রাজধানীর ঢাকার ফুসফুস হিসেবে পরিচিত রমনা পার্ক। দূষিত ঢাকার বুকে বিশুদ্ধ বাতাস আর প্রশান্তির আয়োজন করে বসে আছে সবুজ-শ্যামল পার্কটি। সতেজ বাতাস ও মনোরম পরিবেশের স্বাদ নিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশ্রাম নিতে ও ঘুরাঘুরি করতে আসেন দর্শনার্থীরা। যান্ত্রিক শহরে শিশু থেকে বৃদ্ধ, সব বয়সী মানুষের প্রশান্তির স্থান রমনা পার্ক।
Advertisement
৬৮ দশমিক ৫ একর আয়তনের পার্কটিতে রয়েছে ৮ দশমিক ৭৬ একর জায়গা নিয়ে একে-বেঁকে বয়ে চলা লেক। এছাড়া বিরল প্রজাতির বিভিন্ন গাছ-গাছালির সমারোহসহ প্রাকৃতিক বাতাসে বিশ্রাম নেওয়ার অসংখ্য স্থান রয়েছে পার্কজুড়ে। চাইলেই ছোট ছোট বোটে চড়ে লেকে ভেসে বেড়ানোর সুযোগও মিলে পার্কটিতে। পার্কটি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে সরকারের গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়।
বুধবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সরেজমিনে রমনা পার্কে দেখা যায়, পার্কটির প্রধান ফটক পেরিয়ে কিছু দূর এগোলেই নির্দেশিকা সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড। সেখানে কফি কর্নার, রমনা বটমূল, লেক, উত্তর প্রান্ত, শিশু চত্বর, টয়লেটের স্থানের নির্দেশনা দেওয়া রয়েছে। একটি মানচিত্রের মাধ্যমে পার্কটির বিস্তারিত দেখানো হয়েছে। তুলে ধরা হয়েছে পার্কটির সব তথ্য।
দর্শনার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে রয়েছে একাধিক সিসি ক্যামেরা। আর কিছু দূর এগোলে দেখা যাবে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের সমাহার। যেখানে অপরিচিত গাছের সঙ্গে পরিচিত করে দিতে রয়েছে বিস্তারিত তথ্য।
Advertisement
ছোট্ট একটি পার্কের আদলে সাজানো রয়েছে শিশু কর্নার। এখানে শিশু-কিশোরদের আনন্দ-খেলাধুলার জন্য নানা উপকরণ রয়েছে। যেমন- দোলনা, স্লিপার, ঢেঁকিকল, স্প্রিং চেয়ারসহ নানান রাইড।
ছেলেকে নিয়ে পার্কের শিশু কর্নারে আসা মহসীন নামে একব্যক্তি বলেন, এখানে বাচ্চাকে নিয়ে আসার একটাই কারণ শহরের মধ্যে এমন প্রাকৃতিক পরিবেশ আর নেই। বাচ্চারা আনন্দ-খেলাধুলা করতে পারছে। মুক্ত পরিবেশে পরিচিত করানোর জন্যই মূলত এখানে আসা।
বয়স্কদের শরীরচর্চার জন্য পার্কের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন উপকরণ রয়েছে। রয়েছে অসংখ্য ওয়াকওয়ে।
লেকে শখের নৌভ্রমণ৮ দশমিক ৭৬ একর জায়গা নিয়ে একে-বেঁকে বয়ে চলা লেকটির বুকে ভেসে বেড়ানোর জন্য রয়েছে অসংখ্য ছোট ছোট বোট। এতে ঘণ্টা চুক্তিতে ভাড়া নিয়ে ভেসে বেড়ানো যায় লেকটিতে। তবে অভিযোগ রয়েছে ভাড়া বেশির। মাত্র ৩০ মিনিটের জন্য গুনতে হচ্ছে ২০০ টাকা।
Advertisement
লেকে পরিবার নিয়ে নৌভ্রমণ করা একজনের সঙ্গে কথা হলে বলেন, মাত্র ৩০ মিনিটের জন্য ২০০ টাকা পরিশোধ করতে হয়। ভাড়া অনেকটা বেশি। ৩০ মিনিটে লেকের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত ঘুরে আশা যায় না।
লেকের গা ঘেঁষে ওয়াকওয়েকাঠ ও লোহা দিয়ে লেকের গা-ঘেঁষে তৈরি করা হয়েছে ওয়াকওয়ে। যা দিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হেঁটে বেড়ানো যায়। ওয়াকয়ে দাঁড়িয়ে ছবি তোলাই বড় আকর্ষণ। দর্শনার্থীরা এখানে দাঁড়িয়ে ছবি তোলেন। এছাড়া পার্কটির বিভিন্ন স্থানে রয়েছে দেশি–বিদেশি রংবেরঙের ফুল। যা দর্শনার্থী আকৃষ্টে অন্যতম।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, উদ্যানটি ১৬১০ সালে মোঘল আমলে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেই সময়ে রমনার পরিসীমা ছিল বিশাল এলাকাজুড়ে। মোঘলরাই রমনার নামকরণ করেন। পুরানো হাইকোর্ট ভবন থেকে আগের সড়ক ভবন পর্যন্ত মোঘলরা বাগান তৈরি করেছিলেন। কিন্তু পরে কোম্পানি আমলে এ এলাকা জঙ্গলে পরিণত হয়। ১৮২৫ সাল থেকে ব্রিটিশ কালেক্টর ডাউইজের সময় ঢাকা নগর উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। যার অন্যতম ছিল রমনা এলাকার উন্নয়ন। এ সময় এলাকার একটি অংশ ঘেরাও করে রেসকোর্সের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আর অন্য অংশটিকে রমনা গ্রিন নাম দিয়ে যাত্রা শুরু করে আজকের রমনা পার্ক। এ সময় ঢাকার নবাব পরিবার এখানে একটি রাজকীয় বাগান তৈরি করেন যার নাম দেওয়া হয় ‘শাহবাগ’।
বর্তমানে রমনা পার্কে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান হয়। রমনার বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এখন অনেক জনপ্রিয়। রাজধানীতে প্রাতর্ভ্রমণের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র রমনা পার্ক। এটি ‘ঢাকার ফুসফুস’ হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে এখানে হাঁটতে ও ব্যায়াম করতে আসেন কয়েক হাজার মানুষ।
উদ্ভিদ প্রজাতির সংখ্যারমনা পার্কে বর্তমানে উদ্ভিদ প্রজাতি ২১১টি। এর মধ্যে ফুল ও শোভাবর্ধক প্রজাতির সংখ্যা ৮৭টি, ফলজাতীয় উদ্ভিদ ৩৬টি, ঔষধি প্রজাতি ৩৩টি, কৃষি বনায়নের উদ্ভিদ প্রজাতি তিনটি, বনজ উদ্ভিদ প্রজাতি দুটি, জলজ উদ্ভিদ প্রজাতি দুটি ও মশলা উদ্ভিদ প্রজাতি তিনটি।
বিরল প্রজাতির গাছরমনা পার্কে বেশকিছু বিরল প্রজাতির গাছ রয়েছে। এর কয়েকটি হলো- পাদাউক, পলাশ, ধারমার, কাউয়াতুতি (বন-পারুল), আগর, জ্যাকারান্ডা, তমাল, বাওবাব, গ্লিরিসিডিয়া, কর্পূর, স্কারলেট কর্ডিয়া, জহুরি-চাঁপা, ক্যাসিয়া জাভানিকা, মাধবী, মালতী, আফ্রিকান টিউলিপ, কেয়া, অশোক, ট্যাবেবুইয়া, পাখিফুল, কফি, হিমচাঁপা, সহস্র বেলি, গোল্ডেন শাওয়ার, কাউফল, ঝুমকো, লতা পারুল, স্থলপদ্ম, মহুয়া, কুর্চি, বন আসরা, চন্দন, মাকড়িশাল, দুলিচাঁপা, কনকচাঁপা ও অঞ্জন ইত্যাদি।
কেআর/এমএএইচ/এমএস