বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের নিজেদের আচরণ, চিন্তা এবং কর্মেরই প্রতিফলন। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, ভেজাল খাদ্য, সামাজিক অশ্লীলতা, ধর্মীয় দ্বৈততা এবং অর্থ পাচারের মতো সংকটগুলো মূলত আমাদের নৈতিক অবক্ষয়ের ফল। আমরা প্রায়ই দেশের পরিবর্তনের কথা বলি, কিন্তু কখনো কি নিজেদের দিকে তাকাই? পরিবর্তন আনতে হলে আগে আমাদের নিজেকেই সংশোধন করতে হবে।
Advertisement
কোনো জাতির উন্নয়ন তখনই সম্ভব, যখন তার নাগরিকরা নিজেদের নৈতিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে। যদি আমরা নিজেরা সৎ, নৈতিক এবং দায়িত্বশীল হতে না পারি, তবে কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। দেশের প্রতিটি স্তরে যে অস্থিরতা, বিভাজন এবং সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা কেবল ব্যক্তিগত এবং সামাজিকভাবে আত্মউন্নতির মাধ্যমেই প্রতিরোধ করা সম্ভব।
পারিবারিক দ্বন্দ্ব এবং সম্পত্তি বণ্টন
বাংলাদেশে পারিবারিক সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে যে সমস্যাগুলো দেখা যায়, তা সমাজের একটি গভীর সমস্যার পরিচায়ক। অনেক পরিবারে ইসলাম ধর্মের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও সম্পত্তির সঠিক বণ্টন হয় না। এর ফলে ভাই-বোনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অশান্তি বাড়ছে, যা পারিবারিক শান্তি ও সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্ট করছে। পারিবারিক ঐক্য ভেঙে গেলে এর প্রভাব শুধু পরিবারেই সীমাবদ্ধ থাকে না; এটি সমাজের সামগ্রিক স্থিতিশীলতায় আঘাত হানে।
Advertisement
দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা
প্রশাসনের দুর্নীতি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে ধ্বংস করছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—প্রত্যেকেই সুবিধাভোগের উদ্দেশ্যে দুর্নীতির জালে জড়িয়ে পড়ছে। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে ভোট কেনাবেচা ও ক্ষমতার অপব্যবহার জাতিকে নেতৃত্বের সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করছে। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব উঠে আসতে না পারলে উন্নয়ন অন্ধকারেই থেকে যাবে।
ভোট বিক্রি: ভবিষ্যৎ বিক্রি
গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো ভোট বিক্রি। সস্তা সুবিধার লোভে অনেকেই নিজেদের ভোটের মূল্য বিকিয়ে দেন। এর ফলে সৎ এবং দক্ষ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ হারিয়ে যায়। জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে আমরা ভবিষ্যৎকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছি।
Advertisement
ভেজাল খাদ্য এবং জনস্বাস্থ্য
বাংলাদেশে ভেজাল খাদ্য একটি ভয়াবহ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যবসায়ীরা মুনাফার জন্য মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। ভেজাল খাদ্যের কারণে জনস্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে এবং সমাজে অসন্তোষ বাড়ছে। জনস্বাস্থ্যের এই অবক্ষয় সামগ্রিকভাবে দেশের অগ্রগতিকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
ধর্মীয় দ্বৈততা এবং ভণ্ডামি
বাংলাদেশে ধর্মীয় ভণ্ডামি ও দ্বৈত আচরণ ক্রমশ বাড়ছে। কেউ কেউ বাহ্যিকভাবে ধার্মিকতার চর্চা দেখিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছেন। এরা ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করছেন এবং বিভাজনের বীজ বপন করছেন। ধর্মীয় অনুশাসন কখনো বিভেদ বা প্রতারণার জন্য নয়; এটি মানবতার কল্যাণ এবং ঐক্যের প্রতীক।
অজ্ঞতা, ভণ্ডামি ও ধর্মের নামে প্রতারণা: পিছিয়ে পড়ার আরেক কারণ
বাংলাদেশের পিছিয়ে পড়ার কারণ শুধু দুর্নীতি, অনৈতিকতা বা স্বৈরশাসন নয়; এর পেছনে আরও গভীর সমস্যা রয়েছে—ধর্মের নামে প্রতারণা, অজ্ঞতা ও ভণ্ডামি। লাখো মানুষ ধর্মের শুদ্ধ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কারণ কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করছে। এদের কারণে সমাজে বিভ্রান্তি ও বিভাজন বাড়ছে। এ ধরনের জঘন্য অপরাধ থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের সচেতন হতে হবে এবং ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধের চর্চা নিশ্চিত করতে হবে।
অর্থ পাচার: দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার
যখন দেশের অনেক মানুষ দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করছে, তখন কিছু মানুষ বিপুল সম্পদ বিদেশে পাচার করছে। এই অর্থ পাচার কেবল দেশের অর্থনীতিকেই দুর্বল করছে না, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন করছে। অর্থ পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়বে।
দেশের ভাবমূর্তি এবং আন্তর্জাতিক সংকট
দেশের অভ্যন্তরে সমস্যা থাকলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সুনাম নষ্ট করার চেষ্টাও চলছে। কিছু গোষ্ঠী দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে হাতিয়ার করে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। এই পরিস্থিতি সামলাতে হলে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে এবং জাতির স্বার্থে আন্তরিক হতে হবে।
সংস্কার: সবার আগে আত্মশুদ্ধি
সংস্কার কোনো একদিনে অর্জিত হয় না, এটি প্রতিটি নাগরিকের নিজস্ব প্রচেষ্টা এবং দায়িত্ববোধের ওপর নির্ভর করে। নিজেরা সৎ এবং নৈতিক না হলে, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় কোনো সংস্কারই সফল হবে না। সমাজের প্রতিটি স্তরে দায়িত্বশীলতা এবং নৈতিকতার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রকৃত পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন প্রতিটি নাগরিক নিজেদের পরিবর্তন করতে প্রস্তুত হবে। নিজেদের ভেতরের দুর্নীতি, অসততা এবং দায়িত্বহীনতা দূর করাই হবে প্রথম পদক্ষেপ।
উপসংহার
বাংলাদেশ আজ এক গভীর সংকটের মধ্যে রয়েছে। দুর্নীতি, অশ্লীলতা, ধর্মীয় ভণ্ডামি, অর্থ পাচার, ভেজাল খাদ্য, এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা দেশের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এসব সমস্যার সমাধান করতে হলে প্রয়োজন দায়িত্বশীলতা, আত্মশুদ্ধি এবং সৎ পথে এগিয়ে চলার সংকল্প।
আমাদের নিজেদের চরিত্রে পরিবর্তন আনতে হবে এবং ধর্মীয় ও সামাজিক শৃঙ্খলার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। একমাত্র নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করেই আমরা বাংলাদেশকে একটি উন্নত ও আলোকিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে নিতে পারি।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)Rahman.Mridha@gmail.com
এমআরএম/এএসএম