সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুইডেনে গ্যাং অপরাধ এবং সহিংস কর্মকাণ্ড আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও সরকার এই সমস্যা দমনের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তবুও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। অপরাধ শুধু বেড়েই চলেছে না বরং এটি কিছু অঞ্চলের সামাজিক কাঠামোও পরিবর্তন করে দিয়েছে, যেখানে গ্যাং সদস্যরা শক্তিশালী অবস্থান তৈরি করেছে এবং সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত ভয়ের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
Advertisement
গ্যাং অপরাধের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
অনেক মানুষ যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলো থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় সুইডেনে এসেছে। যদিও সুইডেন তাদের আশ্রয়প্রাপ্তির সুযোগ দিয়েছে, কিন্তু একইসঙ্গে এটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিভাজন তৈরি করেছে। যারা আমাদের দেশে নিরাপত্তা খুঁজতে এসেছে, তারা প্রায়শই এমন এলাকায় বসবাস করে যেখানে গ্যাং অপরাধ ও সামাজিক বৈষম্য প্রকট। অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর কাজে লাগিয়ে অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে, যা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রিংকেবি, টেনস্টা, ব্রো, হ্যাসেলবি, সোদারতেলিয়ে ওরেব্রো এবং সুইডেনের অন্যান্য শহরগুলোতে সহিংস সংঘর্ষ চলছে। তরুণ ও সাধারণ নাগরিকরা গ্যাং সহিংসতা এবং মাদকের কারবারের ফাঁদে আটকে যাচ্ছে। তবে শুধু অভিবাসী গোষ্ঠীগুলোই এই অপরাধের শিকার নয়—এটিও স্পষ্ট যে সুইডিশ গ্যাং সদস্যরা আন্তর্জাতিক অপরাধ নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে।
Advertisement
সুইডেনে গ্যাং অপরাধ কারা করছে?
গ্যাং অপরাধের ক্ষেত্রে একটি ভুল ধারণা হলো, এটি শুধু অভিবাসীদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে। বাস্তবতা হলো, জাতিগত সুইডিশরাও এতে সক্রিয়ভাবে জড়িত। আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্রের সাথে যোগসাজশ এবং স্থানীয়ভাবে মাদক ব্যবসার মাধ্যমে সুইডিশ গোষ্ঠীগুলোরও অপরাধপ্রবণ এলাকাগুলোর পরিস্থিতিকে আরও অবনতি করছে। ফলে, একক কোনো গোষ্ঠীকে দোষারোপ করা যথার্থ নয়; বরং এটি পুরো সমাজের গভীরে শিকড় গেঁড়ে বসেছে।
সামাজিক বৈষম্য ও গ্যাং অপরাধের সম্পর্ক
অপরাধ, মাদকাসক্তি এবং সামাজিক বৈষম্য একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। শুধু দরিদ্র অঞ্চলগুলোই এর শিকার হচ্ছে এমনটি বলা যাবে না। মাদক ও গ্যাং অপরাধ সুইডেনের ধনী এলাকাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও সমস্ত সমৃদ্ধ অঞ্চল সরাসরি গ্যাং অপরাধ দ্বারা আক্রান্ত নয়, তবে কিছু ব্যক্তি এই সমাজের অংশ হয়েও মাদক ব্যবসা বা অন্যান্য অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত।
Advertisement
গ্যাং অপরাধের বিস্তার কোনো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি দরিদ্র অঞ্চল থেকে শুরু করে বিত্তশালী এলাকাগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ছে, যেখানে অবৈধ পণ্য ও মাদক সহজেই প্রবেশ করছে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, অপরাধী নেটওয়ার্কগুলো এখন আরও কমবয়সী কিশোরদের মাদক পাচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অপরাধে ব্যবহার করছে, যা সমাজের জন্য আরও ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে।
সুইডেনের বিচার ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা সংকট
সুইডেনের বিচার ব্যবস্থা দীর্ঘসূত্রিতা ও জটিলতার কারণে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলোর দ্রুত সমাধানে ব্যর্থ হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে কোরআন অবমাননা ও পোড়ানোর মতো উসকানিমূলক ঘটনাগুলো দেশজুড়ে তীব্র বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। এই ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত এক ব্যক্তিকে গতকাল অন্য একটি সন্ত্রাসী সংগঠন গুলি করে হত্যা করেছে, যা শুধু দেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি, বরং সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও গভীর সংকটে ফেলে দিয়েছে।পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী একদিকে চরমপন্থি কর্মকাণ্ড দমন করতে চাইছে, অন্যদিকে তারা অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে গিয়ে নানা আইনি জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছে, যা কার্যত তাদের কার্যক্রমকে সীমিত করে ফেলছে।
সুইডেনের আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার কিছু মৌলিক দুর্বলতা আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর জন্য আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে। তারা এখানকার শিথিল আইন ও নীতিমালার সুযোগ নিয়ে ১২-১৩ বছর বয়সী শিশুদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে ব্যবহার করছে। যেহেতু দেশটিতে ১৮ বছরের নিচে অপরাধীদের জন্য কার্যকর শাস্তির ব্যবস্থা নেই, তাই অপরাধপ্রবণ কিশোরদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। এই পরিস্থিতি শুধু সুইডেনের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য হুমকি নয় বরং এটি দেশকে বৈশ্বিক নিরাপত্তা সংকটের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করছে।
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, সুইডেনের ওরেব্রো শহরের ক্যাম্পাস রিসবার্গস্কা নামক একটি প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্রে একটি মর্মান্তিক বন্দুক হামলা সংঘটিত হয়েছে।
পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এই হামলায় প্রায় ১০ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে হামলাকারী নিজেও অন্তর্ভুক্ত। এটি সুইডেনের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাণঘাতী গণগুলোর মধ্যে একটি।
হামলাটি দুপুরের পরপরই ঘটে এবং বেশ কয়েকজন আহত ব্যক্তিকে চিকিৎসার জন্য ওরেব্রো বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। পুলিশ ধারণা করছে যে হামলাকারী একাই এই হামলা চালিয়েছে এবং আপাতত এটি সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়। তবে হামলার পেছনের উদ্দেশ্য এখনো স্পষ্ট নয় এবং তদন্ত চলছে।
সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী উলফ ক্রিস্টারসন এই ঘটনার জন্য গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং বলেছেন যে এটি সুইডেনের জন্য একটি বেদনাদায়ক দিন। ন্যায়বিচারের জন্য পুলিশ ও নিরাপত্তা সংস্থা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে।
রাজা কার্ল ষোড়শ গুস্তাফও নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন এবং পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস ও চিকিৎসা কর্মীদের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেছেন। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছে এবং কর্তৃপক্ষ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
সরকার কী করছে এই সমস্যার সমাধানে?
সুইডিশ সরকার গ্যাং অপরাধ দমনের জন্য গত কয়েক বছরে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে স্বল্পমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
১. স্বল্পমেয়াদি উদ্যোগ:• আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিচার বিভাগের জন্য ৩.৪৬ বিলিয়ন ক্রোনা অতিরিক্ত বাজেট বরাদ্দ।• অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীদের জন্য কঠোর শাস্তির প্রস্তাব।• বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে নিরাপত্তা জোন গঠনের পরিকল্পনা।
২. দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ:• সংঘবদ্ধ অপরাধ মোকাবিলায় জাতীয় কৌশল প্রণয়ন, যার মূল লক্ষ্য তরুণদের গ্যাং-সম্পৃক্ততা রোধ করা।• স্থানীয় বিশেষ অভিযানের দল গঠন, যারা সরাসরি ঝুঁকিপূর্ণ কমিউনিটিগুলোর সাথে কাজ করবে এবং অপরাধ দ্রুত শনাক্ত ও প্রতিরোধ করবে।• অপরাধীদের গ্যাং থেকে বেরিয়ে আসতে সহায়তা করতে ‘এক্সিট প্রোগ্রাম’ গবেষণা ও বাস্তবায়ন।
শুধু কঠোর আইন যথেষ্ট নয় – কাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন
সরকারি পদক্ষেপগুলো সত্ত্বেও কাঠামোগত সমস্যাগুলো এখনও রয়ে গেছে। শুধুমাত্র কঠোর আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা দিয়ে গ্যাং অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব নয়; বরং দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকা মানুষদের জন্য উন্নত শিক্ষা, সামাজিক সহায়তা এবং সম্পদের ন্যায়সংগত বণ্টনের মাধ্যমে টেকসই সমাধান আনতে হবে। একই সাথে অপরাধীদের তাদের কার্যকলাপের জন্য দায়ী করতে হবে এবং উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে।
সরকার ২০৩২ সালের মধ্যে গ্যাং অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। তবে এটি অর্জনের জন্য প্রশাসন, রাজনীতিবিদ এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার। এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার সময়—সুইডেনকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গ্যাং অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, নতুবা পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
এই পরিবর্তন শুধু আমাকে নয় বরং সমগ্র সুইডিশ জাতিকে গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। আমরা কি সত্যিই সুইডেনকে তার আগের নিরাপদ ও উদার রাষ্ট্র হিসেবে ধরে রাখতে পারবো? নাকি বিচার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে দেশটি ক্রমশ আরও অনিরাপদ হয়ে উঠবে? এটি এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন) Rahman.Mridha@gmail.com