দেশজুড়ে

৭৩ বছরেও ঘোচেনি শহীদ সালাম পরিবারের আক্ষেপ

ভাষা আন্দোলনের ৭৩ বছর পূর্ণ হলেও আক্ষেপ ঘোচেনি ভাষাশহীদ আবদুস সালামের পরিবারের। দীর্ঘ সময়ে এ পরিবারের কয়টি চাওয়া এখনো পূরণ হয়নি। এনিয়ে ক্ষোভের অন্ত নেই তাদের।

Advertisement

শহীদের স্বজন ও স্থানীয়রা জানান, ঢাকার আজিমপুর কবরস্থানে সালামের কবর চিহ্নিত করা হলেও সেটি সংরক্ষণ হয়নি এখনো। দাগনভূঞা বাজারের জিরো পয়েন্টকে সালাম চত্বর নামকরণ, ঢাকা-ফেনী-দাগনভূঞায় একটি সড়ক সালামের নামে নামকরণ, চার লেনের মহাসড়কের পাশে সালামের বাড়ি নির্দেশক তোরণ নির্মাণ, ভাষা শহীদ সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নামকরণ করা হলেও সরকারিভাবে গেজেট প্রকাশের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু কিছু হয়নি এখনো।

এছাড়া মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা ছিলো ভাষা শহীদদের ক্ষেত্রে নেই, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়লেও ভাষা শহীদদের বাড়েনি। এদিকে স্থানীয়ভাবে শহীদ সালামের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানগুলো তদারকির অভাব ও অবহেলায় নানা সমস্যায় আছে।

ভাষা আন্দোলনের ৬৫ বছর পর ২০১৭ সালে শনাক্ত হলো শহীদ সালামের কবর। ঢাকার আজিমপুরে শায়িত আছেন এ মহান ভাষা সৈনিক। এ সাত বছরেও তার কবর সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।

Advertisement

যদিও ভাষা শহীদ সালামের ছোট ভাই আবদুল করিম ও ভাতিজা মকবুল আহমেদ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-৩ এর নির্বাহী কর্মকর্তা আনসার উজ্জামান, অঞ্চল-৩ এর সহকারী সমাজকল্যাণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ রোকনুজ্জামান, কবরস্থানের সিনিয়র মোহরার হাফিজুর রহমান এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের উপস্থিতিতে ২০১৭ সালে ১৪ ফেব্রুয়ারি কবর শনাক্ত করা হয়।

এদিকে ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার লক্ষ্মণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ২০১৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় করা হয়। নামকরণের গেজেট এখনো প্রকাশ হয়নি। স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে আব্দুস সালামের জন্মস্থান লক্ষ্মণপুর গ্রামের নাম সালামনগর করা হয়। তার স্মৃতি রক্ষায় সালামনগরে গ্রন্থাগার ও জাদুঘর স্থাপন করা হয়।

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মোসাম্মৎ নুরজাহান বেগম জানান, নামকরণের সাতবছর পার হয়ে গেলেও মন্ত্রণালয় থেকে এখনো পর্যন্ত গেজেট প্রকাশ হয়নি।

ভাষা শহীদ আবদুস সালামের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে ফেনী-দাগনভূঞা-নোয়াখালী চার লেনের মহাসড়ক। দীর্ঘ ২১ বছর আগে এলাকাবাসী সড়কের পাশে সালামের বাড়ি নির্দেশক সাইনবোর্ড লাগায়। সড়কটি চার লেনে সম্প্রসারণের সময় ওই সাইনবোর্ডটি ভেঙে যায়। এরপর আর নির্মাণ হয়নি। এলাকাবাসীর দাবি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ ভাষা শহীদ সালামের গ্রাম দেখতে আসে। কোনো নির্দেশক না থাকায় দূর-দূরান্তের এলাকা ঘুরতে হয় পর্যটকদের। ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়কে সালাম নগর নির্দেশক তোরণ নির্মাণ দাবি করেছে এলাকাবাসী।

Advertisement

পরিবার ও এলাকাবাসীর দাবীর প্রেক্ষিতে ভাষা শহীদ আবদুস সালামের নামে দাগনভূঞা উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়ামটি ‘ভাষা শহীদ সালাম অডিটোরিয়াম’ নামকরণ করা হয়। নামকরণের দুই বছরের মধ্যে পরিত্যক্ত হওয়ায় সেটি নিলামে বিক্রি করা হয়। ভেঙে ফেলার ১৬ বছর পর নির্মিত হয় অডিটোরিয়ামটি। তবে সেখানে সালামের নাম বাদ দিয়ে উপজেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম নামকরণ করা হয়েছে।

ভাষা শহীদ আবদুস সালামের ছোট ভাই আবদুল করিম জানান, পরিত্যক্ত অডিটোরিয়াম ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ হয়েছে। ওই অডিটোরিয়ামের নাম ‘ভাষা শহীদ সালাম অডিটোরিয়াম’ নামকরণের দাবি জানান তিনি।

এখানে ভাষা শহীদ সালাম স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগার নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে। বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে বাড়ে কদর, শুরু হয় পরিচ্ছন্নতা ও সাজসজ্জা। এছাড়া খবর রাখে না কেউ। তাই সালামের স্মরণে তার জন্মস্থানে আরও স্থাপনা তৈরির দাবি স্থানীয়দের। তাদের মতে এটিকে দৃষ্টিনন্দন করা গেলে ফিরে পাবে প্রাণ।

স্থানীয়রা জানান, সালামের স্মৃতি গ্রন্থাগারে সাড়ে ৩ হাজার বই রয়েছে। আর জাদুঘরে ভাষা শহীদের একটি ছবি ছাড়া নেই কোন স্মৃতিচিহ্ন। এতে হতাশ হয়ে ফিরে যান দূর-দূরান্তের দর্শনার্থীরা।

এদিকে গ্রাম্য পরিবেশ বিধায় সারা বছর থাকছে এটি প্রাণহীন। তাই নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে এলাকাটিকে দৃষ্টিনন্দন গড়ে তুলতে শিশু পার্ক স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন দাগনভূঞা উপজেলা চেয়ারম্যান দিদারুল কবির রতন।

ফেনী জেলা পরিষদ ও এলাকাবাসী জানায়, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় গ্রামের নাম ‘সালাম নগর’ করা হয়। প্রায় ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে শহীদ সালামের বাড়ির অদূরে নির্মাণ করা হয় ‘ভাষা শহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর ’। ২০০৮ সালের ২৬ মে স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ।

শহীদ সালামের ছোট ভাই আবদুল করিম আরও জানান, সালামের স্মৃতি চিহ্ন বলতে কিছুই নেই। রক্তমাখা শার্ট আর একটি ছবি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ সদস্য খাজা আহমদ নিয়ে আর ফেরত দেননি। আজিমপুর কবরস্থানে সালামের চিহ্নিত করা কবরটি যেন আজীবন সংরক্ষণ করা হয়।

ভাষা শহীদ আব্দুস সালামের ভাতিজা মো. নূরে আলম জানান, মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের চাকরি-বাকরিও পড়ালেখার ক্ষেত্রে কোটা থাকলেও ভাষা শহীদদের ক্ষেত্রে নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাড়লেও ভাষা শহীদদের বাড়েনি। তিনি কোটা ও ভাতা বাড়ানোর দাবি জানান।

ভাষা শহীদ সালাম স্মৃতি পরিষদের সভাপতি সাংবাদিক শাহাদাত হোসেন শহীদ সালামের পরিবারের দাবী পূরণে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতার আহ্বান জানান।

অডিটোরিয়াম ভাষা শহীদ সালামের নামে নামকরণ বিষয়ে জানতে চাইলে দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স.ম আজহারুল ইসলাম বলেন, কয়েক মাস আগে আমি এখানে যোগদান করেছি। অডিটোরিয়ামের বিষয়টি আমার জানা নেই। বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

ফেনী জেলা পরিষদের প্রশাসক গোলাম মো. বাতেন জানান, ২০২০ সালে লাইব্রেরিয়ান হিসেবে স্থানীয় লুৎফর রহমান বাবলুকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরে ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়কে তোরণ নির্মাণ করা হবে বলে জানান তিনি।

আবদুল্লাহ আল-মামুন/আরএইচ/জিকেএস