ফাতেমাতুজ জোহুরা তানিয়া
Advertisement
শেষমেশ আমরা পৌঁছে গেলাম নীলগিরিতে। যেই মুহূর্তে গাড়ি থামল, মনে হলো আমরা একেবারে মেঘের রাজ্যে এসে গেছি। সামনে যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজ পাহাড় আর সাদা মেঘের ঢেউ। নয়ন মুগ্ধ হয়ে বলল, ‘এটা বাস্তব, নাকি কোনো কল্পনা?’ সুহানা তখন ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তানি আর নিহা পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে বাতাসকে ছুঁতে চাইছিল। লাহা একপাশে বসে বলল, ‘বন্ধুরা, এর চেয়ে সুন্দর কিছু আমি জীবনে দেখিনি।’ আনসার একগাল হেসে বলল, ‘আচ্ছা, এখানে থেকে গেলে কেমন হয়? নাস্তা তো নিয়েই এসেছি!’ আমরা সবাই হেসে উঠলাম।
নীলগিরির সৌন্দর্য যেন আমাদের আটকে রাখতে চাইছিল। একপাশে সূর্যের আলোর খেলা, অন্যদিকে মেঘ এসে গায়ে লাগছে। মনে হলো, প্রকৃতি তার সব সৌন্দর্য উজাড় করে আমাদের সামনে হাজির করেছে। আমরা সবাই মিলে বসে সেই মুহূর্তটাকে একদম মনের গভীরে গেঁথে রাখার চেষ্টা করছিলাম। নীলগিরির অপরূপ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সবাই ছবি তোলায় মগ্ন হয়ে গেলাম। কখনো একসঙ্গে, কখনো আলাদাভাবে—যার যার পছন্দমতো পোজ দিয়ে। নয়ন বারবার বলছিল, ‘এখানে যেন একটা ফটোশুট হয়ে যাচ্ছে!’
ছবি তুলতে তুলতে কখন দুপুর গড়িয়ে গেল, টের পাইনি। হঠাৎ হিমু বলল, ‘খিদে লাগেনি? পেটের কথা কেউ ভাবছো না?’ সবার কথায় সায় দিলাম। আমরা একটা জায়গায় বসে আনসারের আনা খিচুড়ি বের করলাম। গরম খিচুড়ির সঙ্গে মেঘে ঢাকা পাহাড়ি পরিবেশ—একমাত্র নীলগিরিতেই এমন অভিজ্ঞতা হতে পারে। সুহানা বলল, ‘আমাদের খিচুড়ি এত ভালো লাগছে কেন জানো? কারণ প্রকৃতি মসলা দিয়ে দিয়েছে।’ তানি হাসতে হাসতে যোগ করল, ‘আর বন্ধুত্ব এই মসলাকে আরও মজাদার করে তুলেছে। সেই দুপুরটা ছিল আমাদের সবার জন্য মনে রাখার মতো। প্রকৃতির সৌন্দর্যের সঙ্গে বন্ধুত্বের এই মুহূর্তগুলো যেন চিরকাল মনে থেকে যাবে।’
Advertisement
রাস্তায় গাড়ি যখন মেঘের রাজ্যে ঢুকে গেল, নয়ন হঠাৎ গলা ছাড়ল, ‘এই পথ যদি শেষ না হয়...’। আমরা সবাই হেসে উঠলাম। লাহা বলল, ‘ওরে বাবা, এখন আবার নায়ক হয়ে যাচ্ছিস নাকি?’ কিন্তু নয়ন থামার পাত্র নয়। সে পুরো গানটাই গাইল। আমরা সবাই তার সঙ্গে গলা মেলাতে লাগলাম। গাড়ির চালকও হাসতে হাসতে বলল, ‘আপনাদের গান শুনে মনে হচ্ছে, এই পথ সত্যিই শেষ হওয়া উচিত না!’ জমির তখন মজা করে বলল, ‘ঠিক আছে, আমরা এখানেই থাকি। এখানে গাড়ি থামান!’
পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি এগোচ্ছে। নয়ন একের পর এক গান গাইছে—কখনো ‘এই পথ যদি শেষ না হয়’, কখনো ‘তুমি যাকে ভালোবাসো’। হিমু হেসে বলল, ‘নয়ন, তুমি একদিন গায়ক হয়ে যাবে, তোমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে!’ সুহানা বলল, ‘না রে, আমরা গাইতে গাইতে মেঘে হারিয়ে যাব।’
চান্দের গাড়িতে চড়ার অনুভূতি যে এত মজার হবে, তা কে জানত! পাহাড়ি পথে গা দুলে উঠল। জমির এমন এক গল্প বলল যে সবাই হেসে লুটিয়ে পড়ল। নয়ন জানাল, নীলগিরির সূর্যোদয় একবার দেখলে জীবনের সব ক্লান্তি মুছে যায়। চান্দের গাড়ি যেন মজার ঝাঁপি। জমিরের গান আর আনসারের অদ্ভুত সব গল্পে সময় কেটে যাচ্ছিল। হঠাৎ গাড়ি একটা বাঁক নিতেই সুহানা চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘আরে দেখো! মেঘ নেমে এসেছে!’ চারদিকে শুধু মেঘ আর সবুজ।
নীলগিরি পৌঁছে মনে হলো, আমরা যেন মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেছি। আকাশটা হাতের কাছে নেমে এসেছিল। লাহা এমন উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল যেন সে পাহাড়ের রাজা! নীলগিরির পথ ধরে হাঁটার সময় সুহানা বলল, ‘জীবনে এমন মুহূর্ত বারবার আসে না। নীলগিরি পৌঁছে মনে হলো, আকাশ যেন হাত বাড়িয়ে আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে।’ নয়ন বলল, ‘এটা কোনো বাস্তব জায়গা নয়, স্বপ্নের মতো! পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে মেঘের ভেতর হাঁটার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।’
Advertisement
দুপুরের খাবার শেষে আমরা সবাই নতুন উদ্যমে নীলাচরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। খিচুড়ির স্বাদ যেন আমাদের শরীরের ক্লান্তি একেবারে মুছে দিয়েছে। গাড়ি আবার পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলতে শুরু করল। নয়ন আবার গান ধরল, ‘যদি কেউ কথা না শোনে...’।
লাহা জানালা দিয়ে মেঘের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘নীলগিরি দেখে যদি এত মুগ্ধ হই, নীলাচলে গিয়ে কী হবে ভাবতেই পারছি না!’ সুহানা মজা করে বলল, ‘আশা করি, এবার আমাকে ফেলে যেতে ভুলবে না।’ আমরা সবাই হেসে উঠলাম। চান্দের গাড়ি পাহাড়ি পথে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। তানি গাড়ির একপাশে বসে পা দুলিয়ে মহা আনন্দে গান গাইছিল। তার উচ্ছ্বাস দেখে আমরা সবাই একসঙ্গে হেসে উঠলাম। তবে কিছুক্ষণ পর হিমু বলল, ‘তানি, একটু সাবধানে বসো! পা দুলিয়ে চলা ঠিক না, পড়ে গেলে কী হবে?’ তানি হেসে বলল, ‘আরে, এই মূহূর্তটা উপভোগ করো। নীলাচলের পথে এভাবে না গেলে আনন্দটা অপূর্ণ থেকে যাবে।’ লাহা মজা করে বলল, ‘তোর আনন্দ আমাদের হার্ট অ্যাটাক দেবে মনে হচ্ছে!’ সবাই মিলে তাকে সাবধান করার চেষ্টা করলেও তানি ছিল নিজের মুডে। তার সেই নির্ভীক আনন্দ আর উচ্ছ্বাস আমাদের সবার জন্য একটা অনন্য মুহূর্ত তৈরি করল।
নীলাচলের পথে পাহাড়ি দৃশ্য আরও মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, যেন প্রকৃতি নিজেই আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। অবশেষে আমরা নীলাচলে পৌঁছে গেলাম। পুরো জায়গাটা যেন স্বর্গের এক টুকরো। পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারছিলাম কেন এত মানুষ এখানে আসতে চায়।
তখন সূর্য পশ্চিম আকাশে লাল আভা ছড়াচ্ছে। সেই রঙিন আলো পাহাড়ের গায়ে পড়ে সোনালি ঝলক তৈরি করেছিল। নয়ন বলল, ‘এই দৃশ্যের জন্য আমি বারবার নীলাচলে আসতে রাজি।’ আমরা সবাই মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে সেই সূর্যাস্ত দেখছিলাম। হিমু মৃদুস্বরে বলল, ‘জীবনের সব ব্যস্ততা যদি এমন মূহূর্তে থেমে যেত!’ সুহানা তার ক্যামেরায় সেই অসাধারণ দৃশ্য ধারণ করছিল।
নীলাচলের সেই সূর্যাস্ত যেন আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত হয়ে থাকল। প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছিল, আমরা যেন সময়ের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। নীলাচলের সূর্যাস্ত যেন এক টুকরো স্বর্গ। লাহা বলল, ‘এমন সূর্যাস্ত দেখলে মন চিরদিনের জন্য শান্ত হয়ে যায়।’ সবাই কিছুক্ষণ চুপ ছিল। সুহানা বলল, ‘এমন সুন্দর মুহূর্ত খুব কম আসে, যা কোনো ক্যামেরায় বন্দি করা যায় না।’
ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, পাহাড় আমাদের এক টুকরো শান্তি দিয়ে গেল। আনসার বলল, ‘এবারের মতো বিদায়, নীলাচল। তবে আমরা আবার আসব।’ নীলাচরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো, আমরা টেরই পাইনি। ঠান্ডা হাওয়া বইতে শুরু করল। মেঘ যেন আমাদের জড়িয়ে ধরছিল। এমন সময় হিমু বলল, ‘এক কাপ গরম চা হলে কী ভালো হতো!’ নয়ন সঙ্গে সঙ্গে যোগ দিলো, ‘চা তো খাবই, সঙ্গে কিছু ভারী নাস্তা হলে মন্দ হয় না।’ সবাই তার কথায় মাথা নাড়ল। কিন্তু লাহা আশপাশে তাকিয়ে বলল, ‘এখানে কি চা-নাস্তা পাওয়া যাবে? পাহাড়ের চূড়ায় তো কেবল মেঘ পাওয়া যাচ্ছে!’ নীলাচলে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলেও আশেপাশে তেমন খাবারের দোকান খুঁজে পাচ্ছিলাম না। হিমু একটু হতাশ হয়ে বলল, ‘এখন চা আর নাস্তার স্বপ্নই দেখতে হবে মনে হচ্ছে।’ সোহানা তখন মজা করে বলল, ‘তোমরা এসব চিন্তা বাদ দাও। পটিয়ায় ফিরে চিকেন নান খাবে, সব দুশ্চিন্তা চলে যাবে!’ আমরা তার কথা শুনে হেসে ফেললাম।
নীলাচলের শীতল বাতাস আর মেঘের মাঝেই আবার গাড়িতে চড়ে পটিয়ার দিকে রওয়ানা দিলাম। পটিয়ায় পৌঁছে এক রেস্টুরেন্টে ঢুকে চিকেন নানের স্বাদ নিতে নিতে সবাই বলল, ‘সোহানা, তোর কথাই ঠিক! এটাই আমাদের শান্তি এনে দিলো।’
রাতে ফিরে যাওয়ার সময় সবাই মিলে বলছিল, ‘আজকের দিনটা ছিল মনে রাখার মতো—প্রকৃতি, মজা আর বন্ধুত্বের মিশ্রণে ভরপুর।’ নাস্তা শেষে প্রথমেই সোহানা চলে গেল। তার চলে যাওয়ার সময় আমরা সবাই হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। কিছুক্ষণ পর হিমু আর আনসারও বলল, ‘আমাদেরও এবার উঠতে হবে।’ তাদের চলে যাওয়ার সময় লাহা মজা করে বলল, ‘তোমরা এত তাড়াতাড়ি বিদায় নিলে তো পুরো মজাটাই শেষ হয়ে যায়!’
এরপর তানি আর নিহাও ধীরে ধীরে নেমে পড়ল। চারপাশ যেন একটু ফাঁকা লাগতে শুরু করল। তখন লাহা টুপ করে বলল, ‘এই বুঝি বিদায়।’ তার কথায় আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। সবার চলে যাওয়ার মুহূর্তটা এতটাই নীরব আর আবেগময় ছিল যে, কারো মুখে আর কোনো কথা ছিল না। সেই দিনের সব আনন্দময় মুহূর্ত হঠাৎ যেন এক গভীর শূন্যতায় ঢেকে গেল।’
শেষমেশ নয়ন, জমির, আর লাহাও বিদায় নিতে শুরু করল। একে একে সবাই চলে যাওয়ার সময় মনে হচ্ছিল যেন পুরো দিনের মধুর মুহূর্তগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বিদায়ের সময় লাহা হেসে বলল, ‘আবার দেখা হবে, বন্ধুরা!’ নয়ন আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই ভ্রমণটা আমরা কখনো ভুলব না।’ সবাই চলে যাওয়ার পর মনে হলো, এই ভ্রমণ শুধু পাহাড় বা প্রকৃতির নয়; এটি ছিল আমাদের বন্ধুত্বেরও এক অনন্য উদযাপন। প্রাণবন্ত দিনটি আমাদের মনে চিরকাল অমলিন থাকবে।
আরও পড়ুন
নীলগিরি-নীলাচলের মেঘে যাই মিলেমিশে নীলা মার্কেটে একদিনএসইউ/এমএস