২০১২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) খুন হন দুই শিবির নেতা। প্রকাশ্য দিবালোকে তাদের কুপিয়ে হত্যা করা হয়। খুন হওয়া মুজাহিদুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের এবং মাসুদ বিন হাবিব ইংরেজি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তবে আলোচিত দুই শিবির নেতা হত্যার বিচার হয়নি ১৩ বছরেও। উল্টো হত্যার আসামি ছাত্রলীগ নেতাদের বাঁচাতে মামলা নিষ্পত্তি করে দেওয়া হয়।
Advertisement
জানা যায়, ঘটনার দিন ক্লাস রুমে ছাত্রলীগ কর্মী শাহীন ও শিবির কর্মী আল আমিনের মধ্যে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বাগবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে শাহীন ছাত্রলীগের নেতাদের কল করে একত্রিত করে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কলার ঝুপড়িতে দুজন শিবির কর্মীকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে জখম করে।
ঘটনার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ লাগে শিবির ও ছাত্রলীগের মধ্যে। দফায় দফায় চলা সংঘর্ষে ছাত্রলীগ অবস্থান নেয় জিরো পয়েন্ট মসজিদের সামনে। অন্যদিকে শিবির নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয় শাহজালাল হলের সামনে। ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা এলোপাতাড়ি গুলি করলে পায়ে গুলিবিদ্ধ হন শিবির কর্মী জাহাঙ্গীর আলম। এ সময় প্রশাসনের আদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ নম্বর গেট এলাকায় জড় হয় অসংখ্য পুলিশ। হঠাৎ করেই শিবির কর্মীদের ওপর লাঠিচার্জ করে পুলিশ। পুলিশের লাঠিচার্জ দেখে জিরো পয়েন্ট থেকে গুলি ছুড়ে আক্রমণ করে ছাত্রলীগ নেতারা। মাঝখানে আটকে পড়েন শিবিরের কর্মীরা। ছাত্রলীগের গুলিতে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন মুজাহিদ। চাপাতি ও রামদা দিয়ে এলোপাতাড়ি কোপানো হয় তার মাথা ও সমস্ত দেহে।
মুজাহিদকে কোপাচ্ছে দেখে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন মাসুদ। এসময় মাসুদকেও উপর্যুপরি রামদার আঘাত করা হয়। আহত মাসুদ ও মুজাহিদকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য পাওয়া যায়নি অ্যাম্বুলেন্স। অনেক রক্তক্ষরণের পরে চট্টগ্রাম মেডিকেলে নেওয়া হলে ডাক্তাররা তাদের মৃত ঘোষণা করেন। সবার সামনে এ হত্যাকাণ্ড ঘটলেও ছাত্রলীগের কাউকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। উল্টো হত্যার দায় শিবিরের ওপর দিয়ে তৎকালীন শিবির নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়। ঘটনা আড়াল করতে ন্যাকারজনক কাণ্ড করে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিবির সভাপতি মুজাহিদকে নিজেদের কর্মী দাবি করে হত্যা মামলা করেন তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা মাহমুদুল হাসান তুষার। মামলায় ৪৪ জন শিবিরের নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। অন্যদিকে হত্যার চারদিন পরে মুজাহিদের বাবা হুমায়ুন কবির ছাত্রলীগের তৎকালীন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক কাজী তানজীম হোসেন, জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আবুল মনসুর সিকদার, সহ-সভাপতি সাফায়েত বিল্লাহ, সহ-সভাপতি ও বর্তমান চবি শিক্ষক রন্টু দাশসহ ৪২ জনকে আসামি করে আদালতে মামলা করেন। কোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১০ মে হাটহাজারী থানা পুলিশ শিবিরের ৪৪ জন ও ছাত্রলীগের ৪২ জনসহ ৮৬ জনকে মামলার আসামি বিবেচনা করেন। মামলাটি প্রথমে তদন্ত করে হাটহাজারী থানা পুলিশ। তবে ঘটনার চারমাস পর তদন্তের দায়িত্ব নেয় অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। দীর্ঘদিন পর ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে ৮৬ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে সিআইডি।
Advertisement
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডি চট্টগ্রাম অঞ্চলের তৎকালীন পরিদর্শক মিতশ্রী বড়ুয়া তখন গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, ছাত্রলীগ-শিবিরের সংঘর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্র খুন হয়েছেন সত্য, কিন্তু এ খুনের ঘটনায় কোনো সাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। খুনিদের শনাক্ত করা না গেলে এবং সাক্ষী না পেলে কাদের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
তৎকালীন মানবজমিন পত্রিকার সাংবাদিক ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী আবু বকর ছিদ্দিক রাহাত জাগো নিউজকে জানান, শিবির শাহজালাল হলের একটু সামনে অবস্থানরত ছিল। আর ছাত্রলীগ জিরো পয়েন্ট মসজিদের সামনে। তৎকালীন হাটহাজারী সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার বাবুল আক্তার এক নম্বর গেইটের দিক থেকে এসে লাঠিচার্জ করা শুরু করে। মাঝখানে আটকে পড়া তখন শিবিরের একটি অংশ কটেজের দিকে অন্য অংশ পাহাড়ের দিকে পালাতে যায়। ঠিক এসময় ছাত্রলীগের কয়েকজন এসে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে জখম করে শিবিরের দুজনকে। এর আগেও চবিতে ছাত্র হত্যার ঘটনা ঘটেছে যেগুলো কোনটার বিচার হয়নি। বিচার হলে এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো না।
এ ব্যাপারে ছাত্রশিবির বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতি (ঘটনার সময় সাংগঠনিক সম্পাদক) মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজ কে বলেন, প্রকাশ্যে শতশত মানুষের সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডের স্পষ্ট ছবি ও ভিডিও ফুটেজ আছে। কিন্তু তারপরও পুলিশ নাকি কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি। মূলত চিহ্নিত ছাত্রলীগ ক্যাডারদের বাঁচাতে পুলিশ এ নাটক মঞ্চায়ন করে। আমরা মুজাহিদ ও মাসুদ হত্যাকাণ্ডের মামলা নিয়ে কাজ করছি।
মামলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহাদাত হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের রক্ষা করার জন্য আদালত তখন সব আসামিকে অব্যাহতি দেয়। রায়ে ন্যায়বিচার করা হয়নি। অসংখ্য মানুষের সামনে দুজন শিক্ষার্থীকে খুন করা হয়েছে আর কাউকে দোষী পাওয়া যায়নি যেটা অকল্পনীয়।
Advertisement
আহমেদ জুনাইদ/এমএস