আবু বকর (রা.) ছিলেন আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অন্যতম প্রধান ও প্রিয় সাহাবি। ইসলামের আবির্ভাবের পর প্রথম দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি একজন। বলা হয় প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মধ্যে তিনিই সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। তিনি ছিলেন মক্কার সর্বজনপ্রিয় ও প্রভাবশালী একজন ব্যক্তি। আভিজাত্য, ভদ্রতা ও সুচরিত্রের জন্য তিনি সুপরিচিত ছিলেন। তার ইসলাম গ্রহণ অন্য অনেককেই ইসলাম গ্রহণে উৎসাহ জোগায়।
Advertisement
ইসলাম গ্রহণের পর ইসলামের প্রচার প্রসারে আবু বকরের (রা.) ত্যাগ-তিতিক্ষা, আল্লাহর ইবাদত, জ্ঞান ও প্রজ্ঞায় তার অগ্রগামিতা তাকে মুসলমানদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তিতে পরিণত করে। মুসলমানদের মধ্যে নবিজির (সা.) পরই ছিল তার অবস্থান। নবিজি (সা.) তাকে সাহাবিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে উল্লেখ করেছেন এবং তার অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন। ওহাব আস-সুয়ায়ী থেকে বর্ণিত আলী (রা.) একদিন খুতবা দিতে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনারা কি জানেন নবিজির (সা.) পর এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি কে? সবাই বললেন আপনিই সর্বশ্রেষ্ঠ। তিনি বললেন, না, নবিজির (সা.) পর এই উম্মতের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যক্তি আবু বকর, তারপর ওমর। (মুসনাদে আহমদ: ৮৩৪)
ওফাতের আগে নবিজির (সা.) যখন খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তাকে নিজের জায়গায় নামাজের ইমামতির দায়িত্ব দেন। আয়েশা (রা.) বলেন, ওফাতের আগে একদিন ইশার সময় নবিজি (সা.) খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন। সাহাবায়ে কেরাম মসজিদে নববিতে ইশার নামাজের অপেক্ষায় ছিলেন। এই অবস্থায় তিনি একে একে তিনবার ওঠার চেষ্টা করেন; কিন্তু তিনবারই বেহুঁশ হয়ে পড়েন। হুঁশ ফিরে পেলেই জিজ্ঞেস করতেন, সাহাবিরা ইশার নামাজ পড়েছে? আয়েশা (রা.) জবাব দিতেন, না, তারা তো আপনার অপেক্ষায় আছে। তৃতীয়বার জ্ঞান ফিরে পেয়ে তিনি বললেন, আবু বকরকে নামাজ পড়াতে বলো।
আয়েশা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! তিনি কোমল হৃদয়ের মানুষ। আপনার জায়গায় নামাজে দাঁড়ালে তিনি হয়তো ঠিকমতো কেরাতও পড়তে পারবেন না। কিন্তু রাসুল (সা.) দুই বা তিনবার আবু বকরকেই (রা.) ইমামতির দায়িত্ব দিতে বললেন। (আসাহহুস সিয়ার)
Advertisement
এটা ছিল নবিজির (সা.) পক্ষ থেকে সাহাবায়ে কেরামের জন্য একটি ইশারা যে, নবিজির (সা.) পর হজরত আবু বকরই (রা.) তার খলিফা বা স্থলাভিষিক্ত হতে পারেন।
আল্লাহর রাসুলের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ওফাতের পর সাহাবায়ে কেরাম দুঃখ ও শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন। হজরত ওমর (রা.) বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না নবিজি (সা.) মৃত্যু বরণ করেছেন। তিনি খোলা তলোয়ার নিয়ে বলছিলেন, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) মারা যান নি। তিনি নবি ঈসার (আ.) মত তার রবের কাছে গিয়েছেন এবং আবার ফিরে আসবেন। যারা তাকে মৃত বলবে, ফিরে এসে তিনি তাদের সবাইকে হত্যা করবেন!
কিন্তু নবিজির সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু ও অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের মানুষ হজরত আবু বকর (রা.) এই কঠিন সময়ে নিজেকে সংযত রাখেন এবং সবাইকে সংযত ও শান্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মসজিদে নববিতে সমবেত সাহাবায়ে কেরামকে বলেন, যদি কেউ মুহাম্মাদের ইবাদত করে থাকেন, তবে জেনে রাখুন মুহাম্মাদ মারা গেছেন। আর যে আল্লাহর ইবাদত করে, সে যেন জেনে রাখে যে আল্লাহ চিরঞ্জীব, তিনি কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না।
তারপর তিনি এ আয়াত তিলাওয়াত করেন,
Advertisement
وَ مَا مُحَمَّدٌ اِلَّا رَسُوۡلٌ قَدۡ خَلَتۡ مِنۡ قَبۡلِهِ الرُّسُلُ اَفَا۠ئِنۡ مَّاتَ اَوۡ قُتِلَ انۡقَلَبۡتُمۡ عَلٰۤی اَعۡقَابِكُمۡ وَ مَنۡ یَّنۡقَلِبۡ عَلٰی عَقِبَیۡهِ فَلَنۡ یَّضُرَّ اللّٰهَ شَیۡئًا وَ سَیَجۡزِی اللّٰهُ الشّٰكِرِیۡنَ
আর মুহাম্মাদ কেবল একজন রাসুল। তার পূর্বে নিশ্চয় অনেক রাসুল বিগত হয়েছেন। যদি তিনি মারা যান অথবা তাকে হত্যা করা হয়, তবে তোমরা কি তোমাদের পেছনে ফিরে যাবে? আর যে ব্যক্তি পেছনে ফিরে যায়, সে কখনো আল্লাহর কোনো ক্ষতি করতে পারে না। আল্লাহ অচিরেই কৃতজ্ঞদের প্রতিদান দেবেন। (সুরা আলে ইমরান: ১৪৪)
এ আয়াতটি অবতীর্ণ হয়েছিল ওহুদ যুদ্ধের পর। ওহুদ যুদ্ধে নবিজি (সা.) শহীদ হয়েছেন এ রকম ভুল সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে কিছু সাহাবি মনোবল হারিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরে পড়েছিলেন। এ আয়াতে তাদের ভর্ৎসনা করে আল্লাহ তাআলা বলেছিলেন, একজন মানুষ হিসেবে নবিজির (সা.) মৃত্যু হতে পারে, তার আগে বহু নবি মারা গেছেন। নবিজির (রা.) মৃত্যু হলেই আল্লাহর আনুগত্য ত্যাগ করার কোনো সুযোগ নেই।
হজরত আবু বকর (রা.) অত্যন্ত মোক্ষম সময়ে সবার সামনে আয়াতটি পাঠ করেন। এ আয়াত শুনে সাহাবায়ে কেরাম সম্বিত ফিরে পান। ওমর (রা.) পরবর্তীতে বলেছেন, আমি যখন আয়াতটি শুনলাম, তখন আমি হাঁটু ভেঙ্গে মাটিতে বসে পড়লাম। আমি বুঝতে পারলাম, আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সত্যিই মারা গেছেন। এভাবে আবু বকরের (রা.) দৃঢ়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। হজরত ওমরসহ (রা.) অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম নিজেদের সামলে নেন। তারা বুঝতে পারেন, নবিজি (সা.) দুনিয়ার স্বাভাবিক নিয়মে মৃত্যুবরণ করেছেন। এই মুহূর্তে তাদের ভেঙে পড়লে চলবে না। এখন তাদের দায়িত্ব অনেক। নবিজির (সা.) ওফাতের পর তার স্থলাভিষিক্ত হিসেবে মুসলমানদের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব এখন তাদের। আল্লাহর দীনের দাওয়াত সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব এখন তাদের।
ওএফএফ/জিকেএস