রহমান সাহেব দেশের বৃহৎ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের একটি বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা। অত্যন্ত বুদ্ধিমান ও কর্মঠ। কর্মক্ষেত্র কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে সবকিছুই সুন্দরভাবে সামলে নেওয়ার দক্ষতা তার আছে। তাকে সফল ব্যক্তি বলা যায়। তার সাফল্য ঈর্ষণীয়, তা নিয়েও কোনো সন্দেহ নেই।
Advertisement
মানুষের চাওয়ার যেমন শেষ নেই; তেমনই শেখারও শেষ নেই। ইদানিং রহমান সাহেবকে সূক্ষ একটি চিন্তা খুব ভাবিয়ে তুলছে। চিন্তাটি অবশ্য অনেক আগেও তাকে বেশ ভাবিয়েছে। সফলতার পেছনে ছুটতে গিয়ে আর ভাবা হয়নি। ব্যাপারটি নিয়ে রহমান সাহেব বেশ চিন্তিত।
বিষয়টি হচ্ছে ইংরেজি ভাষা। ইংরেজি যে তিনি জানেন না, তা কিন্তু নয়। বরাবর ইংরেজিতে নম্বরও বেশ ভালো পেয়েছেন। কথাও বলতে পারেন মোটামুটি। তবে এ যুগে তো আর মোটামুটিতে চলে না। কথা যখন বলেন; তখন যতই চেষ্টা করেন না কেন—একজন বিদেশি যেভাবে বলেন, সে রকম তো আর হয় না। অথচ আজকাল ইংরেজি মাধ্যম নয়; বাংলা মাধ্যমের ছেলেমেয়েরাও ভালোই ইংরেজি বলছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে।
রহমান সাহেবের মাথায় অনেক দিন ধরেই ঘুরছিল, অফিসের কাজে একটা লম্বা বিদেশ সফর করা যায় কি না? বিদেশ সফরে আগেও বেশ কয়েকবার গেছেন। সফরগুলোতে ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষতাও মোটামুটি ভালোই ছিল। তাই মনস্থির করেই ফেললেন—লম্বা একটি বিদেশ সফরের।
Advertisement
রহমান সাহেবের অফিসের কেরানি উসমান। খুবই বিশ্বস্ত। রহমান সাহেব তার সাথে অনেক দরকারি ও অদরকারি কথা বিভিন্ন প্রসঙ্গে বলেন। উসমানও অফিসের যাবতীয় তথ্য রহমান সাহেবকে দিয়ে সুযোগ বুঝে সুবিধা আদায় করে নেয়।
অফিসে এসেই তিনি উসমানকে ডাকলেন—‘কিরে উসমান, কী খবর বল।’‘স্যার বিশাল ঘটনা, মতিন স্যার ডেস্কে ঘুমাইতেছে। অ্যানি আপা আসার পর থেইকা কানতাছে আর কার লগে একটু পর পর জানি মোবাইলে কথা কইতাছে।’‘উসমান, এগুলো এখন আমার মাথায় দিস না তো।’‘সারের কি শইলডা খারাপ? একটা আদা চা কইরা দিমু?’‘না না, আমি ঠিক আছি। তুই এক গ্লাস পানি দে।’উসমান পানি দিতে দিতে বলে, ‘স্যার আফনারে না কইছিলাম, দিন দশেকের ছুটির কথা।’‘হ্যাঁ রে উসমান, মনে আছে। তাই তো তোকে ডাকলাম। সামনে আমি লম্বা সময় বিদেশে থাকবো। তা প্রায় তিন-চার মাস। তখন তুই ছুটি নিস।’‘এতদিন স্যার! বাড়ি কিনবেন নাকি বিদেশে?’ ‘না, ইংরেজি শিখতে যাবো।’এমন উত্তর উসমানের মাথায় ঢোকে না। সে মাথা চুলকায় আর ফ্যাল ফ্যাল করে স্যারের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, ‘বড়লোকের মাথা খারাপ সাধে কই। ইংরেজি তো ইউটিউব দেখেই শিহন যায়। আর হে তো এমনেতেই ইংরেজি পারে। আবার কী শিখবো? যাউক, আমার ছুটি পাইলেই হয়।’‘কিরে কী ভাবিস?’‘না স্যার, আপনি বিশ্রাম করেন। আমি চা নিয়া আসি।’ বলে উসমান চলে গেল। রহমান সাহেব মনে মনে হাসলেন।
মাসখানেক পর রহমান সাহেবের তিন মাসের বিদেশ সফর ঠিক হয়ে গেল। বাসায় ফিরতে ফিরতে তিনি ভাবছেন, মনিরাকে সব বলতে হবে। রহমান সাহেবের স্ত্রী মনিরা ঘর-সংসার, কেনাকাটা আর সাজগোজ নিয়েই ব্যস্ত। রহমান সাহেব তার ড্রাইভার জনিকে বললেন, ‘জনি, জ্যাম তো অনেক। কী করবা?’‘স্যার, এসিটা বাড়ায়া দেই আর একটা গান ছেড়ে দেই।’ বলে জনি গান ছেড়ে দিলো—‘আমার একলা আকাশ থমকে গেছে/ রাতের স্রোতে এসে/ শুধু তোমায় ভালোবেসে।’‘শহরটা থেকে যানজট আর যাবে না, বুঝলা জনি। আমরা তো কাজের মানুষ। আমাদের সময়ের মূল্য অনেক।’ বলতে বলতে রহমান সাহেব ঘুমিয়ে পড়েন।
রাতে খাবার টেবিলে বিদেশ সফরের প্রসঙ্গ তোলেন। মনিরা খাওয়া বন্ধ করে বসে আছে। চোখের পানিতে মেকআপ নষ্ট হয়ে গেছে।‘তুমি আমাকে এখন এগুলো বলছো। আমি এতদিন তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।’ ‘আরে এতদিন কোথায়?’‘তিন মাস কি তোমার কাছে কিছু না? যা ইচ্ছে করো।’ বলে মনিরা চলে গেল। রহমান সাহেব জানেন, মনিরার রাগ বেশি ক্ষণ থাকবে না। মনিরা বেশ বুদ্ধিমতী। একা তার সংসারকে বেশ গুছিয়ে রেখেছে। তবে রেগে গেলে মনিরার মাথা একটু এলোমেলো হয়ে যায় এই আর কি।
Advertisement
নভেম্বরের উনিশ তারিখ রহমান সাহেব আমেরিকার উদ্দেশে রওয়ানা দিলেন। এরপর তিন মাসের সফর শেষে ফেব্রুয়ারির উনিশ তারিখে ফিরে এলেন। বিদেশ সফরটি তার জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসূ হলো। অফিসের বেশ কিছু বিদেশি গ্রাহকের সাথে বেশ কয়েকটি নতুন চুক্তিতে সফল হলেন। বিশেষ করে তিনি যে কারণে গিয়েছিলেন, তা পুরোপুরি সফল বলা চলে। ইংরেজি ভাষাটা রহমান সাহেব ভালো রপ্ত করে ফেলেছেন।
রাতে খাবার টেবিলে খেতে খেতে রহমান সাহেব মনিরাকে বললেন—‘ইট ওয়াজ আ ওয়ান্ডারফুল ট্যুর ইউ নো মনিরা। ব্যাসিক্যালি আই ওয়াজ ইন ইউএসএ থ্রি মানথস ফর টু রিজিওনস অ্যান্ড আই হানড্রেড পার্সেন্ট অ্যাসিভ ইট। নাউ আই অ্যাম স্পিকিং ভেরি ফ্লুয়েন্ট লাইক আ ন্যাটিভ স্পিকার। হা হা হা।’মনিরা বলল, ‘তোমার ইংরেজি তুমি অফিসে আর বাহিরে গিয়ে বলবা। আমার সাথে খবরদার ইংরেজিতে কথা বলবা না। আগে যেরকম করে কথা বলতা; সেরকমই ঠিক আছে।’ বলতে বলতে মনিরা উঠে চলে গেল।
রহমান সাহেব একটু বিস্মিত হলেন। ব্যাপারটা আমলে না নিয়ে খাওয়া শেষ করে ঘুমাতে চলে গেলেন। সকালে গাড়িতে যেতে যেতে ড্রাইভার জনির সাথে কথা বলার সময় বাংলার চেয়ে ইংরেজি বেশি বলে ফেললেন। এতে জনির বুঝতে যেমন কষ্ট হলো, উত্তরও ঠিকভাবে দিতে পারলো না। এতে গাড়িও একটু ভুলভাল চালালো।
রহমান সাহেব কথা বলার ধরন পরিবর্তন করেছেন। করাটাও স্বভাবিক। যেহেতু বেশকিছু দিন দেশের বাহিরে ছিলেন। এসব ভাবতে ভাবতে তিনি অফিসে পৌঁছলেন। অফিসে সবার সাথে অনেক দিন পর দেখা ও কথা বলে রহমান সাহেবের বেশ ভালো লাগলো। তবে আজ তিনি অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বের হলেন। সন্ধ্যায় মনিরাকে নিয়ে বের হবেন এবং রেস্টুরেন্টে খাবেন ঠিক করলেন।
ফার্মগেট পার হয়ে বিজয় সরণিতে এসে প্রচণ্ড জ্যামে পড়লেন। প্রায় এক ঘণ্টা পার হয়ে গেছে। জ্যাম ছাড়ছে না। অনেক দিন বাহিরে ছিলেন তাই জ্যামের ব্যাপারটি মাথায় ছিল না। তিনি বেশ অধৈর্য হয়ে গাড়ির গ্লাস খুললেন। এমন সময় এক হকার কিছু বই নিয়ে তার সামনে এলো—‘স্যার একটা প্যাকেজে পাঁচটি উপন্যাস আছে। মাত্র পাঁচশ টাকা, দিবো স্যার?’ ‘নো নিড। ডোন্ট বোধার মি প্লিজ। আই অ্যাম ভেরি অ্যানোয়েড।’ ‘স্যার, একটা বাংলা অভিধান দেবো, মূল্য হ্রাস আছে।’ ‘প্লিজ লিভ মি অ্যালোন। হোয়াই ইউ আর টকিং লাইক আ স্টুপিড। আই ডোন্ট নিড অ্যানি কাইন্ড অব বুক।’ কথাগুলো শুনে চলে যেতে যেতে আবার ফিরে এলো—‘স্যার, দুটো মিনিট একটু কথা বলি। বই বিক্রি প্রসঙ্গে নয়। একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে।’ রহমান সাহেব একটু আশ্চর্য হলেন। তারপর একটু ভেবে বললেন, ‘ওকে।’‘আপনি তো বাঙালি। আপনি খুব ভালো ইংরেজিতে কথা বলেন। বাংলাও নিশ্চয়ই ভালো করে গুছিয়ে বলেন।’রহমান সাহেব বললেন, ‘অফ কোর্স।’ ‘তাহলে স্যার আমরা যারা সাধারণ তাদের সাথে ইংরেজিতে কথা বলার কী প্রয়োজন? আবার দুটো ভাষাকে একসাথে মিশিয়ে বলারই বা কী প্রয়োজন? ভাষা জানার সাথে সাথে তার কোথায় কিভাবে সঠিক ব্যবহার হবে, তা জানা জরুরি নয় কী? যা-ই হোক স্যার, একটু শক্ত ভাষা ব্যবহার করে ফেললাম।’রহমান সাহেব হকারকে থামিয়ে স্পষ্ট বাংলায় বললেন, ‘আমি কখন কোথায় কিভাবে কথা বলবো, তা কি তোমার কাছ থেকে শিখতে হবে! তুমি কিভাবে বলছ যে, আমি ভাষার সঠিক ব্যবহার করছি না কিংবা তুমি কি আদৌ আমার কথা বুঝেছো?’ ‘স্যার, প্রথম কথা হচ্ছে—আমি বুঝতে পেরেছি বলেই আপনাকে বলছি। আপনার জায়গায় আপনি সঠিক এবং আমি আপনাকে ছোট করে কোনো কিছুই বলছি না। আমি শুধু আমার মনের কথাটুকু বলেছি। আপনি এর জন্য বিরক্ত বা ব্যথিত হলে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। সবাই তো আর ইংরেজি বা দুটো ভাষা একসাথে মিশিয়ে বললে বুঝতে পারবে না। তাই আমাদের উচিত যার কাছে যে ভাষাটি বোধগম্য, তার সাথে সে ভাষার সঠিক ব্যবহার করা।’
রহমান সাহেব এবার একটু গভীরভাবে ভাবলেন এবং কথাগুলো যুক্তিসংগত কি না ভাবতে লাগলেন। তিনি হকারকে বললেন, ‘তুমি হলে কী করতে?’ছেলেটি বলতে শুরু করলো, ‘আমি তা-ই করছি। একটু ভেবে দেখুন, আমি একটি ভাষা মানে শুরু থেকেই আমি আপনার সাথে স্পষ্ট বাংলায় কথা বলছি। যতটুকু সম্ভব হয় দুটো ভাষাকে মেশাচ্ছি না। যদিও আমি দুটি ভাষাই খুব ভালো ভাবে জানি। স্যার, আমি মো. রনি, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে পড়ছি। এটি ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। আজ বিশ তারিখ। এ মাসটাতে আমি বই বিক্রি করি। বাংলা ভাষার জন্য যারা জীবন দিয়েছেন, তাদের ত্যাগকে তো আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। এখন আমরা কি ভাষা ব্যবহার করছি, তা নিজেরাও জানি না। বাংলা ও ইংলিশ মিলিয়ে বাংলিশ ভাষা বলা যেতে পারে। আমি নগণ্য মানুষ। বাংলা ভাষা বা ভাষা শহীদের জন্য কিছুই করতে পারবো না জানি। তবুও ভাষার মাসটাতে আমি বাংলা অভিধান ও বিভিন্ন বাঙালি লেখকের বই বিক্রি করি। এতে আমার কিছু অতিরিক্ত উপার্জন হয়। ফেসবুকে ‘প্রতিদিন ইংরেজি’ নামে আমার একটি পেজ আছে। যেখানে আমি সহজে নেটিভ স্পিকারদের মতো কিভাবে ইংরেজিতে কথা বলা যায়, তা নিয়ে ভিডিও করে থাকি। খুব ভালো সাড়াও পেয়েছি। নেটিভদের মতো উচ্চারণটা অনলাইন ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকেই শিখেছি। পাশাপাশি ভাষার ব্যবহারটাও ঠিকভাবে শিখেছি। স্যার, ইংরেজি ভাষাটি প্রয়োজন বলে শিখেছি। বাংলা ভাষার সর্বোচ্চ ব্যবহারের দায়িত্ববোধ থেকে কথাগুলো বললাম। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। ভালো থাকবেন স্যার।’ এক দমে কথাগুলো বলে ছেলেটি দ্রুত অন্য গাড়ির দিকে বই বিক্রি করতে চলে গেল।
রহমান সাহেব কথাগুলো মুগ্ধ হয়ে শুনলেন। ছেলেটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। মনে মনে ভাবলেন, ‘আমরা কি আসলেই ভাষার সঠিক ব্যবহার করি? আমি কাল থেকে ভাষার সঠিক ব্যবহার করেছি কি? মনিরার সাথে আমার স্বাভাবিক কথাই বলা উচিত ছিল। আগের মতো! ড্রাইভার জনির সাথে আমি আসলে কোন ভাষায় কথা বলছি সকাল থেকে? উসমানের সাথেই বা এভাবে কথা কেন বললাম!’ সবকিছুই রহমান সাহেবকে নতুন করে ভাবিয়ে তুললো।
তিনি গাড়ির গ্লাস তুলতে তুলতে জনিকে সুন্দর বাংলায় বললেন, ‘জনি একটা গান ছাড় তো।’ জনি বাংলা শুনে একটু অবাক হলো কিন্তু খুব স্বস্তি বোধ করল এই ভেবে যে, স্যার আগের মতো করেই কথা বলছেন। জনি গান ছেড়ে দিলো—‘আমারো পরানো যাহা চায়, তুমি তাই তাই গো।’ ততক্ষণে জ্যাম ছেড়ে গাড়ি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় পার হচ্ছে।
এসইউ/জেআইএম