নেত্রকোনায় ৯ উপজেলায় অন্তত ৩৯টি ইটভাটা চালু রয়েছে। এর মধ্যে ৩৩টি ভাটাই আইন লঙ্ঘন করে চালু রয়েছে। এসব অবৈধ ভাটা বেশিরভাগ কৃষি জমিতে, আবাসিক এলাকায়, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সড়ক ও রেলপথের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে। ভাটায় ফসলি জমির উপরিভাগের মাটি দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে ইট। মাঝেমধ্যে ঢিলেঢালা অভিযানে চলে অবৈধ ইটের ভাটা।
Advertisement
এদিকে রোববার দুটি অবৈধ ইটভাটায় অভিযান চালানো হয়। এসময় ওই ইটভাটার চুল্লি ও কিলন ভেঙে দেয়াসহ বেশ কিছু ইট গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। রোববার বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর নেত্রকোনা জেলা কার্যালয় যৌথভাবে অভিযান চালায়।
ভেঙে দেওয়া ইটভাটাগুলো হলো, সদর উপজেলার মৌজেবালি এলাকায় ‘এমএইচসি ব্রিকস’ এবং কেন্দুয়া উপজেলার আশুজিয়া এলাকায় ‘সানি ব্রিকস’। এরমধ্যে সদর উপজেলায় অভিযানের নেতৃত্ব দেন সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. হাসিব-উল-আহসান। আর কেন্দুয়ায় অভিযানে নেতৃত্ব দেন সহকারী কমিশনার আমেনা খাতুন।
পরিবেশ অধিদপ্তর নেত্রকোনা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মতিন জানান, রোববার অবৈধভাবে চলু রাখা ওই দুটি ইটভাটায় অভিযান চালিয়ে বিপুল সংখ্যক কাচা ও পোরানো ইট ভেঙে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভাটা দুটির চুল্লি এবং কিলন আংশিক ভেঙে দেওয়া হয়। অভিযানে সেনাবাহিনী সদস্য, বিজিবি, পুলিশ ও ফায়ারসার্ভিসের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন বলে জানান তিনি।
Advertisement
সহকারী পরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মতিন বলেন, তিন সপ্তাহে জেলায় ‘এমপিবি কোং ব্রিকস’ ‘পিএমআর ব্রিকস’ ‘পিসিবি ব্রিকস’ ‘সৃজন ব্রিকস’সহ অন্তত ৯টি অবৈধভাবে চালু রাখা ইটভাটায় অভিযান চালানো হয়। এরমধ্যে চারটি ইটভাটার চুল্লি ও কিলন ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৮ লাখ ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
ভাটাগুলোর লাইসেন্স ও পরিবেশ ছাড়পত্র না থাকায় বন্ধে আদালতের নির্দেশনা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতেও দেখা যাচ্ছে না প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে। এতে ঝুঁকিতে রয়েছে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য।
পরিবেশ অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় ও প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, অবৈধভাবে কার্যক্রম চালু থাকা ইটভাটাগুলোর মধ্যে সদর উপজেলায় ৬, বারহাট্টায় ২, কলমাকান্দায় ৬, দুর্গাপুরে ১, কেন্দুয়ায় ১০, আটপাড়ায় ২, মদনে ১, মোহনগঞ্জে ২ ও পূর্বধলায় ৩টি।
এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে ২০২২ সালে নেত্রকোনা পরিবেশ অধিদপ্তরে তৎকালীন পরিদর্শক সুশীল কুমার দাস বাদী হয়ে নেত্রকোনা স্পেশাল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। আদালতের বিচারক ভাটাগুলোকে বিভিন্ন অঙ্কে জরিমানাসহ ওই বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে আইনসম্মত ও পরিবেশসম্মত স্থানে সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দেন। এ ছাড়া ইটভাটাগুলো ধ্বংসের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর নেত্রকোনা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালকে নির্দেশ দেন।
Advertisement
এ নির্দেশের বিরুদ্ধে পূর্বধলার বকুল ব্রিকস, কেন্দুয়ার হিমালয় ব্রিকসসহ কয়েকটি ভাটা পরিবেশ আদালতে আপিল করলেও পরিবেশ আদালত তা খারিজ করে দেন। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তর আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়ন করতে পারেনি। অন্যান্য বছর কিছু ভাটার অভিযান চালালেও এবার পরিবেশ অধিদপ্তর ও প্রশাসন নিরব ভূমিকা পালন করছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পূর্বধলায় শ্যামগঞ্জ-বিরিশিরি সড়কসংলগ্ন ডেউটুকোন এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে তোলা ইটাভাটায় ইটপোড়ানো হচ্ছে। কলমাকান্দা-ঠাকুরাকোনা সড়কের পাশে ও গুমাই নদীর তীরে হিরাকান্দা এলাকায় ‘পিসিবি ব্রিকস’ নামের ইটভাটায় ইটপোড়ানো হচ্ছে। ভাটার পাশে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
কলমাকান্দার উপজেলার ভাটাসংলগ্ন গুমাই বাজারের একজন ব্যবসায়ী বলেন, সাংবাদিকেরা ছবি তোলেন, পত্রিকায় লেখেন; কিন্তু কোনো লাভ হয় না। অবৈধ ইটভাটাটির ধোঁয়ার গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যায়। গাছগাছালির ফল পর্যন্ত ঝড়ে যায়। মাত্র কয়েক শ’ গজ দূরে পনারপারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। রাস্তা, বাজার, ঘরবাড়ি, নদী, ফসলি জমি সবকিছুর ক্ষতি হচ্ছে। এরপরও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
নেত্রকোনা-মোহনগঞ্জ রেলপথের কাছে অন্তত চারটি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনায় সড়ক ও রেলপথ–সংলগ্ন মেসার্স এমআরএস ব্রিকসের মালিক খোকন চন্দ্র সিংহ। বারহাট্টা উপজেলার পাটলি গ্রামে রেলপথ ও প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘেঁষে আরএমবি ব্রিকসের মালিক আবুল খায়ের আকন্দ। তাদের দাবি, ইটভাটা স্থাপনের সময় পরিবেশ অধিদপ্তর ছাড়পত্র দিয়েছে। ছাড়পত্র না দিলে ইটভাটা স্থাপন করতে পারতেন না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন ইটভাটার মালিক জানান, প্রতিবছর কাস্টমস অধিদপ্তরকে ভ্যাট ছাড়াও উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের আলাদা আলাদা বখরা দিতে হয়। কেন্দুয়ার একটি ইটভাটার মালিক বলেন, সব দপ্তর মিলিয়ে প্রায় সাত লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। তবু প্রশাসনের জড়িমানা তো আছেই।
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক বানানী বিশ্বাস বলেন, অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রোববার একটি ইটভাটা মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এইচ এম কামাল/আরএইচ/এমএস