অর্থনীতি

পুরান ঢাকার সুগন্ধি ব্যবসা এখন শতকোটি টাকার

পুরান ঢাকার মানেই ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির মেলবন্ধন। যার সঙ্গে জড়িয়ে শত শত বছরের ব্যবসা-বাণিজ্যও। নবাবি কিংবা ব্রিটিশ শাসনামলে অবাঙালিরা আসতো এখানে ব্যবসার পসার জমাতে। দেশ বিভাগের কয়েক বছর আগে ভারতের মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের হাত ধরে পুরান ঢাকার মিডফোর্ডে গড়ে ওঠে সুগন্ধির কারবার। ৮০ বছরে এখন সেটি শতকোটি টাকার বাজার।

Advertisement

আর্মেনিয়ান চার্চ সংলগ্ন পুরান ঢাকার বাবুবাজার রোড থেকে মিডফোর্ডের দিকে যে সোজা রাস্তাটা চলে গেছে তার দু-পাশে রয়েছে কয়েকশ সুগন্ধির দোকান। এই রাস্তা দিয়ে হাঁটলে অন্যরকম এক অনুভূতি হয়। হরেক রকম সুগন্ধির সুবাসে মৌ মৌ করে চারপাশ।

ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় কয়েকজন পুরোনো ব্যবসায়ীর সঙ্গে। তাদের কাছ থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে সুগন্ধি ব্যবসা প্রায় শত বছরের পুরোনো। নানা রঙের কাচের বোতলে থরে থরে সাজানো সুগন্ধির এটিই ঢাকাসহ সারাদেশের একমাত্র পাইকারি বিক্রয়কেন্দ্র। স্থানীয়দের মতে, গত শতকের চল্লিশের দশকে অবাঙালি ব্যবসায়ীরা এখানে প্রথম সুগন্ধির কারবার শুরু করেন।

আমার কাছে ৬০০ রকমের বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের সুগন্ধি আছে। রোজার ঈদ সামনে রেখে আমরা নতুন আরও ১০০ ঘ্রাণের সুগন্ধি আমদানি করেছি।– দোকানি মো. মহসিন মিয়া

Advertisement

ভারতের মাড়োয়ারিদের হাত ধরে পুরান ঢাকায় শুরু হয় সুগন্ধির কারবার। দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ, চেন্নাই, পাটনা থেকে ঢাকায় ব্যবসা করতে আসেন তারা। শুরুর দিকে হাতে গোনা কয়েকটি দোকান থাকলেও এখন পাঁচ শতাধিক অ্যালকোহলবিহীন সুগন্ধির দোকান রয়েছে মিটফোর্ডে।

আরও পড়ুন দেশে উৎপাদিত প্রসাধনীতে করের বোঝা, আমদানিতে ছাড় আসল-নকল চেনা দায়, প্রসাধনীর বাজারে নজর নেই বিএসটিআইয়ের দেশে প্রসাধনীর বড় বাজার, কালোবাজারিতে কম রাজস্ব

ওটিস পারফিউম হাউজ মিটফোর্ড এলাকার প্রথম সুগন্ধির দোকান। ১৯৪৫ সালে ভারতের মাদ্রাজ থেকে আগত ব্যবসায়ী কেপি মুহাম্মদের হাতে যা প্রতিষ্ঠিত হয়। মুহাম্মদের বাবার কলকাতায় সুগন্ধির ব্যবসা ছিল। সেখান থেকে ঢাকায় এসে ব্যবসার পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়ে তিনি এখানে স্থায়ীভাবে ব্যবসা শুরু করেন।

ব্যবসায়ীদের মতে, বাংলাদেশের পারফিউম শিল্পের বাজার প্রায় ১০০ কোটি টাকার বেশি। উচ্চবিত্তের পাশাপাশি সব ধরনের শ্রেণির মানুষ সুগন্ধি ব্যবহার করেন। ক্রমে এই বাজার বাড়ছে।

মিটফোর্ড টাওয়ারের নিচতলায় অবস্থিত আরিয়ান করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী মো. মহসিন মিয়া গত ১২ বছর ধরে সুগন্ধির ব্যবসা করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার কাছে ৬০০ রকমের বিদেশি নামিদামি ব্র্যান্ডের সুগন্ধি আছে। রোজার ঈদ সামনে রেখে আমরা নতুন আরও ১০০ ঘ্রাণের সুগন্ধি আমদানি করেছি।’

Advertisement

‘আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সুগন্ধি আমদানি করি। যেমন- মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ বিশেষ করে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ফ্রান্স, ইতালি, ইংল্যান্ড উল্লেখযোগ্য। আমরা এখানে পাইকারি ও খুচরা পণ্য বিক্রি করি। আমাদের কাছে নারী, পুরুষ, ইউনিসেক্সসহ সব ধরনের সুগন্ধি পাওয়া যায়।’ যোগ করেন তিনি।

মহসিন আরও বলেন, ‘আমাদের সুগন্ধি বিশ্বের নামিদামি যত ব্র্যান্ড আছে যেমন- গুচি, সেনেল, বুলগেরি, লুই ভিটন, কেল্ভিন ক্লেইন, আরমানি, হুগো বস, ভারসাচি, গিভেঞ্চি ইত্যাদির সঙ্গে ৯৪-৯৫ শতাংশ ম্যাচিং হয়।’

রাজধানীর মেরুল বাড্ডা থেকে সুগন্ধি কিনতে এসেছেন রাহিব খান। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি পাঁচ বছর ধরে নিয়মিত এখানে আসি। প্রতি বছর ঈদের আগে এখানে আসা হয়। পৃথিবীর বিখ্যাত যত ব্র্যান্ড আছে সব ব্র্যান্ডের পারফিউম এখানে পাওয়া যায়। আমি বুলগেরি ম্যান, গিভেঞ্চি, সেনেল ব্র্যান্ডের ১০ শিশি আতর কিনেছি।’

বাংলাদেশে পারফিউমের বাজার এখন প্রায় ১০০ কোটি টাকার অধিক এবং প্রতিনিয়ত এটি বাড়ছে। ধনিক শ্রেণির পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও এখন পারফিউম ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশে বেশির ভাগ পারফিউম ভারত, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্য, সুইজারল্যান্ড থেকে আমদানি করা হয়।- বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিলন

মুঞ্জিয়া ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী মুহাম্মদ মামুন জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে ঢাকার বাইরে থেকেও অনেক মানুষ সুগন্ধি কিনতে আসেন। আপনি ঢাকার যে কোনো দোকানে আমাদের সুগন্ধি পাবেন। অনেকে কস্তুরি, কাঁচা ফুলের সুগন্ধি খোঁজেন, যা আমাদের কাছে রয়েছে।’

‘আমাদের এখানে ৫০-৩০০ মিলি লিটার পর্যন্ত শিশি আছে। সুগন্ধিভেদে প্রতি মিলি লিটার সুগন্ধির দাম ২০-৫০ টাকা। এছাড়া স্পেশাল আগর কাঠ, কস্তুরি, রেড উড, ব্ল্যাক উডের সুগন্ধিও পাওয়া যায়, যার দাম প্রতি মিলি লিটার ৫০০-২০০০ টাকা।’

মামুন বলেন, ‘পাশাপাশি ইদানীং পকেট পারফিউমের চাহিদা অনেক বেড়েছে। ৬ মিলি লিটার থেকে ৩০ মিলি লিটার পর্যন্ত এসব সুগন্ধির দাম ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।’

এই দোকানে কাঁচা বেলি ফুলের আতর কিনতে এসেছেন আজাহার ইসলাম নামে একজন ব্যবসায়ী। তিনি বলেন, ‘আমি পাকিস্তান আমল থেকে কাঁচা বেলি ফুলের আতর ব্যবহার করি। তখন সৌদি আরব থেকে আসা আসল কাঁচা বেলি ফুলের আতর পাওয়া যেত। কিন্তু ইদানীং সেটা আর পাচ্ছি না। তাই এখান থেকে এক শিশি আতর নিলাম, ভালো হলে আবার নেবো।’

এখান থেকে পাইকারি আতর কিনে অনেকে অনলাইন মার্কেটপ্লেসে বিক্রি করেন। তেমন একজন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ইফতেখার আহমেদ জয়। তার অনলাইন ফেসবুক পেজের নাম অ্যারোমেটিকা।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি গত বছর এই ব্যবসা শুরু করি। এখন আমার ফেসবুকে কোনো বুস্ট ছাড়া মাসিক সেল প্রায় ১৫-২০ হাজার টাকা, আর বুস্টিং করলে মাসে এক থেকে দেড় লাখ টাকা সেল করা সম্ভব। আমি মূলত এখান থেকে পাইকারি সুগন্ধি কিনে অনলাইনে খুচরা বিক্রয় করি। সব মিলিয়ে ভালোই সাড়া পাচ্ছি।’

ফরচুন বিজনেস ইনসাইটের তথ্যমতে, বৈশ্বিক পারফিউম বাজারের আকার প্রায় ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ৩ দশমিক ৭ শতাংশ হারে বাড়ছে। ২০৩২ সালে যা ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হতে পারে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিলন জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাংলাদেশে পারফিউমের বাজার এখন প্রায় ১০০ কোটি টাকার অধিক এবং প্রতিনিয়ত এটি বাড়ছে। ধনিক শ্রেণির পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও এখন পারফিউম ব্যবহার করছেন। বাংলাদেশে বেশির ভাগ পারফিউম ভারত, ফ্রান্স, মধ্যপ্রাচ্য ও সুইজারল্যান্ড থেকে আমদানি করা হয়।’

এসআরএস/এএসএ/এএসএম