স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে এখনো রয়ে গেছেন পতিত সরকারের সুবিধাভোগীরা। পদায়ন, পদোন্নতি ও নানা সুবিধায় তাদের প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ড্যাব)। বিগত ১৭ বছর ধরে বঞ্চিতদের নিয়ে নেই কোনো উদ্যোগ। হাসপাতালগুলোতেও জুলাই বিপ্লবে আহতদের চিকিৎসা দেওয়ায় অনীহা ও বিরোধিতা করা চিকিৎসকরাও বহাল তবিয়তে রয়ে গেছেন বলে অভিযোগ। সম্প্রতি ‘ক্যাডার, প্রকল্প ও অ্যাডহক চিকিৎসকদের পদোন্নতি সংক্রান্ত সমাধানের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি’র বৈঠকের সিদ্ধান্ত নিয়ে অসন্তোষ জানিয়েছেন বিএনপিপন্থি চিকিৎসকরা। বিশেষ করে, ২০০০ সাল ও তার আগে যোগদানকারী বৈষম্যের শিকার চিকিৎসকদের পদোন্নতি ফাস্টট্র্যাক পদ্ধতিতে দেওয়ার সুপারিশ নিয়ে রয়েছে ক্ষোভ।
Advertisement
যেখানে একজন ফাঁসির আসামিরও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে, সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহতদের চিকিৎসা দিতে বাধা যারা দিয়েছে, তাদের জন্য শুধু বদলি কোনো শাস্তি হতে পারে না। এসব চিকিৎসকরা গুলি ছোড়া পুলিশের চেয়েও বড় অপরাধী।-ড্যাব ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল শাখার সভাপতি ডা. রেজওয়ানুর রহমান সোহেল
১৪ জানুয়ারি ২০২৫ তারিখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সারা দেশে কর্মরত দুই হাজার ৩৪৬ জন চিকিৎসকের বিদ্যমান সমস্যার সমাধান ও পদোন্নতির জন্য আলোচনা হয়। স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিব সারোয়ার বারীর সভাপতিত্বে ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, বঞ্চিত চিকিৎসকদের তালিকা প্রস্তুত করে পদোন্নতির সুপারিশ করার। পাশাপাশি যারা ২০০০ সাল বা তার আগে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন তাদের ফাস্টট্র্যাক পদোন্নতির ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। বিএনপিপন্থি চিকিৎসকরা বলছেন, এটা কেন ২০০০ সাল হবে? ২০০৫ কেন হবে না? অথবা সাল তুলে দিয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে হওয়া তো বেশি যুক্তিযুক্ত। ২০০০ সাল ও এর আগে শব্দ উল্লেখ করায় এতে আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরাও উঠে আসবেন। অথচ ২০০৫ হলে বিএনপি-জামায়াতপন্থিরাও ফাস্টট্র্যাকে পদোন্নতির আওতায় আসবে। আর বছর তুলে দিয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে দিলে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়। এর বাইরেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাদের চাকরির মেয়াদ দুই-তিন মাস আছে, তাদের চলতি দায়িত্বে দিয়ে পদোন্নতি দেবে। কিন্তু এ তালিকায় ঢুকে পড়েছেন ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি। অথচ তিনি এ ক্যাটাগরিতে পড়েনও না। সিলেট মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মুজতাহিদ মোহাম্মদ হোসেন ১৬ ফেব্রুয়ারি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান। তার চাকরির বয়স এখনো ১৪/১৫ বছর আছে।
২০০০ পর্যন্ত চাকরিপ্রাপ্তদের ফাস্টট্র্যাকে পদোন্নতির সিদ্ধান্তটিও বৈষম্যমূলক। এতে আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদেরই সুবিধা হবে। আমরা বলেছিলাম, ২০০৫ পর্যন্ত করতে, তাতে বিএনপির আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরাও আসবে। দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের এসব সিদ্ধান্ত স্বৈরাচারের দোসরদের পক্ষে যাচ্ছে। আমরা এটার তীব্র নিন্দা করি।- ড্যাবের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ
Advertisement
রেহান উদ্দিন নামে একজনও পদোন্নতি পেয়েছেন, যার চাকরির বয়স ১০ বছরের বেশি সময় আছে। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রদল করলেও গত ১৬ বছর স্বাচিপের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলেছেন বলে অভিযোগ আছে।
হাতে হাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ২৭ জনের তালিকাসম্প্রতি ফ্যাসিবাদের দোসর ও শান্তি মিছিলে অংশগ্রহণকারী ২৭ জনের একটি তালিকা করেছেন ফ্যাসিবাদবিরোধী চিকিৎসকরা। তাদের দাবি, এসব দোসরদের শিগগির স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে অপসারণ করতে হবে।
আরও পড়ুন আন্দোলনের মুখে দায়িত্ব পালনে অপারগ নিউরোসায়েন্সের পরিচালক জুলাই বিপ্লবে চক্ষু হাসপাতালের তিন লড়াকু চিকিৎসক কেউ ফেরেন হাসিমুখে, কেউ কাঁদতে কাঁদতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৩ শতাংশ বৃদ্ধি করেছিল বিএমডিসিতালিকায় নাম থাকা ২৭ জন হলেন- রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন, পরিচালক (প্ল্যানিং) ও লাইন ডাইরেক্টর (পিএমআর) ডা. আফরিনা মাহমুদ, পরিচালক (হাসপাতাল) ডা. আবু হোসাইন মো. মঈনুল আহসান, ঢাকা বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. জাহাঙ্গীর আলম, পরিচালক (এইডস/এসটিডি) ডা. মো. খাইরুজ্জামান, লাইন ডাইরেক্টর (এনএনএম) ডা. আনজুমানারা সুলতানা, লাইন ডাইরেক্টর (সিবিএইচসি) ডা. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, লাইন ডাইরেক্টর (এমএনসি অ্যান্ড এএইচ) ডা. এসএম আব্দুল্লাহ আল মুরাদ, উপ-পরিচালক (শৃঙ্খলা) ডা. এবিএমডি সামসুজ্জামান, উপপরিচালক (সিডিসি) ডা. আশরাফুন নাহার, উপ পরিচালক (জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠান) ডা. রওশন আক্তার জাহান, প্রোগ্রাম ম্যানেজার (এনএনএইচপি অ্যান্ড আইএমসিআই) ডা. মো. জহুরুল ইসলাম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ইপিআই) ডা. আবুল ফজল মো. সাহাবুদ্দিন খান, প্রোগ্রাম ম্যানেজার-২ (এনসিডিসি) ডা. এস এম মোস্তাফিজুর রহমান, প্রোগ্রাম ম্যানেজার (এইচএসএম) ডা. সুপ্রিয়া সরকার, প্রোগ্রাম ম্যানেজার (অ্যাডমিন ও অর্থ) ইউএইচসি ডা. তাসলিমা আনাম, ডিপিএম (অ্যাডমিন ও অর্থ, টিবি লেপ্রুসি) ডা. মুহাম্মদ আব্দুল হাদী খান, ডিপিএম-৫ (এনসিডিসি) ডা. নুসার চৌধুরী, ডিপিএম-১ (এনসিডিসি) ডা. রাহাত ইকবাল চৌধুরী, ডিপিএম (জেনেটিক ডিজিজ, সিডিসি) ডা. এসএম গোলাম কায়সার, ডিপিএম (উপজেলা হেলথ সার্ভিস স্ট্রাথিং অ্যান্ড রেফারেল সিস্টেম) ডা. আশিকুর রহমান, ডিপিএম (অ্যাডমিন ও অর্থ, মেডিকেল এডুকেশন) ডা. রাজিব আল আমিন, ডিপিএম ও সহকারী পরিচালক-সিবিএইচসি (প্রকিউরমেন্ট ও লজিস্টিক) ডা. আসিফ মাহমুদ, ডিপিএম (লজিস্টিক-অর্থ-এএমসি) ডা. ফাইজা মোকাররম, ডিপিএম-১ (এনএনএস) ডা. সুপ্তা চৌধুরী, সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার (আইইপিসিআর) ডা. সাব্বির হায়দার এবং ডিপিএম (ম্যালেরিয়া অ্যান্ড এডিস ট্রাসমিটেড ডিজিজ) ডা. শ্যামল কুমার দাস। ওপরের সবাই আওয়ামীপন্থি চিকিৎসদের সংগঠন স্বাচিপের সদস্য। ৫ আগস্টের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের অপরাধী চিহ্নিত করে বিচারের দাবিতে শান্তি সমাবেশে অংশ নেন বলে অভিযোগ।
হাসপাতালে হাসপাতালে অসন্তোষএর বাইরেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিরুদ্ধে সমাবেশ ও মিছিল করা এবং ছাত্রদের ওপর হামলাকারী চিকিৎসকরা এখনো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বহাল তবিয়তে আছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে একটি পক্ষের। জুলাই বিপ্লবের উত্তাল দিনে শাহবাগে ছাত্রদের আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিলেন স্বাচিপের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ও বিএসএমএমইউ নিউরো সার্জারির সহকারী অধ্যাপক রকিবুল ইসলাম। তিনি এখনো সেখানে বহাল তবিয়তে। এমনকি ওই ঘটনায় মামলা হলেও তাকে আসামি করা হয়নি।
Advertisement
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে একজন চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘তারাই যদি নেতৃত্বে থাকবে, তাহলে আমরা কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাঠে নামলাম! তারা জয়ী হলে আজ তো আমাদের চাকরিচ্যুতিসহ জীবনহানির ঘটনাও ঘটতো। অথচ স্বৈরাচারমুক্ত দেশে তাদের তো কিচ্ছু হয়নি।’
এছাড়া জুলাই আন্দোলনে হতাহতদের চিকিৎসা দিতে অনীহা প্রকাশ করা কিংবা অসহযোগিতা করা অনেক চিকিৎসক বিভিন্ন হাসপাতালে এখনো বহাল তবিয়তে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন অনেকে।
জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক আফসোস করে বলেন, আহত ছাত্র নাগরিকদের চিকিৎসা না দিয়ে তিরস্কার যারা করেছে তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি চেয়েছে, এমন চিকিৎসকরাও এখন রাজার হালে।
বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন- ড্যাব ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল শাখার সভাপতি ডা. রেজওয়ানুর রহমান সোহেল জাগো নিউজকে বলেন, ‘পুলিশ ও প্রশাসন ফ্যাসিবাদের দোসরদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে এবং ২৫ বছরের কম যাদের চাকরির বয়স তাদের ওএসডি করেছে। তাদের চেয়ে বড় অপরাধী স্বাচিপের চিকিৎসক যারা আহতদের চিকিৎসা দিতে বাধা দিয়েছেন, মৃতদের ডেথ সার্টিফিকেট দেননি, হাসপাতালের রেজিস্ট্রারে নাম এন্ট্রি করেননি, চিকিৎসা নিতে গেলে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দিয়েছেন, তারা কেন স্বৈরাচারমুক্ত স্বাধীন দেশে চাকরি করবে।’
তিনি বলেন, ‘যেখানে একজন ফাঁসির আসামিরও চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে, সেখানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে আহতদের চিকিৎসা দিতে বাধা যারা দিয়েছে, তাদের জন্য শুধু বদলি কোনো শাস্তি হতে পারে না। এসব চিকিৎসকরা গুলি ছোড়া পুলিশের চেয়েও বড় অপরাধী। কারণ মানবসেবার পবিত্র ব্রত নিয়ে চিকিৎসক পেশায় এসে তারা দলীয় লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে অমানুষের মতো আচরণ করেছেন।’
ড্যাবের কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন অর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘২০০০ পর্যন্ত চাকরিপ্রাপ্তদের ফাস্টট্র্যাকে পদোন্নতির সিদ্ধান্তটিও বৈষম্যমূলক। এতে আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্তদেরই সুবিধা হবে। আমরা বলেছিলাম, ২০০৫ পর্যন্ত করতে, তাতে বিএনপির আমলে নিয়োগপ্রাপ্তরাও আসবে। দেখা যাচ্ছে, মন্ত্রণালয়ের এসব সিদ্ধান্ত স্বৈরাচারের দোসরদের পক্ষে যাচ্ছে। আমরা এটার তীব্র নিন্দা করি। এই সিদ্ধান্ত যারা নিচ্ছে, তারাও স্বৈরাচারের দোসর।’
তিনি বলেন, ‘বঞ্চিতদের পদোন্নতি অ্যাডমিন, পুলিশসহ বিভিন্ন ক্যাডারে যেভাবে হচ্ছে, আমাদের এখানে কিন্তু হচ্ছে না। আমাদের বৈঠেকের পর বৈঠক হয়, সিদ্ধান্ত হয় না। আবার সিদ্ধান্ত হলে এটা বাস্তবায়ন হয় না। স্বৈরাচার আমলে পদায়িতদের অপসারণ আমরা চাচ্ছিলাম। সেটা কোনোভাবেই হচ্ছে না। বরং ক্ষেত্র বিশেষে দেখছি, যাদের সরানো হয়েছে, তারা আবার পুরোনো জায়গায় ফেরত আসছে।’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য শিক্ষা সচিব সারোয়ার বারী ও স্বাস্থ্য ও অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে একাধিকবার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। খুদেবার্তায়ও সাড়া দেননি তারা।
তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে এ নিয়ে অফিসিয়াল বক্তব্য না দিলেও একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, কাজের প্রয়োজনে বা অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিয়ে অনেককে প্রয়োজন। তাই হুট করেই তালিকার সব চিকিৎসককে একসঙ্গে সরানো হচ্ছে না।
এসইউজে/এএসএ/জিকেএস