দ্বিতীয় বারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেই একের পর এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর এবং বিতর্কিত সব পদক্ষেপ গ্রহণ করে রীতিমত শোরগোল ফেলে দিয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার প্রথম সপ্তাহে ফেডারেল সরকার কী কী করেছে তা বুঝতে হলে যারা ট্রাম্প প্রশাসনে কাজ করছেন এমন লোকজনের সঙ্গে আলাপ করলেই পরিস্থিতি জানা যায়। ট্রাম্প মূলত ফেডারেল সরকারের ব্যয় কমিয়ে পুনর্গঠনের দিকে জোর দিতে চাচ্ছেন। তবে তিনি সবকিছু খুব দ্রুত করার চেষ্টা করছেন যা হয়তো দীর্ঘমেয়াদের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।
Advertisement
ট্রেজারি বিভাগের এক কর্মী বলেন, আমি ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারের সঙ্গে আছি। ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে আগের কোনো প্রশাসনেরই তুলনা হবে না। অনেকেই নতুন চাকরির সন্ধানে আছে। তবে যারা এই চাকরিতে থেকে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন তারা আতঙ্কে আছেন যে সামনের দিনগুলো হয়তো আরও খারাপ হবে। অন্য একজন শীর্ষ ফেডারেল কর্মকর্তা বলেন, সবাই বেশ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।
প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, তিনি ব্যাপক পরিবর্তন আনবেন। তিনি সে সময় কী বোঝাতে চেয়েছেন তা দায়িত্ব নেওয়ার পর আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একের পর এক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষরের পর ট্রাম্প আসলে এটাই বুঝিয়ে দিয়েছেন যে ফেডারেল সরকার তার খেয়াল-খুশি মতোই চলবে।
তিনি দাবি করেছেন, নিয়োগ, বরখাস্ত এবং সব ধরনের ব্যয়ের সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত করার জন্য নির্বাহী শাখার ওপর তার ‘একমাত্র এবং একচেটিয়া কর্তৃত্ব’ রয়েছে। ট্রাম্প এটা স্পষ্ট করেছেন যে, তিনি শুধু একজন প্রেসিডেন্ট নন বরং আইনসভা প্রণীত বিভিন্ন আইনও তিনি কার্যকর করছেন। সুতরাং তিনি নিজেকে একজন রাজার কাছাকাছি কিছু বলেই দাবি করছেন। তিনি উপযুক্ত মনে করলে যে কোনো ব্যয় আটকাতে বা পুনর্নির্দেশ দিতেও সক্ষম।
Advertisement
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ২৭ জানুয়ারি শত শত বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল মঞ্জুরি ও ঋণ আটকে দেওয়ার বিষয়ে ট্রাম্প একটি নির্বাহী আদেশ দেন। কিন্তু ওই আদেশ কার্যকর হওয়ার আগ মুহুর্তেই সাময়িকভাবে তা স্থগিত করেন একজন মার্কিন বিচারক। বিচারক লরেন আলি খান আগামী সোমবার পর্যন্ত এই স্থগিতাদেশ দিয়েছেন। এর আগে মঞ্জুরি পাচ্ছিলেন এমন ব্যক্তিদের সংগঠনগুলোর একটি গ্রুপ এ বিষয়ে মামলা করে।
মামলায় বলা হয়েছে, ইতোমধ্যেই অনুমোদন হওয়া তহবিল সাময়িকভাবে স্থগিত করার মাধ্যমে হোয়াইট হাউজ আইন লঙ্ঘন করেছে। প্রেসিডেন্টের আদেশ কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই আদালতের আদেশটি এসেছে। যদিও প্রেসিডেন্টের আদেশ কোন কোন সংস্থা বা কর্মসূচির ওপর প্রযোজ্য হবে তা নিয়ে ব্যাপক বিভ্রান্তি ছিল।
ফেডারেল আর্থিক সহায়তার অর্থ বিতরণ বা এ সম্পর্কিত সব কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত রাখার জন্য হোয়াইট হাউজের বাজেট অফিসের ভারপ্রাপ্ত প্রধান সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নির্দেশনা দিয়েছেন। এতে বলা হয়েছে, মঞ্জুরি ও ঋণের বিষয়গুলো নিয়ে নতুন প্রশাসনের পর্যালোচনার জন্য তারা এই পদক্ষেপ নিয়েছেন।
হোয়াইট হাউজের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিয়াভিট বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন স্থগিত করার বিষয়টি হলো ট্যাক্স ডলারের ভালো রক্ষণাবেক্ষণ।
Advertisement
সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রথম প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, অর্থায়ন স্থগিত করার কারণে সরকার জেন্ডার ইস্যু বা ডাইভারসিটি কর্মসূচিগুলোর খরচ কমানোর বিষয়টি দেখতে পারবে। তবে এটা একদিকে যেমন বিভ্রান্তি তৈরি করেছে আবার অনেককে ক্ষুব্ধও করেছে।
যারা এ ধরনের মঞ্জুরি ও ঋণ পায় এমন অলাভজনক ও গবেষণা সংস্থাগুলোকে দ্রুত তহবিল হারানোর বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছে। বিচারক আলি খান মঙ্গলবার একটি স্থিতাবস্থা জারি করেছেন। সোমবার এর শুনানি হবে।
হোয়াইট হাউজের নির্দেশনা কয়েক বিলিয়ন ডলারের ফেডারেল সরকারের কর্মসূচির ওপর প্রভাব ফেলবে। এর মধ্যে দুর্যোগে ত্রাণ সহায়তা থেকে শুরু করে ক্যানসার বিষয়ে গবেষণাও আছে।
ন্যাশনাল কাউন্সিল অব ননপ্রফিটস এর প্রেসিডেন্ট ডিয়ানে ইয়েনটেল সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ আদালতের আদেশে উল্লাস প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, আমাদের মামলা সফল হয়েছে- আদালত ফেডারেল অর্থায়ন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত আটকে দিয়েছে। তাদের দাবি, ট্রাম্পের আদেশ কোন যুক্তি বা আইনের ওপর ভিত্তি করে নেওয়া হয়নি এবং পুরো যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এর প্রভাব পড়বে।
ডেমোক্র্যাটিক রাজ্যগুলোর একটি কোয়ালিশনও এ বিষয়ে আরেকটি মামলা করেছে। তাদের দাবি, ট্রাম্পের আদেশ অসাংবিধানিক। এর আগে গত সোমবার বিদেশি সহায়তা বন্ধের জন্যও একটি নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন ট্রাম্প। তার ওই আদেশের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিদেশে সব ধরনের সহায়তা কার্যক্রম স্থগিত করেছে এবং নতুন সাহায্য অনুমোদন বন্ধ রেখেছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তা ও বিদেশি দূতাবাসগুলোতে এই নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে বলে বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়।
শুধু এসব করেই ক্ষান্ত হননি ট্রাম্প। নিজের প্রশাসনের মধ্যে ব্যাপক তোলপাড় শুরু করে দিয়েছেন তিনি। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রায় বিশ লাখ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বেতন-ভাতা দিয়ে স্বেচ্ছায় অবসর নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। সরকারি ব্যয় হ্রাসের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়েছে।
ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির ফেডারেল সরকারের পক্ষ থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিমত জানতে চেয়ে একটি মেইল পাঠিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। ওই মেইলে তারা সরকারের ‘ডেফার্ড রেজিগনেশন প্রোগ্রামের’ অংশ হতে চান কি না। এ বিষয়ে আগামী ৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তাদের সিদ্ধান্ত জানাতে বলা হয়েছে। যদি কেউ এ সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত থাকে তাহলে তাকে ‘পদত্যাগ’ লিখে পাঠাতে বলা হয়েছে।
প্রস্তাবে ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেতন-ভাতা দেওয়ার কথা বলা আছে। প্রস্তাবটি শুধু মার্কিন বেসামরিক কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে। অভিবাসন, জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত ক্ষেত্র ও মার্কিন ডাক পরিষেবার কর্মরত ব্যক্তিরা এর বাইরে রয়েছেন।
নির্বাচনী প্রচারণায় ক্ষমতায় গেলে সরকার পরিচালনার ব্যয় হ্রাস করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ট্রাম্প। নিজের দেওয়া কথা অনুযায়ী, প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পরপরই ব্যবস্থা নিতে শুরু করেন তিনি। ডাক বিভাগের বাইরে প্রায় ২৩ লাখ বেসামরিক কর্মকর্তা রয়েছে। ট্রাম্প প্রশাসনের আশা, ১০ শতাংশের বেশি কর্মী তাদের প্রস্তাব মেনে নেবেন। অর্থাৎ প্রায় দুই লাখ কর্মী স্বেচ্ছায় পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আশা তাদের। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সরকার ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার বাঁচাতে পারবে বলে মনে করেন ট্রাম্প প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন: শুরুতে হম্বিতম্বি, এখন চীনের প্রতি নরম সুর ট্রাম্পের চীনের ডিপসিকের সাফল্যে কাঁপছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি বাজার যুক্তরাষ্ট্রের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে চীনের এআই, কী করবেন ট্রাম্প?২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার পর ফেডারেল কর্মীদের বিষয়ে আরও একটি আদেশ দেন ট্রাম্প। ওই আদেশে করোনা মহামারির সময় থেকে যেসব কর্মী এখনো বাড়িতে বসে কাজ করছেন, তাদের এখন থেকে সপ্তাহে পাঁচদিন কর্মস্থলে গিয়ে কাজ করার নির্দেশ দেন তিনি। তার এমন একের পর এক নির্দেশের কারণে মার্কিন প্রশাসনের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তিনি রীতিমত যুদ্ধ শুরু করেছেন বলে মনে হচ্ছে। ফলে নানা ধরনের আতঙ্কে দিন পারছেন ফেডারেল কর্মীরা।
টিটিএন