পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
Advertisement
জাহিদ নয়ন একজন তরুণ কবি ও সুচিন্তক। সত্য ও সুন্দরকে মনেপ্রাণে লালন করেন। শেকড়ের সংস্কৃতি ও একাত্তরের জন্মনাদকে ধারণ করেন তার প্রতি নিঃশ্বাসে। যৌবনের সাহস যেমন তার দ্রোহ-চেতনার উৎস; তেমনই মানবীয় গুণাবলির প্রতিধ্বনি তার কবিতার সৌন্দর্য। দীর্ঘদিন ধরেই লিখছেন। বালকজীবন ছেড়ে যৌবনের ফাগুনো দিনেও তিনি কবিত্বের কৌমার্যে অটুট ছিলেন এতদিন। পঁচিশের অমর একুশে বইমেলা তার সেই কৌমার্যকে গৌরব দিয়ে টুটিয়ে দিলো প্রথম কাব্যগ্রন্থের জনক বানিয়ে।
জাহিদ নয়নের প্রকাশিত প্রথম মননশস্যের নাম ‘আততায়ী অন্ধকার’। ঊনচল্লিশটি সদ্যোজাত মননশস্যে প্রথম পিতৃত্বের গ্রন্থখানি সমৃদ্ধ। গ্রন্থখানি উৎসর্গ করেছেন তার প্রয়াত পিতা মো. কামাল উদ্দিনকে। এ থেকেই বোঝা যায়, তার শোণিত-চেতনায় পিতৃপ্রেম ফল্গুধারায় বহমান। অনেক কবি-লেখককে দেখেছি, যারা নিজের মাতা-পিতাকে কোনো গ্রন্থ উৎসর্গ করেননি। বরং পাদপ্রদীপের আলোয় আসার জন্য অপ্রাসঙ্গিকভাবে হলেও বরেণ্য কাউকে উৎসর্গ করে বইটিকে ধন্য করেন। এ উৎসর্গে শ্রদ্ধার চেয়ে আত্মজাহির প্রবণতা ও আত্মপ্রচারমুখিতা অধিক লক্ষণীয়। কিন্তু জন্মদাতা ও পরিচয়দাতা পিতাকে প্রথম কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করে কবি জাহিদ নয়ন কেবল আশীর্বাদের অনন্ত ডালাকেই মাথা পেতে নেননি, তার সাথে জন্মঋণের অপরিশোধ্য মহত্বকেও স্বীকার করে নিয়েছেন। বাবার সাথে মাকেও যদি ব্র্যাকেটবন্দি করা হতো, তাহলে উৎসর্গের উদ্দেশ্য শতভাগ পূর্ণতা পেয়ে অতিপৃক্ত হতো।
কাব্যগ্রন্থের নামকরণ ‘আততায়ী অন্ধকার’ সময়ের নিরিখে অত্যন্ত যুৎসই হয়েছে বলে মনে হলো। বড্ড অস্থির একটা সময় আমরা পার করছি। অদ্ভুত এক আঁধার আজ ঘিরে আছে আমাদের চারপাশ। ক্রমশ ধেয়ে আসছে নিকটে। প্রকাশিত না হওয়া অবধি এ আঁধার আততায়ী। এ আঁধারের উদ্দেশ্য আমাদের অজানা। এ আঁধার আমাদের বোধে ও চেতনায় ঘাতকতুল্য। এ আঁধার কেড়ে নিয়েছে আলোকের উৎস, সৃজনশীলতার উৎসব সবই। নিজের মাকে মা বলার অধিকার হরণ করার মতো আততায়ী এ আঁধার। স্বাধীন ভূ-খণ্ড ও পতাকার জন্মনাদ অস্বীকারের স্পর্ধায় এ আঁধার সত্যিকারের এক মহা দানবের মতো।
Advertisement
নামকরণের কবিতাটি ছত্রিশ নম্বর পৃষ্ঠাজুড়ে আটাশতম কবিতা হিসেবে গ্রন্থিত। আঁধার আক্রান্ত রাত একটা নিঃসঙ্গ উদ্বাস্তু নদীর কাছে দাঁড়ায়। নদীটি হেঁটে গেছে বক্র পথরেখা ধরে। নদী জানে না উত্তরণ, রাত জানে না সন্তরণ। রাত ইউক্যালিপটাস বনের দাবানল পুষে রাখলেও নদীর প্রবহমান দহন বুঝতে পারে না। ভয়ার্ত নদী তাই আততায়ী আঁধারে জেগে থাকে, এমনকি তন্দ্রাও তার চোখে করেনি ভর। আততায়ী অন্ধকারে রাত এতই নিস্তব্ধ, এতই বধির, সে শুনতে পায় না একবুক দহন নিয়ে বহমান নদীর কান্না। খুব চমৎকারভাবে কবি আমাদের আঁধার আক্রান্ত রাত আর বহমান নদীর এক অনন্য চিত্রকল্প তৈরি করে জাগিয়ে রেখেছেন আততায়ীকে আবিষ্কারের লোভ দেখিয়ে। নদী যেন আমার সামনে দিয়েই বয়ে চলেছে, ভীত-সন্ত্রস্ত। রাত বুঝি পাঠক নিজেই, যে বুঝতে পারে না, প্রবহমান নদীর দহন-বেদনার স্বরূপ ও বিস্তার।
আরও পড়ুন বই পড়তে গিয়ে অনেক চরিত্রের প্রেমে পড়েছি: নির্জন মায়াজাল: গল্পের মোড়কে জীবন-সমাজচিত্রকবি ‘আততায়ী অন্ধকার’ দিয়েই পাঠককে জাগিয়ে রেখেছেন তার অন্তর্বেদনাকে পাঠ করানোর আকাঙ্ক্ষায়। ‘বিষণ্ন সুন্দর পথে’ কবির প্রথম কবিতা। প্রথম স্তবকটি তিন পঙ্ক্তির অসাধারণ এক মহাকাব্যের বনসাই যেন। কবি বলছেন, ‘ঝড় থেমে গেলে থেকে যায় তাণ্ডবের চিহ্ন/ মৃত পাখিদের শেষকৃত্য শেষে/ ফিরে যায় পিঁপড়ের দলও।’ এ যেন সময়ের এক নতুন কুরুক্ষেত্র। কবি জীবনের এ মহাকালিক যুদ্ধের পরিণাম জানাতে গিয়ে বলছেন, ‘যারা মৃত এবং বিধ্বস্ত/ তাদের কোনো পদচিহ্ন থাকে না।’ শোনামাত্র মনে হলো বহুকাল ধরে শুনে আসা কোনো ঐশী বাণী। এ বাণীর গভীরতা অতল, এ বাণীর ব্যাপ্তি ব্যাপক। পৃথিবী জীবিত ও জয়ীদের বশ্যতা মানে, মৃত ও বিধ্বস্তরা বিস্মৃত ও বিচূর্ণিত। তাই আক্ষেপে কবি শেষ স্তবকে আমাদের জানাচ্ছেন, ‘আমরা কেবলই হাঁটি দিনলিপির ছায়ায়/ বিস্মৃত পুনর্জন্মের ছাই জ্বালিয়ে/ এপিটাফ লিখি বারবার।’ ভবিতব্য না জানা আমরা আসলেই দিনলিপির ছায়ালিপি হয়েই দিনাতিপাত করি। আমরা নতুন কিছু সৃজনও করি না, যাপনও করি না। যা দিনলিপি পূর্বে লিপিবদ্ধ করে রেখেছে, আমরা সেই দিনলিপির ছায়া ধরে চলতে শুরু করি।
বইয়ের শেষ কবিতা ‘হাসপাতাল রোড’। এ কবিতায় তিনি তার নিজ নিকেতনের চৌহদ্দির কথা বলেছেন। নিজের কথা বলতে গিয়ে তিনি এক অত্যাশ্চর্য চিত্রকল্প তৈরি করে আমাদের উৎসাহী করে তোলেন, উঁকি মেরে দেখতে। ‘নিরাময় হাউজ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে অ্যাপ্রোন রঙের সকাল।’ কবি যেন এ পঙ্ক্তির সাথে সাথে আমাদের নিয়ে যান আবারও জীবনের সেই কুরুক্ষেত্রে, যেখানে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন জানিয়ে দেয়, যম ও জীবনের যুদ্ধ চলছে, অ্যাপ্রোন পরা সকালের প্রতীক চিকিৎসক যেন অর্জুন। ‘সাইরেন-যুদ্ধ-সাইরেন’ জানিয়ে দেয় জীবনের অনিবার্য পরিণাম।
‘আততায়ী আঁধার’ কাব্যগ্রন্থে কবি উপমা ও চিত্রকল্পের সমৃদ্ধ সম্ভার খুলে দিয়েছেন। আমরা তারই বদান্যতায় পেয়ে যাই চোখের ভেতর ভোরের নদী, দুঃস্বপ্নের শামিয়ানা, কামুক বিজ্ঞাপন কিংবা অ্যাপ্রোন রঙা মধ্যাহ্নকে। অস্থির সময়ের কবি হলেও কবি জাহিদ নয়নের অন্তরে এখনো রবীন্দ্রনাথ বেঁচে আছেন বহাল তবিয়তে। আজ চারদিকে যখন শুনি রবীন্দ্রনাথ কবি নন, হিন্দু জমিদার মাত্র; তখন তারই বিপরীতে জাহিদ নয়ন ‘আততায়ী আঁধারে’ বসেও প্রিয়তমা, বর্ষা এবং রবীন্দ্রনাথের সাথে তার জীবন কাটাতে চান। বইয়ের দ্বিতীয় কবিতায় তিনি যেমন নিজের রুচি ও ঋদ্ধিকে তুলে ধরেছেন; তেমনই বইয়ের তিরিশ নম্বর কবিতায় কবি পঙ্গু সময়ের সেরা সাহসকে আততায়ী আঁধার চিরে আলোর পথে এনেছেন।
Advertisement
কবি জাহিদ নয়ন একজন আপাদমস্তক কবি, একজন আপাদমস্তক দ্রোহধারী। তার প্রথম পিতৃত্বের কাব্যগ্রন্থখানি সৃজনশস্যের সমাহারে কালাতিক্রম্যতাকে জয় করিয়ে দিক, পাঠক হিসেবে এটাই সর্বান্তকরণে কাম্য। ‘আততায়ী অন্ধকার’ অদূরবর্তী ভাবীকালের অনাবৃত আলোর অনিরুদ্ধ উৎস হয়ে উঠবেই।
এসইউ/এএসএম