ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারত সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করায় কমেছে দুদেশের মধ্যে যাত্রী পারাপার। আগে প্রতিদিন যেখানে ৭-৯ হাজার যাত্রী পারাপার হতো, এখন কমে দাঁড়িয়েছে দেড় থেকে দুই হাজার। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশিদের ভিসা বন্ধ রেখেছে ভারত। এতে কমে গেছে যাত্রী যাতায়াত।
Advertisement
বেনাপোল বন্দর থেকে ভারতের কলকাতা শহরের দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। ভ্রমণ, ব্যবসা, চিকিৎসা বা অন্যান্য কাজে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যাতায়াতকারীদের বড় অংশ ব্যবহার করেন বেনাপোল-পেট্রাপোল রুট।
ইমিগ্রেশন সূত্র জানিয়েছে, ২০-৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতে গেছেন ১০ হাজার ৯৮৯ জন। আর ভারত থেকে এসেছেন ১০ হাজার ৪৬০ জন। ১১ দিনে পারাপার হয়েছেন মোট ২১ হাজার ৪৪৯ জন যাত্রী। তবে এদের মধ্যে ভারতীয় পাসপোর্টযাত্রী আসা ও যাওয়া বেড়েছে। এই ১১ দিনে ভারত থেকে এসেছেন চার হাজার ৭৬৪ জন। আর ভারতে ফিরে গেছেন পাঁচ হাজার ৩৮২ জন। এদের মধ্যে বিজনেস ভিসা নিয়ে আসা লাগেজ পার্টি যাত্রীর সংখ্যা বেশি। যাত্রী পারাপার কমে যাওয়ায় ‘ভ্রমণ কর’ বাবদ রাজস্ব আদায়ও কমে যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পর থেকে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
আরও পড়ুন: ছয়মাসে পণ্য আমদানি কমেছে ৮৪২৩ মেট্রিক টনকাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, বছরে এ বন্দরে ভ্রমণ কর থেকে রাজস্ব আদায় হয় ১৮২ কোটি টাকা। ৫ আগস্টের আগে প্রতিমাসে গড়ে ১৫ কোটি টাকার রাজস্ব আয় হতো। বর্তমানে রাজস্ব আদায় হচ্ছে মাত্র তিন কোটি টাকা।
Advertisement
বেনাপোল আন্তর্জাতিক চেকপোস্ট ইমিগ্রেশনের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমতিয়াজ মো. আহসানুল কাদের ভূইয়া বলেন, বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যান তাদের প্রত্যেককেই ‘ভ্রমণ কর’ বাবদ এক হাজার টাকা এবং ‘প্যাসেঞ্জার টার্মিনাল’ ফি বাবদ ৫৫ টাকা দিয়ে থাকেন। তবে ফেরত আসা যাত্রীরা এই করের আওতামুক্ত। স্বাভাবিক সময়ে বেনাপোল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার যাত্রী ভারতে যেতেন। এখন সেটা কমে গড়ে ৮০০ থেকে এক হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সভাপতি মো. রফিউজ্জামান বলেন, বাংলাদেশিদের বিদেশ ভ্রমণ কমে গেছে মূলত ভিসাপ্রাপ্তি জটিল হওয়ার কারণে। বর্তমানে ভারত ভিসা দিচ্ছে না। গত কয়েক মাসে যারা ভারত ভ্রমণ করেছেন, তাদের বেশিরভাগের ভিসাই আগে ইস্যু করা।
ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ায় শনিবার ভারত থেকে ফিরে এসেছেন নড়াউলের গনেশ সাহা ও ঢাকার সোমেন শীল। গণেশ সাহা বলেন, ‘ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছিল। তাই তড়িঘড়ি করে ভারতে আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে একটু দেখা করে এলাম।’
সোমেন শীল বলেন, ‘ভিসার মেয়াদ এমাসেই শেষ। তাই ভারতে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম।’
Advertisement
বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে বাংলাদেশে এসেছেন ভারতীয় নাগরিক আবুল কালাম। বেনাপোল চেকপোস্টে তিনি বলেন, ‘অন্যসময় বেনাপোল চেকপোস্টে খুব ভিড় থাকতো। এবার ভিড় নেই। আল্লাহর রাস্তায় যাচ্ছি, খুব ভালো লাগছে।’
বেনাপোলের ফাইভ স্টার পরিবহনের ম্যানেজার আশাদুজ্জামান আশা জানান, ভিসা বন্ধ থাকায় তাদের পরিবহন ব্যবসায় লোকসান গুনতে হচ্ছে।
একই কথা বলেন আলম মানিচেঞ্জারের স্বত্বাধিকারী মশিয়ার রহমান। তিনি বলেন, বর্তমানে যাত্রীদের যে অবস্থা তাতে অফিস চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
বেনাপোল গ্রিনলাইন পরিবহনের ম্যানেজার রবীন্দ্রনাথ বলেন, তাদের এসি গাড়ি। সামান্য কয়েকজন যাত্রী নিয়ে রাজধানী ঢাকার উদ্দেশ্য যেতে হয়। এতে তাদের গাড়ির তেল খরচই হচ্ছে না।
তিনি বলেন, এখানে থেকে যেসব পরিবহন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছেড়ে যায়, তাদের সবাই পড়েছেন বিপাকে। পরিবহন স্টাফদের বেতন-ভাতা না দিতে পারায় অনেকে কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন।
আরও পড়ুন: বেনাপোল বন্দর দিয়ে পণ্য রপ্তানিতে নতুন শর্তবেনাপোল আমদানি-রপ্তানি সমিতির সহ-সভাপতি ও যমুনা ট্রেডিং করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী আমিনুল হক বলেন, ‘ভারত ভিসা বন্ধ রাখায় আমাদের ব্যবসায়িক কাজেও সংকট দেখা দিয়েছে। আমদানি-রপ্তানির কাজে পণ্যের গুণগত মান যাচাইয়ের জন্য ব্যবসায়ীদের ভারত যাতায়াত করা লাগে। বর্তমানে ভিসা না থাকায় তারা ভারতে যেতে পারছেন না।’
কথা হয় বাংলাদেশ ভারত চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক (ল্যান্ডপোর্ট) মতিয়ার রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ভিসাকেন্দ্রগুলো এখন কেবল জরুরি মেডিকেল ও স্টুডেন্ট ভিসার জন্য সীমিত পরিসরে স্লট দিচ্ছে। ব্যবসা ও ভ্রমণ ভিসার যাত্রীদের সংখ্যা নেই বললেই চলে। ভারত ভিসা বন্ধ রাখায় ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা কিংবা অন্যান্য কাজে বাংলাদেশিরা যেমন যেতে পারছেন না, তেমনি ক্ষতির মুখে পড়ছেন ভারতীয়রাও।
বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ট্রাফিক) মামুন কবীর তরফদার বলেন, ভিসা জটিলতা না কাটলে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই যাত্রী পারাপার শূন্যের কোটায় এসে দাঁড়াবে। এখন যারা যাতায়াত করছেন, তাদের বেশিরভাগেরই ভিসার মেয়াদ শেষের দিকে। ভারত ভিসা সীমিত করায় বন্দরের রাজস্ব আয় অনেকটা কমে গেছে।
এসআর/জেআইএম