টমেটো চাষে বদলে গেছে পাবনার প্রত্যন্ত গ্রাম খলিলপুরসহ আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের অর্থনীতির চিত্র। শীতকালীন এ সবজি উৎপাদনে কৃষকদের ধারাবাহিক সাফল্যে গ্রামটি খ্যাতি পেয়েছে ‘টমেটো গ্রাম’ নামে। প্রতি বিঘায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে গ্রাম থেকেই সরবরাহ হচ্ছে সারাদেশে।
Advertisement
তথ্য বলছে, সুজানগর উপজেলার সাগরকান্দি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত চর খলিলপুরে ২ যুগ আগে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম টমেটো চাষ করেন আনসার আলী। শুরুতেই তার কাছে ধরা দেয় ব্যাপক সফলতা। তার সফলতা দেখে টমেটো চাষে ঝুঁকেছেন আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের কৃষকেরাও। ফলে এলাকার প্রায় পুরো জমি এখন টমেটো বাগানে রূপ নিয়েছে।
কৃষি উদ্যোক্তা আনসার আলী বলেন, ‘জৈব বালাইনাশক ও উন্নত জাতের টমেটো চাষ করলে সহজেই লাভের মুখ দেখা সম্ভব। আমি প্রচলিত মিন্টু সুপার জাতের পাশাপাশি সুলতান সুলেমান ও মিরাক্কেল জাতের টমেটো চাষ করেছি। মিরাক্কেল জাতের টমেটো আকারে বড় ও দেখতে খুবই আকর্ষণীয়। ফলে অন্য টমেটোর চেয়ে দামও বেশি। প্রতিটি টমেটোর ওজন কমপক্ষে ৫০০ গ্রাম। সব মিলিয়ে টমেটো চাষে শুধু আমার নয়, ভাগ্য বদলেছে গ্রামের অনেক চাষির।’
চাষিরা জানান, ১ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করতে সার, বীজ ও শ্রমিকসহ খরচ হয় ২৫-২৭ হাজার টাকা। এবার বিঘাপ্রতি ফলন হয়েছে ২০০-৩০০ মণ। বর্তমান বাজারে প্রতি মণ টমেটো বিক্রি হচ্ছে ৫০০-৬০০ টাকা দরে। উৎপাদন খরচ বাদে প্রতি বিঘা জমির টমেটো বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা। প্রতি বছর বিঘাপ্রতি ৬০-৭০ হাজার টাকা লাভের মুখ দেখছেন তারা। এ কারণে অন্য ফসল ছেড়ে টমেটো চাষের দিকে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন চাষিরা। তবে গ্রামগুলোয় টমেটো সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় প্রতি বছর মৌসুমের শেষদিকে বিপুল পরিমাণ টমেটো নষ্ট হয়। এ সংকট কাটাতে গ্রামটিতে সবজি সংরক্ষণাগার নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন চাষিরা।
Advertisement
সাগরকান্দির খলিলপুর গ্রামের চাষি সেলিম মন্ডল বলেন, ‘টমেটো চাষের প্রথমদিকে ভালোই দাম পাওয়া যায়। অনেক সময় ব্যবসায়ীরা পুরো জমির টমেটো কিনে নেন। ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে টমেটো নিয়ে জমি ছেড়ে দেন। তবে বেশিরভাগ চাষি নিজেরাই ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। টমেটো ব্যবসায়ীরা মূলত বাইরের। তারা এখানে এসে বিভিন্ন এলাকা ঘুরে টমেটো কিনে ট্রাকে করে নিয়ে যান।’
একই গ্রামের চাষি মানিক শেখ বলেন, ‘এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রতি বিঘা জমিতে ২০০ থেকে ৩৫০ মণ পর্যন্ত ফলন হয়েছে। হাট-বাজারে টমেটোর দামও বেশ ভালো। বাজারে নিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রি হয়ে যায়। এ টমেটো চাষ করে অনেক ভালো দিন পার করছি।’
আরও পড়ুনব্রোকলি চাষে সফল মিরসরাইয়ের কৃষি উদ্যোক্তা মামুনতামাক ছেড়ে বরই চাষে মাহবুবের বছরে আয় ১২ লাখকেবল বাণিজ্যিক সফলতাই নয়, জৈব প্রযুক্তি ব্যবহারে বিষমুক্ত নিরাপদ টমেটো উৎপাদনেও অনন্য নজির সৃষ্টি করেছেন এসব গ্রামের চাষিরা। আকর্ষণীয় আকার, স্বাদের সুখ্যাতির জন্য এ গ্রামের টমেটো কিনতে দূর থেকে আসেন পাইকাররা। সরবরাহ হয় ঢাকাসহ সারাদেশে। তবে উন্নত যোগাযোগব্যবস্থা না থাকায় পরিবহনে রয়েছে ভোগান্তি।
ব্যবসায়ীরা বলেন, ‘এ চরাঞ্চলের জমি থেকে কৃষিপণ্য ভ্যান গাড়িতে করে আনতে হয়। টমেটোর ভ্যান নিয়ে এ রাস্তায় চলতে অনেক কষ্ট হয়। কখনো গাড়ি উল্টে পড়ে যায়। ফলে সঠিক সময়ে কৃষিপণ্য বিক্রি না করতে পারায় অনেক লোকসান গুনতে হয়। যদি এ প্রত্যন্ত অঞ্চলে একটি পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়, তবে আমাদের জন্য অনেক ভালো হয়।’
Advertisement
জেলা কৃষি বিভাগ বলছে, উপজেলার সাগরকান্দি ইউনিয়নের খলিলপুর, চর খলিলপুর এবং কালিকাপুর, নাজিরগঞ্জ পূর্ব গ্রামের বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে এ বছর টমেটো চাষ করা হয়েছে। চলতি বছর এ অঞ্চলে ৩৫০ হেক্টরের মধ্যে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে টমেটো চাষ হয়েছে। যা জেলায় মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার প্রায় ২৫ শতাংশ।
চাষিরা ভালো দামে চলতি মৌসুমে টমেটো চাষে ব্যাপক লাভের মুখ দেখেছেন জানিয়ে পাবনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মো. জামাল উদ্দিন বলেন, ‘চরাঞ্চলের জমিতে টমেটো চাষ করে ওই অঞ্চলের কৃষকের ভাগ্য বদলে গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রণোদনাও দেওয়া হয়েছে। তারা আরও বেশি টমেটো আবাদ করতে পারেন। সে জন্য প্রশিক্ষণসহ উন্নত মানের বীজ, সার-কীটনাশক, কৃষি প্রণোদনা দিয়ে সহযোগিতা করা হচ্ছে। সামনে আরও সহযোগিতা করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘খলিলপুর বাজার থেকে চরাঞ্চলের মাঝ দিয়ে যাতায়াত করা সড়কের বেহাল দশা। এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রতিনিধি ও এলজিইডির সঙ্গে যোগাযোগ করে ঠিক করে দেওয়া হবে। যাতে এ অঞ্চলের কৃষকের উৎপাদিত ফসল সহজেই বাজারজাত করতে পারেন।’
আলমগীর হোসাইন/এসইউ/জেআইএম