২০ বছর ধরে ভারত থেকে পাথর আমদানির অন্যতম রুট সিলেটের ভোলাগঞ্জ শুল্ক স্টেশনকে ২০১৯ সালে স্থলবন্দর ঘোষণা করে সরকার। দেশের ২৪তম স্থলবন্দর হিসেবে ঘোষণার চার বছর পর জমি অধিগ্রহণসহ নানা ঝামেলা চুকিয়ে গেল বছরের জুন মাসে ১৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থলবন্দর নির্মাণকাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
Advertisement
কিন্তু কাজ শুরুর এক মাসের মাথায় ৫ আগস্টের পরে নির্মাণাধীন স্থাপনায় ভাঙচুর ও লুটপাট করে নির্মাণ সামগ্রী। কেটে নিয়ে যায় বুলডোজার চেইন ডোজার ও এস্কেভেটর। যার ফলে ফের পিছিয়ে পড়ে স্থলবন্দর নির্মাণ কাজ। তবুও এগিয়ে যাচ্ছে প্রকল্পের কাজ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন ইতোমধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে গেছে।
এ অবস্থায় স্থলবন্দর নির্মাণ কাজ বন্ধের দাবি তুলেছেন ভোলাগঞ্জের পাথর ব্যবসায়ীরা। তাদের দাবি, ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতকে খুশি করতে এখানে স্থলবন্দর নির্মাণের প্রকল্প গ্রহণ করেছিলেন। এ প্রকল্প বন্ধ না হলে ভোলাগঞ্জের পাথর ব্যবসায়ী-শ্রমিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সিলেট নগরীর একটি রেস্টুরেন্টে সংবাদ সম্মেলন করে এ দাবি জানান ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপের ব্যবসায়ীরা। সংবাদ সম্মেলনে স্থলবন্দর নির্মাণ কাজ বন্ধ করা না হলে আন্দোলনেরও হুঁশিয়ারি দেন তারা।
Advertisement
অন্যদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প বন্ধের দাবির পেছনে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রয়েছে। কারণ স্থলবন্দরের কার্যক্রম শুরু হলে সরকারের রাজস্ব আদায় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। এতে করে তাদের ব্যয় বাড়বে। তাছাড়াও এখানে সরকারের বিশাল জায়গা অবৈধভাবে দখল করে ভোগ করছেন ব্যবসায়ীরা। স্থলবন্দর নির্মাণ কাজ শেষ হলে এসব জায়গাও ছাড়তে হবে তাদের। যার কারণে স্থল বন্দর নির্মাণের পক্ষে নয় তারা।
জানা গেছে, ২০০৫ সাল থেকে ভোলাগঞ্জ শুল্ক স্টেশন দিয়ে ভারত থেকে চুনাপাথর আমদানি শুরু হয়। ভোলাগঞ্জের ওপারে ভারতের খাসি হিলস জেলার মাজাই এলাকার ব্যবসায়ীরা এ স্টেশন দিয়ে পাথর রপ্তানি করছেন। সেখানকার ব্যবসায়ীরা ১৬০ কিলোমিটার পথ ঘুরে সিলেটের অন্যতম স্থলবন্দর তামাবিল ব্যবহার না করে সহজে ভোলাগঞ্জ স্টেশন ব্যবহার করে বাংলাদেশে পাথর রপ্তানি করছেন। চুনাপাথর ছাড়া অন্য কোনো পণ্য আমদানি বা রপ্তানি হয় না এ স্টেশন দিয়ে।
ভারত অংশে স্টেশন না থাকার পরও ২০১৯ সালে শুল্ক স্টেশনটিকে ‘ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর’ হিসেবে ঘোষণা করে সরকার। দেশের ২৪তম স্থলবন্দর হিসেবে ভোলাগঞ্জ ঘোষণার পর চার বছর চলে জমি অধিগ্রহণ ও মাটি ভরাট নিয়ে দ্বন্দ্ব। সব ঝামেলা শেষ করে ১৭৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গত বছরের জানুয়ারি মাসে কাজ শুরু করার কথা ছিল। কিন্তু এসময় একজন ব্যক্তি ১১২ একর জমির ওপর মালিকানা দাবি করে আদালতে মামলা করেন। পরে সেই মামলাজনিত কারণে ওই বছরের জুন মাসে কাজ শুরু হয়।
১৮ মাস মেয়াদে অনিক ট্রেডিং করপোরেশন ও মজিদ সন্স অ্যান্ড মাসুদ স্টিল নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। নির্মাণ কাজ শুরুর এক মাসের মাথায় গত ৫ আগস্টের পরে লুটপাট করে সবকিছু নিয়ে যায় দুষ্কৃতিকারীরা। পরে আবার কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
Advertisement
এবার সে স্থলবন্দরের নির্মাণ কাজ বন্ধের দাবি জানিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন ভোলাগঞ্জ চুনাপাথর আমদানিকারক গ্রুপের ব্যবসায়ীরা।
শনিবার (২২ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে সিলেটে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের সভাপতি সাহাব উদ্দিন বলেন, ভারত সরকারকে খুশি ও লুটপাটের জন্যই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ভারত থেকে শুধু চুনাপাথরের জন্য এত বড় বন্দরের প্রয়োজন নেই। ভারতের স্বার্থে লুটপাটের জন্য স্থলবন্দর করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী একটি বন্দরের উভয় পাশে ভারত ও বাংলাদেশ অংশে স্থলবন্দর নির্মাণ করে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। তবে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা সমান সুবিধা ভোগ করবে। কিন্তু এককভাবে এক অংশে বা এক দেশে স্থলবন্দর নির্মাণ করা হলে যে দেশে বন্দর অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে সে দেশের ওপর চাপ বাড়বে।
তিনি বলেন, ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দর এলাকায় এখন অবকাঠামো নির্মাণ করা হচ্ছে। কিন্তু ভারতের মেঘালয় অংশের সীমান্তঘেঁষা মাজাই এলাকায় স্থলবন্দরের কোনো অবকাঠামো নেই। মেঘালয়ের ওই অংশের ব্যবসায়ীরা এ নিয়ে তাদের দেশের সরকারের কাছে চিঠি আদান-প্রদান করলে তারা জানিয়ে দিয়েছে ভারতের অংশে অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে না। ফলে কেবল বাংলাদেশ অংশের ভোলাগঞ্জের ৫২ একর জায়গাজুড়ে স্থল বন্দর নির্মাণের কাজ চলছে।
এটি অযৌক্তিক উল্লেখ করে তিনি বলেন, কেবলমাত্র লুটপাটের জন্য গুরুত্বহীন এ প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের অধিভুক্ত এলাকায় আগে কয়েকশ ব্যবসায়ীর কার্যালয় ও পাথর ডাম্পিং এলাকা ছিল। ব্যবসায়ীরা ওখানে বসে পাথর ডাম্পিং করতে পারতেন। কিন্তু প্রকল্প কাজ শুরু করার আগে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করে ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ে হঠাৎ করে একদিন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের অফিস ও ডাম্পিং স্টেশন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। একই সঙ্গে পানি দিয়ে প্রেশার দিয়ে ড্রেজার মেশিন দ্বারা ডাম্পিংয়ে রাখা প্রায় ৫-৬ কোটি টাকার পাথর মাটির নিচে চলে যায়। সেই পাথরগুলো আরও বিক্রি করা সম্ভব হয়নি। পুরো টাকাই ব্যবসায়ীদের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এক বছর আগে উচ্ছেদের সময় ক্ষতিগ্রস্ত কোনো ব্যবসায়ী বা শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়নি। অনেকে অসহায় অবস্থায় রয়েছেন। এতে করে স্থানীয়দের মধ্যেও চরম ক্ষোভ ও উত্তেজনা বিরাজ করছে।
অবিলম্বে এ স্থলবন্দর নির্মাণ কাজ বন্ধ করা না হলে সাধারণ ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি আদায়ে বাধ্য হবেন বলে হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে ভোলাগঞ্জ স্থলবন্দরের প্রকল্প পরিচালক সারোয়ার আলম জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পের কাজ প্রায় ৬০ শতাংশ শেষ হয়ে গেছে। চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজ শেষ করে স্থলবন্দরের কার্যক্রম উদ্বোধন করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের দাবি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এখানে ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রয়েছে। তারা সরকারের অনেক জমি দখল করে রেখেছে। স্থলবন্দর নির্মাণ কাজ শেষ হলে এসব জমি ছাড়তে হবে। তাছাড়া স্থলবন্দর চালু হলে সরকারের রাজস্ব দিগুণ বেড়ে যাবে। এটা তারা মানতে পারছেন না।
তিনি বলেন, এখন প্রতিদিন ২৫০-৩০০ ট্রাক পাথর আমদানি করা হয়। কিন্তু কোনো স্কেল ও স্ক্যানিং করার সুযোগ না থাকায় কী পরিমাণ পণ্য আসছে তার হিসাব নেই। তাছাড়াও পাথরের সঙ্গে কোনো অবৈধ পণ্য আসছে কী না তাও যাচাই করা যাচ্ছে না। স্থলবন্দর হলে সব সুযোগ-সুবিধা থাকবে। নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা এসব চাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, এখানে ৫২ একর জমির ওপর স্থলবন্দর নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু একজন ব্যবসায়ী সেই ৫২ একরসহ ১১২ একর জমির ওপর মামলা হয়। পরে মামলার রায় সরকারের পক্ষে এসেছে। এখন সরকারের ১১২ একর জমি কাগজে কলমে সরকারের রয়েছে। আরও বিপুল পরিমাণ জমি বেদখলে রয়েছে। স্থলবন্দর নির্মাণ হলে সেসব জমিও সরকারের নিয়ন্ত্রণে আসবে।
তামাবিল স্থলবন্দরের রাজস্ব কর্মকর্তা দিদারুন নবী বলেন, বন্দরের উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের দায়িত্ব তাদের না। বন্দর নির্মাণ কাজ শেষ হলে তারা সেখানে তারা স্থানান্তরিত হবেন। তখন স্কেলসহ অন্য সুবিধাও থাকবে।
তিনি আরও বলেন, এখন প্রতিদিন ২৫০-৩০০ ট্রাক পাথর আমদানি করা হয়। এ বন্দর দিয়ে অন্য কোনো পণ্য আমদানি করা হয় না।
আহমেদ জামিল/আরএইচ/এমএস