‘একসময় বহেরাতলায় লিটল ম্যাগ চত্বর ছিল বইমেলার প্রাণ। মেলা ঘুরে লিটল ম্যাগ চত্বরে এসে তরুণদের সঙ্গে কথা না বললে, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা না দিলে যে মেলায় এসেছি; বিষয়টি পরিপূর্ণ হতো না।’ কথাগুলো বলছিলেন নিসর্গর সম্পাদক সরকার আশরাফ।
Advertisement
এবার মেলার ২২ দিনে এসেও লিটল ম্যাগ চত্বরের নির্জনতা ভাঙছে না। যা হতাশা বাড়িয়েছে লেখক ও প্রকাশকদের মধ্যে। ছুটির দিনে তুলনামূলক ভিড় বাড়লেও বিক্রি হচ্ছে না তেমন।
সম্পাদক সরকার আশরাফ বলেন, ‘বহেরাতলা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে আসার পর থেকেই লিটল ম্যাগ চত্বরে লোক সমাগম কমে আসছে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, বৃহৎ পরিসরে বইমেলা এসেছে ঠিক, আয়োজনও অনেক বড় কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি মানুষের, লেখকদের যে টান বা দায় যেন কমে গেছে।’
কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সাহিত্য মানুষ পড়ে না, বিষয়টা এমন না। মেলায় এ বছর বিশেষ করে অনেকের মেলায় আশার প্রতি অনীহা তৈরি হয়েছে। সেটা রাজনৈতিক কারণ অবশ্যই। কেউ পক্ষে আছেন, কেউ বিপক্ষে আছেন। আবার কারও ভেতর থেকে বইপড়ার স্বতঃস্ফূর্ততা তৈরি হচ্ছে না।’
Advertisement
সরকার আশরাফ বলেন, ‘শুধু শুক্র এবং শনিবারে মোটামুটি লোকজন আসে। তবে শুক্রবার-শনিবারে লোক সমাগম হলেও মানুষের ক্রয় করার যে প্রবণতা, সেটা ভেঙে গেছে।’
লিটল ম্যাগ প্রান্তস্বরের সম্পাদক রিজভী ইসলাম বলেন, ‘বাংলা একাডেমির বহেরাতলায় থাকার সময় একদম ভিন্ন পরিবেশ ছিল। পাঠকের সরব উপস্থিতি ছিল। বই কেনার পাশাপাশি আড্ডাও চলতো। উদ্যানে আসার পর থেকে লিটল ম্যাগ চত্বর ক্রমেই ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। এখনো আমার ভালো না লাগলে বহেরাতলায় যাই।’
অর্থনৈতিক প্রভাবের বিষয়ে রিজভী ইসলাম বলেন, ‘আমরা ম্যাগাজিন চত্বরের সাথে সংশ্লিষ্ট যারা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের খরচের টাকাটা ওঠে না। আমরা খুব একটা আশাও করি না যে, এই ম্যাগাজিন বিক্রি করে আমার খরচের টাকা উঠবে। সাহিত্যচর্চা এগিয়ে যাক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের টার্গেট এটাই থাকে।’
আরও পড়ুন ভালো বেচাকেনায় বইমেলার দশম দিন লাল গোলাপ ও বইমেলার জমে ওঠা শুক্রবারঅন্য স্টলগুলোতে বিক্রি ভালো হলেও লিটল ম্যাগ চত্বরে পাঠকের আনাগোনা একেবারেই কম। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এলেও এখানে দেখা যায় ফাঁকা চত্বর, অলস সময় কাটতে থাকে বিক্রেতা ও প্রকাশকদের। ম্যাগ চত্বরের প্রসপারিনা সরকারের স্টলে একটি বই কিনলে একটি ফ্রি অফার চলছে, তবুও বিক্রি হচ্ছে না তেমন।
Advertisement
এ বছর লিটল ম্যাগ চত্বরে স্টল সংখ্যাও কমে গেছে। বাংলা একাডেমির তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ১৭০টি স্টল ছিল। এবার তা নেমে এসেছে ১৩০টিতে। তবে ১৩০টি স্টলও নিয়মিত খোলা হচ্ছে না। প্রবীণ পাঠক আশরাফ হোসেন বলেন, ‘তরুণ পাঠকদের আগ্রহ কমছে, অথচ একসময় বিকেল হতেই এ চত্বর ছিল সাহিত্যপ্রেমীদের প্রাণকেন্দ্র।’
আশরাফ হোসেন বলেন, ‘আগে লিটল ম্যাগ চত্বরে এলেই বোঝা যেত নতুন কী লেখা বেরিয়েছে, কারা লিখছেন। পাশাপাশি সাহিত্যিকদের আড্ডা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা—সব মিলিয়ে প্রাণবন্ত মুহূর্ত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই আকর্ষণ হারিয়ে গেছে। এতে আমাদেরও দায় আছে। আমরা তরুণদের বইমুখী করতে পারিনি। নতুন নতুন প্ল্যাটফর্ম বেরিয়েছে।’
তবে এখনো কেউ কেউ লিটল ম্যাগ চত্বরের টানে আসেন। সরেজমিনে দেখা যায়, তরুণদের তুলনায় প্রবীণদের সমাগম বেশি। প্রবীণ পাঠকরা জানান, এ জায়গাটা শান্তির। তবে তাদের মতে আগের স্থানটি ভালো ছিল।
তরুণ পাঠকদের মধ্যে লিটল ম্যাগের নির্জনতা নিয়ে কৌতূহল থাকলেও তাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা তুলনামূলক কম। মেলায় ঘুরতে আসা তরুণরা জানান, আগে একটা লেখা চাইলেই ছাপানো যেত না। এখন বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চাইলেই আমরা অনেক কিছু লিখতে পারছি। তবে এর প্রতি আমাদের প্রজন্মের আগ্রহ সৃষ্টি করতে নতুন উদ্যোগ দরকার।
লিটল ম্যাগ চত্বরকে প্রাণবন্ত করতে প্রয়োজন তরুণদের মাঝে সাহিত্য-প্রেম জাগিয়ে তোলা, জানালেন ম্যাগ চত্বরের প্রকাশক-সম্পাদকরা। তারা বলেন, ‘এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলে নতুন প্রজন্মের পাঠক তৈরি হবে।’
প্রত্যাশা স্টলের প্রতিষ্ঠাতা পারুল আক্তার বলেন, ‘বাংলা একাডেমির উচিত প্রচার-প্রচারণা বাড়ানো। অন্য স্টলগুলোর মতো ম্যাগ চত্বরকেও জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে গড়ে তোলা, বৈচিত্র্য আনা জরুরি।’
এসইউ/এএসএম