খেলাধুলা

‘মোহামেডান-আবাহনীকে লিগে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেবো’

এক সময় জমজমাট ছিল দেশের অন্যতম জনপ্রিয় খেলা ভলিবল। এই খেলা দেখতে দর্শক জমায়েত হতো। স্বাধীনতার পর মোহামেডান, ওয়ারি, ভিক্টোরিয়া, ওয়াপদা, ভালো দল গড়তো। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতো দল গড়তো তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসও। নারী লিগে একবার অংশ নিয়েছিল আবাহনীও।

Advertisement

দেশের দুই জনপ্রিয় ক্লাব মোহামেডান এবং আবাহনী এখন ভলিবলসহ অনেক খেলা থেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের নতুন অ্যাডহক কমিটি আবার লিগে মোহামেডান ও আবাহনীর মতো দর্শকপ্রিয় ক্লাবকে ফিরিয়ে আনতে চায়।

নতুন অ্যাডহক কমিটির সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হয়েছেন জাতীয় দলের সাবেক খেলোয়ায়াড় বিমল ঘোষ ভুলু। দেশের ভলিবলের উন্নতি, ঘরোয়া প্রতিযোগিতা বাড়ানো এবং জাতীয় দলকে প্রয়োজনীয় ট্রেনিং করিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে সাফল্য আনার পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জাগো নিউজকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দিয়েছেন নতুন সাধারণ সম্পাদক বিমল ঘোষ ভুলু।

জাগো নিউজ: এক সময় জাতীয় দলের হয়ে দাপটের সঙ্গে খেলেছেন। এখন সরকার আপনাকে দেশের ভলিবল পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছেন। এ প্রজন্মের অনেকেই আপনার সম্পর্কে সেভাবে জানে না। যদি খেলোয়াড়ী জীবন নিয়ে সংক্ষিপ্ত করে কিছু বলতেন।

Advertisement

বিমল ঘোষ ভুলু: আমি ১৯৭৩ সালে ভলিবল খেলা শুরু করেছিলাম। ঢাকায় খেলেছি ১৯৭৪ থেকে । প্রথমে খেলেছিলাম মিতালি সংঘ নামের একটি ক্লাবে। সেটা ওয়াপদারই একটা টিম ছিল। তারপর চলে যাই ভিক্টোরিয়াতে। ওই বছরই লাবুস্কাস নামের একজন জাপানি কোচ আনা হয়েছিল জাতীয় দল গঠণের জন্য।

আমি জাতীয় দলের ট্রায়ালে সুযোগ পেয়েছিলাম। পরে ২৪ জনের দল তৈরি হয়েছিল। আমি ওই দলেও টিকে যাই। ১৯৭৮ সালে প্রথম বাংলাদেশ গেমস হয়। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। ওয়াপদায় চাকরি করতাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দলে খেলার জন্য আমাকে চাকরি ছাড়তে হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বাংলাদেশ গেমস ভলিবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। আমি ছিলাম ওই দলের অধিনায়ক।

জাগো নিউজ: জাতীয় দলে কবে থেকে কতদিন খেলেছিলেন?

বিমল ঘোষ ভুলু: আমি ১৯৭৮ সালেই জাতীয় দলে সুযোগ পাই। ব্যাংকক এশিয়ান গেমসের দলেও ছিলাম। ১৯৯২ সাল পর্যন্ত খেলেছি লাল-সবুজ জার্সিতে। পরে মেট্রোপলিশ লিগ খেলা শুরু করি। ওয়াপদা আমাকে আবার দলে নেয়। কয়েক বছর ওয়াপদায় খেলি এবং নিয়মিত চ্যাম্পিয়ন হই আমরা। তারপর আমি চলে যাই ওয়ারিতে। অধিনায়ক হিসেবে ওয়ারিকেও চ্যাম্পিয়ন করিয়েছিলাম।

Advertisement

জাগো নিউজ: একটা দেশের খেলার উন্নয়নে উন্নতমানের কোচ অন্যতম শর্ত। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের ভলিবল কোচদের মান কেমন?

বিমল ঘোষ ভুলু: বাংলাদেশের কোচরা যে খারাপ সেটা বলা যাবে না। লেভেল ‘থ্রি’ কোর্স করা কোচও আছে আমাদের। তাদেরকেও আমরা ব্যবহার করি। তবে ভলিবলে একটা নিয়ম আছে, যখনই আন্তর্জাতিক খেলা আসে যখন জাতীয় দলে একজন বিদেশি কোচ রাখতেই হবে। তাই জাতীয় দলের জন্য আমাদের বিদেশি কোচ আনতে হয়। তাহলেই এফআইভি আমাদের র‌্যাংকিংয়ে রাখবে।

জাগো নিউজ: বিদেশি কোচ আনা যেহেতু বাধ্যতামূলক তাহলে আন্তর্জাতিক সংস্থা কি কোচের জন্য কোনো অনুদান দিয়ে থাকে?

বিমল ঘোষ ভুলু: আমরা যদি এফআইবি’র কোচ নিয়োগ দেই তাহলে তারা কিছু সাপোর্ট দিয়ে থাকে। প্রধানত আমরা নিজেদের তহবিল থেকেই কোচের বেতন দিয়ে থাকি।

জাগো নিউজ: ফেডারেশনের দায়িত্ব যখন নিয়েছেন তখন তহবিলে কি পরিমাণ অর্থ ছিল? সেগুলো কি আপনাদেরকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে?

বিমল ঘোষ ভুলু: আগের কমিটির কাছ থেকে আমরা দায়িত্ব বুঝে নিয়েছি। আগের কমিটির করা এফডিআর আছে ২ কোটি টাকার ওপরে। এছাড়া নগদ আছে ৬৫ লাখ টাকার মতো। বল, নেটসহ অন্য যেসব জিনিস ছিল আমরা বুঝে পেয়েছি।

জাগো নিউজ: বিগত দিনে ফেডারেশনে কোনো অনিয়ম হয়েছে কিনা সেটা কি খতিয়ে দেখবেন আপনারা?

বিমল ঘোষ ভুলু: বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশন ২০২৪ সালের অডিট জমা দিয়েছে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে। আমরা অনিয়মের বিষয়ে কিছু শুনিনি। তবে, আমরা যদি আভ্যন্তরীণ অডিটটা করতে পারি তাহলে বেরিয়ে আসবে এখানে কি হয়েছিল। আমাদের কিছু সময় লাগবে কোনো অনিয়ম থাকলে তা খুঁজে বের করতে।

জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক ভলিবল অঙ্গনে এখন বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?

বিমল ঘোষ ভুলু: এখন আমরা সেন্ট্রাল এশিয়ান জোনে ৭১ র‌্যাংকিংয়ে আছি। সেটা ভারতেরও ওপরে।

জাগো নিউজ: দক্ষিণ এশিয়ান গেমস ভলিবলে বাংলাদেশের অবস্থা খুবই খারাপ। গোটা দুই ব্রোঞ্জ আছে মাত্র। এই গেমস নিয়ে কি ভাবছেন?

বিমল ঘোষ ভুলু: আমরা যেহেতু দায়িত্বভার নিয়েছি, জাতীয় দলকে আরো শক্তিশালী করে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে আমরা যাতে স্বর্ণ আনতে পারি সে চেষ্টাই করবো।

জাগো নিউজ: আগের কমিটি ভলিবল উন্নয়নে কি কাজ করেছে এবং আর কি করা উচিত ছিল বলে আপনি মনে করেন?

বিমল ঘোষ ভুলু: ভলিবলের উন্নয়নের জন্য আগের কমিটি উদ্যোগ নিয়েছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। আমরাতো সাউথ ও সেন্ট্রাল এশিয়ায় একটা ভালো অবস্থানে আছি। এটা ঠিক, এই কার্যক্রম আরো বেগবান করতে পারতো আগের কমিটি। যেমন যুবাদের খেলাটা অনেকদিন হয় না। এটা নিয়মিত করা উচিত ছিল। কারণ, এই যুব টুর্নামেন্ট থেকেই পরবর্তী সময় জাতীয় দলে খেলোয়াড় সাপ্লাই হয়ে থাকে। আমি নিজেও কলেজ থেকে খেলে ঢাকায় এসেছিলাম।

জাগো নিউজ: বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের স্ট্যান্ডার্ড এখন কেমন? এশিয়ান লেভেলে আছেন কেউ?

বিমল ঘোষ ভুলু: আমাদের জাতীয় দলটা খুবই ভালো অবস্থানে আছে। তবে অনেকদিন খেলার মধ্যে নেই। তাদের ক্যাম্প যদি শুরু করা যায়, নিয়মিত প্রশিক্ষণ দেওয়া যায় তাহলে সাউথ এশিয়ান গেমসসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালো করার সম্ভাবনা আছে।

জাগো নিউজ: এক সময় ভলিবলের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। সেটা কমে গেছে। কেন এমন হলো বলে মনে করেন?

বিমল ঘোষ ভুলু: যে কোনো খেলাধুলার জন্য যুব সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। এখন আমাদের যুব সমাজের প্রত্যেকের হাতে মোবাইল ফোন আছে। আমাদের সময় মোবাইল ফোন ছিল না। হতে পারে এখন যুব সমাজ মোবাইলে আকৃষ্ট হয়ে গেছে। মাঠে খেলার চেয়ে ১০ জন নিয়ে বসে মোবাইলে আড্ডা দেয়।

জাগো নিউজ: ভলিবল তো এখনো স্কুল পর্যায়ে বিস্তার করা সম্ভব হয়নি। তাহলে যুব সমাজ এ খেলায় আকৃষ্ট হবে কি করে?

বিমল ঘোষ ভুলু: আগেই বলেছি, আমরা কিন্তু স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে খেলেই জাতীয় দলে সুযোগ পেয়েছিলাম। আমি দেখেছি, স্কুলের স্পোর্টস শিক্ষকরা সাধারণ পাঠদান করাচ্ছেন; কিন্তু খেলাধুলার বিষয়ে যাচ্ছে না। আগে যারা স্পোর্টস শিক্ষক ছিলেন তারা সারাদিন খেলাধুলার বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। এ বিষয়ে প্রশাসনকেই নজর দিতে হবে। কারণ, বাংলাদেশ ভলিবল ফেডারেশনের পক্ষে সম্ভব নয় ৬৪ জেলায় গিয়ে এগুলো দেখভাল করা।

জাগো নিউজ: এখন বাংলাদেশের কোন কোন জেলায় ভলিবলের চর্চা বেশি হচ্ছে?

বিমল ঘোষ ভুলু: ৬৪ জেলার মধ্যে অনেকেই কাউন্সিলরশিপ টিকিয়ে রাখার জন্য খেলে। তবে যদি তুলনামূলকভাবে ভালো ভলিবল হয় এমন জেলাগুলোর কথা বলি তাহলে আসবে টাঙ্গাইল, ঢাকা, পঞ্চগড়, নড়াইল, ঝিনাইদহ, বগুড়ার নাম। এসব জেলায় ভলিবল ভালো খেলা হয়। বিকেএসপি ভবিলকে ভালো সাপোর্ট করে। এই প্রতিষ্ঠানের অনেক খেলোয়াড় জাতীয় দলে আছে।

জাগো নিউজ: ভলিবল খেলোয়াড়দের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না করায়। এ বিষয়ে কি বলবেন আপনি?

বিমল ঘোষ ভুলু: আমি প্রথম থেকেই বলেছি, যাই কিছু করুন না কেন. খেলাধুলা চালাতে হলে অর্থের প্রয়োজন। আমাদের সভাপতি ও সহসভাপতি একজন আছেন ব্যবসায়ী। তাই আমি এই দুটি স্পন্সর পেয়েছি। আরো স্পন্সর আছে। তারা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলে খেলা ঠিকঠাকমতো এগিয়ে নেওয়া সম্ভব।

জাগো নিউজ: লম্বা একটা সময় ইরানের কোচ ছিল ভলিবলে। এখন বিদেশি কোচ নেই। নতুন বিদেশি কোচ কি আসবেন?

বিমল ঘোষ ভুলু: বিদেশি কোচ আসবেন। অবশ্যই আসবেন। বিদেশি কোচ তো আনতেই হবে। আমরা আলোচনা করছি, বিভিন্ন দেশে চিঠিও দিয়েছি। অচীরেই আমরা জানতে পারবো কোথা থেকে বিদেশি কোচ আনছি। আমাদের নজর আছে ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার দিকে।

জাগো নিউজ: আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন। এমন কি করতে চান যা চমকের মতো?

বিমল ঘোষ ভুলু: চমক বলতে একটাই যে, সারা বছর খেলা যদি চালাতে পারি। তারপরও গ্রাসরুট থেকে খেলোয়াড় সংগ্রহ করাই হবে আমার কাজ। ভলিবল এখন ঢাকা কেন্দ্রিক। এই খেলাকে আমরা দেশের আনাচে-কানাচে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করবো।

জাগো নিউজ: ভলিবলে এখন সার্ভিসেস দল বেশি। দেশের জনপ্রিয় ক্লাবগুলোকে ভলিবলে আনার কোনো পরিকল্পনা আছে কি?

বিমল ঘোষ ভুলু: অবশ্যই আছে। এরই মধ্যে প্রতিটি ক্লাবকে চিঠি দিয়েছি স্বাধীনতা কাপ খেলার জন্য। যে ক্লাবগুলো এখন আছে তাদের বলেছি অনুশীলন করতে। আমরা নতুন করে মোহামেডান ও আবাহনীর মতো জনপ্রিয় ক্লাবকে ভলিবলে আনতে চাচ্ছি। আমরা বসুন্ধরা কিংসকেও লিগে আনার চেষ্টা করবো। আমরা প্রতিটি ক্লাবে যাবো। সবার সাথে মত বিনিময় করবো। যাতে তারা ভলিবলে দল গঠণ করতে আগ্রহী হয়।

জাগো নিউজ: কবে নাগাদ এ বছরের লিগ শুরু হতে পারে?

বিমল ঘোষ ভুলু: স্বাধীনতা কাপটা আয়োজনের পর আমরা লিগ আয়োজনের কথা ভাববো। হয়তো এপ্রিল-মে মাসে লিগ শুরু হতে পারে।

জাগো নিউজ: তাহলে এই লিগে তো জনপ্রিয় ক্লাবের কোনটির অংশগ্রহণের সম্ভাবনা কম থাকবে তাই না?

বিমল ঘোষ ভুলু: সামনের লিগে সম্ভাবনা নেই। আমরা প্রথমে ক্লাবগুলোকে খেলাতে রাজী করানোর চেষ্টা করি। এবারের লিগে না হোক পরের লিগে অংশ নেবে। জনপ্রিয় ক্লাবগুলোর লিগে খেলাটাই হবে বিশাল এক অর্জন।

জাগো নিউজ : একজন তরুণ ভলিবল খেলবেন কেন? তাদের আকৃষ্ট করার জন্য কি পরিকল্পনা আছে আপনাদের?

বিমল ঘোষ ভুলু: সে জন্যই বলেছি লিগ খেলতে হবে। তখন প্রাইজমানির ব্যবস্থা করবো। লিগ যাতে চলমান থাকে, যাতে খেলোয়াড়রা কিছু টাকা-পয়সা পায় এবং নতুন নতুন খেলোয়াড় বেরিয়ে আসে এবং তাদের কর্মসংস্থান হয় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া হবে।

জাগো নিউজ: দায়িত্ব শেষে আপনি দেশের ভলিবলকে কোন অবস্থানে রেখে যেতে চান?

বিমল ঘোষ ভুলু: আমরা একটা রোডম্যাপ তৈরি করে দিয়ে যাবো, যেটা অনুসরণ করলে ভলিবলের উন্নয়ন হবে। সেটাই আশা করছি আমরা।

জাগো নিউজ: ধন্যবাদ।বিমল ঘোষ ভুলু: আপনাকেও ধন্যবাদ।

আরআই/আইএইচএস/