প্রবাস

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের শেকড়

বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে, রাজতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্রের জন্য নয়। ১৯৭১ সালে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেয়েছি, যার ভিত্তি ছিল গণতান্ত্রিক চেতনা। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকেই দেশের রাজনীতি পরিবারতন্ত্রের শৃঙ্খলে বন্দি হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—উভয় দলই নেতৃত্বকে নিজেদের পরিবারকেন্দ্রিক করে তুলেছে, যা প্রকৃত গণতন্ত্রের পথে বড় বাধা।

Advertisement

বিশ্বের অন্যান্য দেশেও রাজনৈতিক পরিবারতন্ত্রের উদাহরণ ছিল। আমেরিকায় কেনেডি পরিবার ও বুশ পরিবার, ভারতে গান্ধী পরিবার, পাকিস্তানে ভুট্টো পরিবার একসময় ক্ষমতায় প্রভাব বিস্তার করেছিল। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনগণের রায়ের মাধ্যমে তারা ক্ষমতা থেকে সরে গেছে, বা প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অথচ বাংলাদেশ এখনো পরিবারতন্ত্রের অভিশাপ থেকে বের হতে পারেনি।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের শেকড়বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হয়। কিন্তু একপর্যায়ে দেশে একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়, যা জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক পরিবর্তন এলেও, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে দেশ ক্রমাগতভাবে পরিবারতন্ত্রের দিকে ধাবিত হয়।

আওয়ামী লীগের পরিবারতন্ত্রশেখ মুজিবের মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব চলে যায় তার কন্যা শেখ হাসিনার হাতে। দীর্ঘ শাসনকালে তিনি দলীয় রাজনীতিকে পরিবারের ভেতরে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন। প্রশাসন, অর্থনীতি ও নীতিনির্ধারণে শেখ পরিবারের সদস্যদের প্রভাব সুস্পষ্ট। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব নিয়েও দলীয় সিদ্ধান্ত শেখ পরিবারেই সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে।

Advertisement

বিএনপির পরিবারতন্ত্রবিএনপিও একই ধাঁচে পরিচালিত হচ্ছে। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্বে আসেন। পরবর্তীতে তারেক রহমান ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকার হিসেবে আবির্ভূত হন। বিএনপির রাজনীতি এখন তারেক রহমানের চারপাশে আবর্তিত, যার প্রমাণ সাম্প্রতিক ঘটনা। সদ্য যুক্তরাষ্ট্রের এক অনুষ্ঠানে বিএনপির শীর্ষ তিন নেতা আমন্ত্রিত হয়েছিলেন, কিন্তু তারেক রহমান অনুপস্থিত থাকায় বিএনপির অন্য কোনো নেতা সেখানে যাননি। বরং অংশগ্রহণ করেছেন তারেক রহমানের মেয়ে। এটি স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে বিএনপি দলীয় নেতৃত্বকে শুধুমাত্র জিয়া পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।

বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র বনাম গণতন্ত্রআমেরিকায় কেনেডি ও বুশ পরিবার একসময় রাজনীতিতে শক্তিশালী প্রভাব বিস্তার করলেও, তারা কখনো দলীয় নেতৃত্ব এককভাবে নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেনি। সেখানে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতা বিদ্যমান ছিল এবং জনগণের রায়ের ভিত্তিতেই তারা ক্ষমতায় এসেছে বা হারিয়েছে।

ভারতে গান্ধী পরিবার একসময় ক্ষমতাধর থাকলেও, বর্তমান সময়ে ভারতীয় রাজনীতিতে তাদের আধিপত্য অনেক কমেছে। কংগ্রেসের ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে গান্ধী পরিবারের প্রভাব ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।

পাকিস্তানের ভুট্টো পরিবারও একই ধরনের রাজনৈতিক চর্চা করেছিল, কিন্তু ইমরান খানের উত্থান দেখিয়েছে যে পাকিস্তানের জনগণ পরিবারতন্ত্রের বাইরে বিকল্প নেতৃত্ব চাইছে।

Advertisement

কিন্তু বাংলাদেশে সেই বিকল্প এখনো গড়ে ওঠেনি। এখানকার রাজনৈতিক দলগুলো এখনো পরিবারতন্ত্রকে মূল ভিত্তি হিসেবে ধরে রেখেছে, যা জনগণের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও যোগ্য নেতাদের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে প্রধান বাধাবাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এখানে গণতন্ত্র শুধুমাত্র নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। প্রকৃত গণতন্ত্র তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন—

• নেতৃত্ব গঠিত হবে যোগ্যতার ভিত্তিতে।• দলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হবে জনগণের ইচ্ছায়।• পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির পরিবর্তে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠবে।

দুঃখজনকভাবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলো পরিবারতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে দলীয় সংগঠন, প্রশাসন এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে ব্যবহার করছে। ফলে, প্রকৃত গণতান্ত্রিক চর্চা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

এই শৃঙ্খল ভাঙার সময় এসেছেবাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল গণতন্ত্রের আদর্শ নিয়ে, পরিবারতন্ত্রের নয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল একটি জনগণের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার, যেখানে নেতৃত্ব গঠিত হবে জনগণের মতামতের ভিত্তিতে, কোনো পরিবারের নামের কারণে নয়।

কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা হলো—বাংলাদেশের রাজনীতি এখনো পরিবারতন্ত্রের ফাঁদে বন্দি। আওয়ামী লীগ হোক বা বিএনপি, উভয় দলই নিজেদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে একটি নির্দিষ্ট পরিবারকে ঘিরে। যদি এই সংস্কৃতি পরিবর্তন না হয়, তবে বাংলাদেশের গণতন্ত্র চিরকালই একটি বিভ্রম হয়ে থাকবে।

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সংস্কৃতি, যেখানে—• জনগণের ভোটই হবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।• পারিবারিক পরিচয়ের চেয়ে ব্যক্তির যোগ্যতাকে গুরুত্ব দিতে হবে।• স্বাধীন রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশের জনগণের এখনই বোঝার সময় এসেছে—পরিবারতন্ত্রের এই শৃঙ্খল যতদিন থাকবে, ততদিন প্রকৃত গণতন্ত্র আসবে না। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কেবল শেখ পরিবার বা জিয়া পরিবারের হাতে বন্দী থাকতে পারে না। এখন সময় পরিবর্তনের, এখন সময় শৃঙ্খল ভাঙার!

সংস্কার ও ছাত্র আন্দোলনের ভূমিকাবৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শপথ ছিল বৈষম্য চিরতরে নির্মূল করা, এবং আমার শতভাগ সমর্থন ছিল সেই আন্দোলনের প্রতি। অতএব, পরিবারতন্ত্রের শৃঙ্খল ভেঙে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতেই হবে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি যেন বাংলাদেশের মাটিতে আর না ঘটে, সে জন্য রাজনৈতিক সংস্কার নিশ্চিত করতে হবে।

এই পরিবর্তন না আসা পর্যন্ত ছাত্র আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে শক্তিশালী হতে হবে এবং জনগণের সার্বিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে হবে। সংস্কারের নামে রাজনৈতিক প্রতারণা যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

সবশেষে৫৩ বছরের মধ্যে বহুবার সংস্কারের দাবি উঠেছে। তরুণরা রাস্তায় নেমেছে, নতুন দিগন্তের স্বপ্ন নিয়ে, কিন্তু বুক থেকে বের হয়েছে রক্ত! গুলিতে ঝরেছে প্রাণ। ক্ষমতায় ফিরেছে সেই পুরনো মুখ, চালু হয়েছে একই সিস্টেম। মেহনতি মানুষের রক্তে শুধু ক্ষমতার হাত বদলেছে, বদলায়নি পরিবারতন্ত্র।

এবার শুধু পরিবার বদলালে হবে না, বদলাতে হবে পুরো ব্যবস্থা! জাতি এমন একটা দেশ চায়, যেখানে—মানুষ যোগ্য নাগরিকের স্বীকৃতি এবং সম্মান পাবে।মানুষ কাজ পাবে, ভালোভাবে খেতে পারবে, সঠিক বিচার পাবে।ভালো শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যব্যবস্থা থাকবে।রাজনীতি মানে হবে জনগণের সেবা, লুটপাট নয়।

কোনো অবস্থাতেই পরিবারতন্ত্র চলবে না—দেশের মানুষ হবে প্রকৃত ক্ষমতার মালিক! এটাই প্রত্যাশা, এটাই গণতন্ত্রের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার একমাত্র পথ।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)Rahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/জেআইএম