রাজধানী ঢাকার বনশ্রী এলাকায় চাঞ্চল্যকর সোনা ছিনতাইয়ের ঘটনার পেরিয়েছে ১০ দিন। এখনো ঘটনার কোনো কূল-কিনারা করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। রাত ১০টার পর স্বর্ণ ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনকে গুলি করে ১৬০ ভরি সোনা ছিনিয়ে নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত তিনটি মোটরসাইকেলই ছিল নম্বরপ্লেটহীন। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে ছিনতাইকারীদের চেহারাও স্পষ্ট নয়।
Advertisement
সিসিটিভি ফুটেজে ছিনতাইয়ে অংশ নেওয়া সাতজনের কারও চেহারা বোঝা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে পুলিশ। এরই মধ্যে প্রায় দুই শতাধিক ফুটেজ বিশ্লেষণ করেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা। এছাড়া যে তিনটি মোটরসাইকেলে এসেছিল ছিনতাইকারীরা, তার কোনোটিতেই ছিল না নম্বর প্লেট। পুলিশ বলছে, পূর্বপরিকল্পনা করে অনেক হিসাব-নিকাশের পরই স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করে ১৬০ ভরি সোনা নিয়ে যায় তারা।
অনেকগুলো ফুটেজ নিয়ে আমরা যাচাই-বাছাই করছি। তদন্তের স্বার্থে এখনই বেশি কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। আশা করি শিগগির এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা হবে।-গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আ স ম শামসুর রহমান ভূঁঞা
ফুটেজে দেখা যায়, ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীর চিৎকারে এগিয়ে আসেননি স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা। আশপাশের ভবন এবং সড়কে থাকা ব্যক্তিরা শুধু ভিডিও ও ছবি তুলেছেন। গলির গেটও ছিল খোলা। গেট পেরিয়ে রামপুরা-বনশ্রীর মূল সড়ক দিয়ে ডেমরা রোড হয়ে নির্বিঘ্নে ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় পেশাদার ছিনতাইকারীরা।
Advertisement
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ঘটনায় ঘটনাস্থলে সাতজনকে দেখা গেছে। ছিনতাইয়ে জড়িতরা পেশাদার ছিনতাইকারী। তারা আগেই রেকি করেছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এখন পর্যন্ত সন্দেহভাজন একজন ছাড়া সরাসরি জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। এ ঘটনায় নিরাপত্তার স্বার্থে ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাসার দারোয়ানকে হেফাজতে নেয় রামপুরা থানা পুলিশ।
চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় ডিবি পুলিশ ছায়া তদন্ত করছে। একাধিক টিম কাজ করছে। এখন পর্যন্ত আমরা কাউকে গ্রেফতার করতে পারিনি। তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করি শিগগির সুখবর পাবেন।- ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে বনশ্রী ডি ব্লকে ৭ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে স্বর্ণ ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনকে (৪৩) গুলি ও ছুরিকাঘাত করে সোনা এবং নগদ এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। রাত ১২টার দিকে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়।
Advertisement
ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। এরপর জনমনে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। দেশে চলমান ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতির ঘটনার মধ্যে আরও সমালোচনায় পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটিতে দেখা যায়, তিনটি মোটরসাইকেলে করে মোট সাতজন ছিনতাইকারী ওই ব্যবসায়ীকে ঘিরে ধরে। ব্যবসায়ীকে একটি বাড়ির গেটের সামনের রাস্তায় ফেলে দিয়ে একজন ছিনতাইকারী তার কাছ থেকে একটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। আরেকজন ছুরি দিয়ে আঘাত করে যাচ্ছিল। ওই সময় ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মাগো মাগো করে চিৎকার করছিলেন। ব্যাগ ছিনিয়ে নিতে বাধা দিলে ভুক্তভোগীকে পাশে দাঁড়ানো আরেকজন কয়েক রাউন্ড গুলি ছোড়ে। ওই সময় ভুক্তভোগী আরও জোরে চিৎকার দিতে দিতে ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে কিছুটা দৌড়ে পিছনের দিকে সরে যান।
এ ঘটনার পর থেকে থানা পুলিশের পাশাপাশি, গোয়েন্দা পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন পর্যন্ত আমিনুল ইসলাম কামরুল (৪৫) নামে সন্দেহভাজন এক যুবককে গ্রেফতার করেছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।- রামপুরা থানার ওসি মোহাম্মদ আতাউর রহমান আকন্দ
আরও দেখা যায়, দুর্ধর্ষ এ ছিনতাইয়ের ঘটনাটি পাশে থাকা ভবনের বিভিন্ন ফ্লোর থেকে স্থানীয় বাসিন্দারা ভিডিও করছিলেন। ছিনতাইকারীরা যখন ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীকে ছুরি দিয়ে আঘাত করছিলেন এবং গুলি ছুড়ছিলেন তখন ভিডিও করা লোকজনও জোরে জোরে চিৎকার করছিলেন। এরই মধ্যে পাশ থেকে আরেকজন নারীর চিৎকার শোনা যায়। তিনিও মাগো মাগো করে করে চিৎকার করছিলেন। পরে ছিনতাইকারীরা ব্যবসায়ীর ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে ঘটনাস্থল থেকে দ্রুত তিনটি মোটরসাইকেলে করে চলে যান।
ওই ঘটনায় সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী হোসনে আরা বাদী হয়ে রামপুরা থানায় ডাকাতির অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাত পরিচয় আটজনকে আসামি করা হয়েছে। ১৬০ ভরি সোনা ও এক লাখ টাকা খোয়া যাওয়ার তথ্য মামলায় তুলে ধরা হয়। পরে সাংবাদিকদের বাড়ির মালিক ও দারোয়ানের বিরুদ্ধে সেদিন রাতে অসযোগিতার অভিযোগ তোলেন এই নারী।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, গলির সামনে ও পেছনে বিশাল গেট। ঘটনার আকস্মিকতায় ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী চিৎকারও করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শীও ছিল। কেউ এগিয়ে আসেননি। গেট দুটো বন্ধ করে দিলেই আর কেউ বের হতে পারতেন না। সেটা কেউ করেনি। খোলা গেট দিয়ে নির্বিঘ্নে পালিয়ে যায় ছিনতাইকারীরা।
তিনি বলেন, বনশ্রী এলাকার পাশেই দুটি বড় হাইওয়ে। পালানোর রুট খুঁজতে গিয়ে আমরা সিসি ক্যামেরা ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখেছি, তিনটি মোটরসাইকেলযোগে খোলা গেট পেরিয়ে রামপুরা-বনশ্রীর মূল সড়কে ওঠে ছিনতাইকারীরা। এরপর কয়েক সেকেন্ড বিরতি নিয়ে ইউটার্ন করে ডেমরা রোড হয়ে নির্বিঘ্নে ঢাকা ত্যাগ করে।
জানতে চাইলে গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) আ স ম শামসুর রহমান ভূঁঞা জাগো নিউজকে বলেন, ‘অনেকগুলো ফুটেজ নিয়ে আমরা যাচাই-বাছাই করছি। তদন্তের স্বার্থে এখনই বেশি কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। আশা করি শিগগির এ ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ‘চাঞ্চল্যকর এ ঘটনায় ডিবি পুলিশ ছায়া তদন্ত করছে। একাধিক টিম কাজ করছে। এখন পর্যন্ত আমরা কাউকে গ্রেফতার করতে পারিনি। তবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। আশা করি শিগগির সুখবর পাবেন।’
রামপুরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আতাউর রহমান আকন্দ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ঘটনার পর থেকে থানা পুলিশের পাশাপাশি, গোয়েন্দা পুলিশসহ অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা এখন পর্যন্ত আমিনুল ইসলাম কামরুল (৪৫) নামে সন্দেহভাজন এক যুবককে গ্রেফতার করেছি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তিন মোটরসাইকেলের কোনোটির নম্বর প্লেট ছিল না। নম্বর প্লেট ছাড়া তারা পরিকল্পনা করেই এ কাজ করতে এসেছিল।’
এর আগে ব্যবসায়ী আনোয়ার হোসেনের প্রাণনাশের চেষ্টা ও সোনা লুটের ঘটনায় কাউকে শনাক্ত বা গ্রেফতার করতে না পারায় বিক্ষুব্ধ হয়ে গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বনশ্রী সড়ক ও রামপুরা থানার সামনে বিক্ষোভ করেন এলাকার সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা। বিক্ষোভকারীদের দাবি, পুলিশ নীরব ভূমিকা পালন করছে। জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ পুলিশ।
টিটি/এএসএ/জিকেএস