতো ঝালাপালা হয় চলাচলকারীদের। তবে চালকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করছে মন্ত্রণালয়।

গত ১ অক্টোবর শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ২০০৬ এর বিধি-৪ অনুযায়ী ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা ও তার সামনের সড়কের উত্তর-দক্ষিণে দেড় কিলোমিটার (স্কলাস্টিকা স্কুল থেকে হোটেল লা মেরিডিয়ান পর্যন্ত) এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণার নির্দেশ দেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তখন উপদেষ্টার নির্দেশনা বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক), ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি), পরিবেশ অধিদপ্তর, সড়ক বিভাগ, পরিবহন মালিক সমিতি। পরে ওই বিমানবন্দর ও মহাসড়কে ‘নীরব এলাকা’ লেখা সাইনবোর্ড বসানো হয়।

Advertisement

ঢাকা শহরে কেউ ট্রাফিক মানে না। সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল, জেব্রা ক্রসিংও নেই। যত্রতত্র মানুষ সড়ক পার হয়। এমন অবস্থায় হর্ন ছাড়া বাস চালানো প্রায় অসম্ভব।- বাসচালক মোস্তাক

সম্প্রতি সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে কাউকে এ নিয়ম মানতে দেখা যায়নি। যে যেভাবে পারছেন প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে হর্ন বাজিয়েই চলছেন। বাস-মোটরসাইকেল হর্ন বাজানোয় এগিয়ে। তবে কত মাত্রায় তারা হর্ন বাজাচ্ছেন তা নির্ণয় করা কিংবা তদারকি করার কাউকেও দেখা যায়নি। হর্ন যে মাত্রাতিরিক্ত শব্দ তৈরি করে বাজানো হচ্ছে সেটা যে কোনো মানুষ উপলব্ধি করবে। যানজটে গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকলেও হর্ন বাজাতে দেখা যায়।

স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, নীরব এলাকা কর্মসূচি উদ্বোধনের পর থেকে এখন পর্যন্ত শব্দদূষণের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই কারণে-অকারণে হর্ন বাজিয়ে চলছেন চালকরা। তাই আইনের প্রয়োগ ছাড়া এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন ‘নীরব’ সচিবালয় এলাকায় শব্দ দূষণ বেড়েছে ৭ দশমিক ৮ শতাংশ নামেই ‘নীরব এলাকা’, ক্রমাগত বাজছে অতিমাত্রার হর্ন শাহজালাল বিমানবন্দরের দেড় কিলোমিটার ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা চট্টগ্রামে ‘নীরব’ এলাকায়ও মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ

তবে যানবাহন চালকদের দাবি, ঢাকা শহরে সড়কে হর্ন ছাড়া যানবাহন চালানো সম্ভব নয়। কারণ, সড়কে পথচারীরা ট্রাফিক শৃঙ্খলা মানেন না। আবার সড়কের কোথাও জেব্রা ক্রসিং বা ট্রাফিক সিগন্যাল নেই। ফলে যত্রতত্র সড়ক পার হন পথচারীরা। এমন পরিস্থিতিতে হর্ন না দিলে দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।

Advertisement

অথচ গত ১ অক্টোবর বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) সামনে ‘নীরব এলাকা’ কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, গাড়িতে হর্ন বাজানো আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস। তাই হুট করে হর্ন না বাজানো কঠিন। প্রথম এক সপ্তাহ আমরা এই এলাকায় নীরব এলাকার কর্মসূচি পরিচালনা করবো, কারণ বিদেশ থেকে যখন কেউ এসে নামে তার কানে এই হর্নের শব্দ বাজে। তাই আমরা প্রথমে এই এলাকাকে বেছে নিয়েছি।

সরেজমিনে যা পাওয়া গেলো

বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, উত্তরার স্কলাস্টিকা এলাকার ফুটপাতের ওপর একটি স্টিলের খুঁটিতে টাঙানো বোর্ডে লেখা ‘নীরব এলাকা শুরু: ঢাকা সড়ক বিভাগ’। একইভাবে দক্ষিণে লা মেরিডিয়ান পয়েন্টের সামনে নীরব এলাকা শুরু লেখা বিভিন্ন বোর্ড রয়েছে। কিন্তু এ সড়কের কোথাও হর্ন ছাড়া গাড়ি চলতে দেখা যায়নি। এর মধ্যে শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রবেশপথে বেশি হর্ন বাজাতে দেখা যায়। সেখানে হর্ন বাজানো নিয়ন্ত্রণে সরকারের কাউকে তদারকি করতে দেখা যায়নি।

উবার অ্যাপসে আবদুল্লাপুর থেকে যাত্রী নিয়ে বিমানবন্দর রেলস্টেশনের সামনে যান মোটরসাইকেল চালক আবির হোসেন। যাত্রী নামানোর আগে তিনিও পরপর তিনবার হর্ন বাজান। হর্ন বাজানোর কারণ জানতে চাইলে আবির হোসেন বলেন, সেখানে যাত্রী নামাবো, ঠিক সামনে অটোরিকশা দাঁড়িয়ে ছিল। অথচ প্রধান সড়কে রিকশা থাকার কথা নয়। আর হর্ন না দিলে চালকও রিকশা সরিয়ে নিতো না।

আজিমপুর থেকে আব্দুল্লাপুরে যাত্রী পরিবহন করে ভিআইপি ২৭ পরিবহন। বিমানবন্দর স্টেশনে যাত্রী নামানোর সময় এক মিনিটে অন্তত চারবার হর্ন বাজিয়েছেন চালক মোস্তাক। জানতে চাইলে চালক বলেন, ঢাকা শহরে কেউ ট্রাফিক মানে না। সড়কে ট্রাফিক সিগন্যাল, জেব্রা ক্রসিংও নেই। যত্রতত্র মানুষ সড়ক পার হয়। এমন অবস্থায় হর্ন ছাড়া বাস চালানো প্রায় অসম্ভব।

তবে শব্দদূষণ বন্ধে আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই। তাই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় সংশোধন আনা হচ্ছে। এ আইনে ট্রাফিক পুলিশকে শব্দদূষণ রোধে মামলা বা জরিমানার দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে শুনেছি।- গ্রিন ভয়েসের সমন্বয়ক আলমগীর কবির

তবে বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর শিক্ষা ভবনের সামনে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। সেখানে পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিন ভয়েসের সদস্যদের ‘শব্দদূষণ’ বন্ধে প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। এসব প্ল্যাকার্ডে লেখা ‘আপনার হর্ন, আপনাকেই বধির করছে; পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় ‘হর্ন বাজানো নিষেধ’। তাদের এমন কর্মসূচি চলাকালে চালকদের অনেকেই হর্ন বাজাননি। তবে প্রেস ক্লাব, উচ্চ আদালতের সামনের সড়কে যানবাহন চালকদের হর্ন বাজাতে দেখা যায়। গ্রিন ভয়েসের সদস্যদের ভাষ্য, ‘যানবাহন চালকরা যেন তাদের কোনো কথাই শুনছেন না।’

জানতে চাইলে গ্রিন ভয়েসের সমন্বয়ক আলমগীর কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিমানবন্দর এলাকা ‘নীরব’ ঘোষণার পর টানা কয়েক দিন সচেতনতামূলক কর্মসূচি পালন করা হয়েছিল। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মনিটরিংয়ের অভাবে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। এখন (গত ২০ ফেব্রুয়ারি) আমরা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সচিবালয় ও আগারগাঁও এলাকায় শব্দদূষণ বন্ধে কাজ করছি। ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এ কর্মসূচি চলছে। তারপর সাতদিনের এ অভিজ্ঞতা যাচাই করবো। এ অভিজ্ঞতার আলোকে গুলশান, বনানী এলাকায় একই কর্মসূচি পালন করা হবে।’

তিনি বলেন, ‘তবে শব্দদূষণ বন্ধে আইন প্রয়োগের বিকল্প নেই। তাই শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালায় সংশোধন আনা হচ্ছে। এ আইনে ট্রাফিক পুলিশকে শব্দদূষণ রোধে মামলা বা জরিমানার দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে শুনেছি।’

সড়কে শব্দদূষণের অনেকাংশ দায় পরিবহন চালকদের। এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘শাহজালাল বিমানবন্দর এলাকায় হর্ন না বাজাতে ওই রুটে চলা সব বাস মালিক এবং চালককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। অনেক বাসচালক নিয়ম মেনেই সেখানে গাড়ি চালাচ্ছেন। একইভাবে শহরের অন্য এলাকায় যাতে অকারণে হর্ন না বাজান, সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আশা করি ক্রমান্বয়ে হর্ন কমে আসবে।’

বিদ্যমান আইনে যা আছে

শব্দদূষণ বিধিমালা-২০০৬ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় রাত ৯টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত শব্দের মাত্রা ৪৫ ডেসিবেল এবং দিনের অন্য সময় ৫৫ ডেসিবেল অতিক্রম করতে পারবে না। বাণিজ্যিক এলাকায় তা যথাক্রমে ৬০ ও ৭০ ডেসিবেল। হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালতের আশপাশে ১০০ মিটার পর্যন্ত নীরব এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা রয়েছে। সেখানে রাতে ৪০ ও দিনে ৫০ ডেসিবেল শব্দমাত্রা নির্ধারিত।

এ আইনে শাস্তি হিসেবে বলা আছে, আইন অমান্য করলে প্রথমবার অপরাধের জন্য এক মাস কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড এবং পরবর্তী অপরাধের জন্য ছয় মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার বিধান রয়েছে।

যা বলছে গবেষণা

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) একটি গবেষণায় দেখা যায়, নীরব এলাকার কোনোটিতেই আইন অনুযায়ী ‘নীরব এলাকা’ বাস্তবায়ন হয়নি। সবগুলোতেই শব্দের মাত্রা বেশি পাওয়া গেছে। গবেষণায় দেখা যায়, নীরব এলাকা সচিবালয়ের ১২টি লোকেশনে শব্দের মাত্রা গড়ে ৭৯ দশমিক ৫ ডেসিবেল। জাতীয় সংসদ এলাকায় ৭১ দশমিক ৮৬ ডেসিবেল, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এলাকায় ৭৫ দশমিক ৫৮ ডেসিবেল ও আগারগাঁও এলাকায় ৭২ দশমিক ৮৬ ডেসিবেল।

পরিবেশবাদী সংগঠন পরিজারের এক গবেষণায় দেখা যায়, আগে নীরব এলাকায় দিনে ৮৪ দশমিক ৫ থেকে ১০১ দশমিক ৭ ডেসিবেল এবং রাতে ৯৬ দশমিক ৪ থেকে ১০১ দশমিক ৫ ডেসিবেল শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে। আবাসিক এলাকায় শব্দের মাত্রা পাওয়া গেছে দিনে ৮২ থেকে ৯১ ডেসিবেল এবং রাতে ৮৩ থেকে ৯১ দশমিক ৬ ডেসিবেল।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র ক্যাপসের চেয়ারম্যান ও স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমাদের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা শৃঙ্খলা না ফিরলে শব্দদূষণ রোধ সম্ভব হবে না। হাতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে অটোমেটিক ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শুরু করতে হবে। এছাড়াও যানবাহন চালকদের সচেতনতার পর্যাপ্ত অভাব রয়েছে। তাদের আচরণে সমস্যা বেশি। কেউ একজন রাস্তা পার হলো, চালক সঙ্গে সঙ্গে হর্ন দেওয়া শুরু করে। ড্রাইভারদের ধৈর্য অনেক কম। এটা নিয়ে কাজ করতে হবে। যানজট দূর করতে হবে, এটাও অন্যতম বড় একটি সমস্যা। যানজট দূর করে একটি সুশৃঙ্খল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে শব্দদূষণ রোধ সম্ভব।

এমএমএ/এএসএ/এএসএম