আয়নাটার ওপর থেকে চোখ সরছে না ওদের। প্রায় এক ঘণ্টা যাবত আয়নাটার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে ওরা। দোকানের অন্য সব জিনিস দেখার আগ্রহ রীতিমতো হারিয়ে ফেলেছে আয়নাটা দেখার পর থেকে।
Advertisement
ঢাকা শহরে এমন একটি পুরোনো অ্যান্টিকের দোকান যে ওরা খুঁজে পাবে, সেটা ওদের কল্পনার বাইরে ছিল। স্কুল শেষ করে ওরা যাচ্ছিল লালবাগ কেল্লা ঘুরতে। আজকে হাফ পিরিয়ড হয়েই ছুটি। লালবাগ যাওয়ার পথে তখনই ওদের নজরে পরে দোকানটা।
মঈনের আবার একটু অ্যান্টিক প্রাচীন ইতিহাসের ব্যাপারগুলোয় আগ্রহ বেশি। কাজেই সিএনজি থামিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে ওরা। তবে আয়নাটা সব থেকে আলাদা। দুপাশে দুটি ময়ূর। ময়ূরের পেখমে সূক্ষ্ম কারুকাজ। ময়ূরের চোখে লাল রুবি বসানো। হ্যাঁ রুবিই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
মঈন রুবি চিনে পান্না চিনে। সে একশভাগ নিশ্চিত, এটা রুবি। তার চাচা পেশায় প্রত্নতাত্ত্বিক। বর্তমান বাজারে রুবির মূল্য সম্পর্কেও তার ধারণা আছে। কিন্তু এত দামি আয়নাটা কি না এই লোকটা দিচ্ছে একদম জলের দামে।
Advertisement
মঈন বলে, লোকটা হয় পাগল, না হয় মূর্খ আস্ত। এমন জিনিস কেউ এরকম জলের দামে ছেড়ে দেয়।মুক্তা বলে, জলের দামে দিক আর যেই দামেই দিক, আমাদের তা-ও নেওয়ার ক্ষমতা নেই। আমরা হচ্ছি ক্লাস এইট পড়ুয়া ছাত্রছাত্রী। আমাদের বাসা থেকে আব্বা-আম্মা বিশ কি পঞ্চাশ টাকার বেশি হাত খরচ দেয় না। তা-ও সারামাস কি সারাবছর জমিয়েও এ জিনিস কেনা যাবে না। সবাই মিলে যদি জমিয়েও ফেলি, এটা ততদিন দোকানে থাকবে কি না, তার গ্যারান্টি নেই।মঈন গম্ভীর হয়ে বলে, হুম সেটা অবশ্য ঠিক বলেছিস তুই। আমরা স্টুডেন্ট মানুষ, তার ওপর ছোট। সে আমাদের মতো স্কুল ছাত্রদের কাছে এটা বিক্রি করবে বলে মনে হয় না।তবে দীপ্তির মনটা ভেঙে আছে। আয়নাটা ওর খুব বেশিই পছন্দ হয়েছিল কি না। দেখ, এখনো কেমন করে তাকিয়ে আছে।মঈন লক্ষ্য করে দীপ্তি খুব অসহায় ভঙ্গিতে আয়নাটার দিকে তাকিয়ে আছে। পারলে গ্লাস থেকে বের করে ব্যাগে ঢুকিয়ে সাথে করে নিয়ে যায়। মঈন কাছে এসে দীপ্তির কাঁধে হাত রেখে বলে, দীপ্তি, আমার কাছে যদি এখন অতো টাকা থাকতো, আমি শিওর তোকে এটা কিনে দিতাম রে।দীপ্তি চশমার ভেতর থেকে গোল গোল চোখ দিয়ে একবার মঈনকে দেখে আবার শোকেসে রাখা আয়নাটাকে।
২. মঈন আর মুক্তা অবাক মুখ করে দীপ্তির ঘরে বসে আছে। আয়নাটা দীপ্তির ঘরের দেওয়ালজুড়ে শোভা পাচ্ছে। দীপ্তির মুখ জোড়া হাসি। জানিস কী আশ্চর্য কাণ্ড হয়েছে। বাবা সকালে আমার ঘরে এসে বলে দীপ্তি তোর একটা আয়না খুব দরকার তাই না। যে কোনো মূল্যে তোর লাগবে। আমি নিয়ে এসেছি মা। বাবা প্যাকেটটা হাতে ধরিয়ে দিয়েই চলে গেল। আমি খুলে দেখি সেই আয়নাটা। অদ্ভুত, বাবা জানলো কী করে; এটা আমার লাগবেই। অদ্ভুত না বল তোরা?মঈন বললো, সত্যিই অবাক করা ব্যাপার। আংকেল জানলো কী করে? ব্যাপারটা কেমন অস্বাভাবিক লাগছে আমার।মুক্তা বিরক্ত হয়ে বললো, তুই সব কিছুতে বেশি ভাবিস। কিচ্ছু অস্বাভাবিক না। বাবাদের মন এমনই। সন্তানদের মুখ দেখলেই বুঝে যায় কী লাগবে। আমাদের দীপ্তি এখন খুশি এটাই আনন্দের ব্যাপার।
দীপ্তির এখন নিজেকে আগের থেকেও বেশি সুন্দরী মনে হয় আয়নার সামনে দাঁড়ালে। দীপ্তি রোজ নিজেকে আয়নায় দেখে। তার ভালো লাগে। আয়না যেন দীপ্তিকে খুব করে কাছে ডাকে প্রতিদিন। দীপ্তি এখন রোজ তার দিনের বেশিরভাগ সময় আয়নার সামনেই কাটায়। এমনকি মধ্যরাতে উঠেও আয়না দেখে।
মাঝে মাঝে মঈন আসে বাসায় নোটস তুলতে। তখন মঈনকে দীপ্তির মা হেসে হেসে বলে, দেখ তো বাবা, কী আয়না একটা পেলো। সারাদিন ওটার সামনে দাঁড়িয়ে রূপচর্চা করে। এই মেয়েকে কোনদিন কি এমন দেখেছিস তোরা। মঈনের কেমন লাগে ব্যাপারগুলো। তা-ও ঠিক নিশ্চিত হতে পারে না।
Advertisement
একমাস পর দীপ্তি কোচিংয়ে এলে দীপ্তিকে কেউ ঠিক চিনতে পারে না। মুক্তা আঁতকে ওঠে সবার আগে। তোর শরীর এত ভেঙে পড়লো কিভাবে। শুকিয়ে কাঠ হয়েছিস। চোখের নিচে কালি। কিরে, ঠিকমতো রাতে ঘুমাস না? আর একি! চুলও তো বেশ কয়েকটা পেকেছে। ব্যাপার কি বলতো?দীপ্তি ক্লান্ত কণ্ঠে বলে, কিছুই বুঝতে পারছি না। হঠাৎ খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছি। সারাদিন শরীর খুব দুর্বল লাগে। মঈন ভ্রূ কুচকে পরখ করে দীপ্তিকে। তারপর চিন্তিত কণ্ঠে বলে, ডাক্তার দেখিয়েছিস? হুম, বাবা অনেক ভালো ভালো ডাক্তার দেখিয়েছেন কিন্তু কেউ কোনো রোগ খুঁজে পায় না। তাই কিছু ভিটামিন লিখে দিয়ে বিদায় করে দেয়।
মঈন ও মুক্তা একসাথে চিন্তায় পড়ে যায়। দীপ্তির অসুখ দিন দিন বাড়তেই থাকে। দীপ্তির বাবা-মা দুজনই মেয়ের চেহারার এই অবস্থা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
দীপ্তির বাবা ফয়সাল সাহেব মেয়েকে নিয়ে ঢাকার সব থেকে নামিদামি ডাক্তারের কাছে হাজির হন। ডাক্তার সাহেবের ভাষ্যমতে, তার চৌত্রিশ বছরের ডাক্তারি জীবনে এমন কেস কখনো দেখেননি। এমন অল্প বয়সে একজন মানুষ বুড়িয়ে যেতে থাকে। এমন কোনো রেয়ার ডিজিজের নামও আজ পর্যন্ত শোনেননি।
দীপ্তি দিন দিন শীর্ণকায় হতে থাকে। মাথার চুল অর্ধেকই পেকে গেছে এই ক’মাসে। কোচিং-স্কুল সব বন্ধ তার। এদিকে এত অসুস্থতার মধ্যেও দীপ্তি রোজ আয়না দেখতে ভোলে না। ঠিক রাত বারোটার পরই আয়না তাকে পাগলের মতো টানে।
দীপ্তি একরাতে মঈনকে ফোন দেয়। মঈন টেলিফোন হাতে নিয়েই দীপ্তির ভাঙা ভাঙা কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ শুনতে পায়।
মঈন, আয়নাটার মাঝে কিছু আছে রে। অদ্ভুত কিছু। আমাকে সারাদিন পাগলের মতো ডাকে। আমি আয়নায় নিজেকে দেখি। ইস, আমি কত বুড়িয়ে গেছি। দীপ্তি ভাঙা কণ্ঠে হাসতে থাকে। দীপ্তি খবরদার, আয়নার কাছে যাসনে প্লিজ। আয়না দেখিসনে। আয়নাটা ঢেকে রাখ। ঢেকে রাখ।
একসপ্তাহ পর দীপ্তির ঘরে দীপ্তিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। অসুখটা তিলে তিলে তাকে শেষ করেছে। দীপ্তির মাথার চুলগুলো সব গাঢ় ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে। শরীর থেকে যেন কেউ সব রক্ত শুষে নিয়েছে। চোখ অন্ধকার কোটরগত। মুখে বয়সের ছাপ।
আরও পড়ুন নুজহাত জান্নাত ইরার গল্প: প্রতীক্ষা তাইজুল ইসলামের অনুগল্প: দেবী৩. দীপ্তির মৃত্যুর ছয় মাস পর মঈনের কাছে একরাতে মুক্তার ফোন আসে। মুক্তার কণ্ঠ ভয়ার্ত। হ্যালো, হ্যালো মঈন। কোথায় আছিস তুই?আমি তো চাচ্চুর সাথে সিলেট এসেছি। কেন কী হয়েছে? আর এত ভয় পেয়ে আছিস কেন?জানিস, দীপ্তির আয়নাটা না কী করে যেন আমার ঘরের দেওয়ালে চলে এসেছে। আমি খোলার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। মা আমার কথা বিশ্বাস করছে না। বলে, আমি নিজেই আয়না এনে এখন নাটক করছি। আ-আমাকে বাঁচা মঈন।সর্বনাশ! কী বলছিস এসব? দীপ্তির আয়না তোর ঘরে এলো কিভাবে? আমি জানি না। প্রায় কেঁদে ফেলে মুক্তা। আমি জানি না কী করে এলো। বিশ্বাস কর আমার ঘরেই আছে। আমাকে বাঁচা মঈন।মুক্তা মনযোগ দিয়ে শোন। যত কিছুই হোক খবরদার একদম আয়না দেখবি না। ভুলেও আয়নার কাছে যাবি না। আমার কথা বুঝেছিস। একদম আয়নায় নিজেকে দেখবি না। আয়নাটা ঢেকে রাখবি আমি না আসা পর্যন্ত। হ্যালো, হ্যালো মুক্তা... হ্যালো...
দীপ্তির মতো মুক্তাও চলে যায় একইভাবে। শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছিল। মাথার চুল সব গাঢ় ধূসর বর্ণ। শরীর থেকে কেউ যেন সব রক্ত শুষে নিয়েছে।
মঈন সারাদিন শুধু মানসিক যন্ত্রণায় ছটফট করে। নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। সে যদি সেদিন সেই অ্যান্টিকের দোকানটার সামনে গাড়ি না থামাতো, দীপ্তি আর মুক্তা হয়তো আজ বেঁচে থাকতো। অ্যান্টিকের দোকানটায়ও মঈন গিয়েছিল দীপ্তির মৃত্যুর পর পরই খোঁজ করতে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সেখানে একটি বহু বছর আগের ভাঙা পরিত্যক্ত বাড়ি ছাড়া কিছুই ছিল না। মঈন ভীষণ রকম অবাক হয়েছিল।
মঈনের খুব একা লাগে নিজেকে। বাবা গত সপ্তাহ টেলিফোন করে জানিয়েছেন, আগামী বছর অ্যামেরিকা থেকে ছুটিতে দেশে আসবেন। তারপর মঈনকে সাথে করে নিয়ে যাবেন। বাবা ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই তার। ঠিক করে বাবার সাথেই চলে যাবে এবার।
৪.শীতের এক সন্ধ্যায় মঈন লুকিয়ে তাদের জামালপুরের বাগানবাড়িতে চলে আসে। বাড়িটা একদম নির্জন আর অনেকদিন ধরে বন্ধ পড়ে আছে। বাবার ডেস্ক থেকে চাবি চুরি করে নিয়ে এসেছে। তালা খুলে ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে হাঁপাতে থাকে মঈন। আশপাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসতে থাকে শিয়ালের করুণ আর্তনাদ।
দোতালার ঘরে উঠে মোম জ্বেলে খাট থেকে কম্বল নামিয়ে গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে থাকে সে। প্রচণ্ড কান্না পায়। লুকাতে চায় সবার থেকে নিজেকে। কখনোই চায় না বাবা তাকে এ অবস্থায় দেখুক। ধীরে ধীরে রাত বাড়তে থাকে। ঠিক রাত বারোটার সময় উত্তরের বন্ধ ঘরটা থেকে কী যেন প্রবল ভাবে ডাকতে থাকে তাকে।
মঈন অনিচ্ছা সত্ত্বেও কাঠের লম্বা টানা বারান্দাটা পেরিয়ে উত্তরের বন্ধ ঘরের দিকে এগিয়ে যায়। ঘরটির তালা কে যেন খুলে রেখেছে আগে থেকে। যেন আগে থেকেই অপেক্ষা করে আছে কেউ মঈনের জন্য। মঈন ঘরের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখে দেওয়ালজুড়ে বিশাল একটি আয়না। দুপাশে দুটি ময়ূর লেজ ঝুলিয়ে আছে। ময়ূরের চোখে লাল রুবি। ময়ূরের চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। যেন ভেতরে ঢুকে কলজে খাচ্ছে।
সেই আয়নাটি। যারাই আয়নাকে পছন্দ করে, আয়নারও তাদের পছন্দ হয়। তারপর নিজের মধ্যে টেনে নেয় একটু একটু করে।
দীপ্তিকে নিয়েছে, মুক্তাকে নিয়েছে। এখন মঈনের পালা। মঈন আয়নার মধ্যে নিজেকে দেখে। চোখের নিচে কালি জমেছে। এ কয়টা দিনে অনেকটাই বুড়িয়ে গেছে সে। মাথার অর্ধেক চুল পেকে ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে। ভয়ার্ত দৃষ্টিতে নিজেকে দেখতে থাকে।
মঈনের প্রতিবিম্বটির আড়ালেও আরেকটি প্রতিবিম্ব আছে আয়নার অপর পাশে, যাকে মঈন দেখতে পাচ্ছে না। হাজার বছরের ক্ষুধা তার চোখে মুখে। নরকের কীট থেকেও নিকৃষ্ট কদাকার সে। সাপের মতো লোভে লক লক করে তার জিহ্বা।
এসইউ/জিকেএস