প্রবাস

সহাবস্থানের শক্তি দিয়ে বিভাজন দূর করি

ধর্ম, সংস্কৃতি এবং সহাবস্থানের প্রশ্নটি আজকাল আমাদের সমাজে অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, বিশেষত যখন আমরা বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় বিভাজন এবং সাংস্কৃতিক বিদ্বেষের উদাহরণগুলো দেখি। বর্তমান পরিস্থিতি এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে সহনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া দরকার।

Advertisement

ইতিহাসের বিশাল আয়নায় যদি আমরা চোখ রাখি, তবে পটভূমিতে প্রতিটি ঘটনার বহুমাত্রিক দিক উন্মোচিত হয়। গজনির সুলতান মাহমুদের সোমনাথ মন্দির আক্রমণ থেকে আজকের সমাজের ধর্মীয় বিভাজন পর্যন্ত, আমাদের অতীত এবং বর্তমান একে অপরের সঙ্গে সংলাপে যুক্ত। এই সংলাপের মধ্যে আমরা ঐতিহাসিক শিক্ষাগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সহাবস্থানের একটি শক্তিশালী ভিত্তি তৈরি করতে পারি।

গজনির মাহমুদ ও সোমনাথ মন্দিরের ইতিহাস দেখলে আমরা দেখতে পাই যে, ধর্ম ও সংস্কৃতির পার্থক্য সত্ত্বেও সহাবস্থান সম্ভব ছিল। সোমনাথ মন্দিরের আক্রমণের পরেও, সে সময়ের মুসলিম ও হিন্দু সম্প্রদায় একে অপরের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছিল এবং এমনকি মন্দির কর্তৃপক্ষ মসজিদ নির্মাণে সাহায্য করেছিল। এই সহাবস্থানের উদাহরণ আমাদের শেখায় যে, ধর্মীয় ভেদাভেদ থাকা সত্ত্বেও, যদি একে অপরকে শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা দিয়ে দেখা যায়, তাহলে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটি দৃষ্টান্ত গড়া সম্ভব।

আজকের পৃথিবীতে, বিশেষ করে ভারত উপমহাদেশে, এই ধরনের ঐতিহাসিক উদাহরণ থেকে আমাদের শিক্ষাগুলো গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। যদিও বর্তমান সমাজে আমরা ধর্মীয় বিদ্বেষ ও বিভাজন দেখতে পাচ্ছি, ইতিহাসের শিক্ষা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, মানবিক মূল্যবোধ এবং সহাবস্থান কখনো হারাতে দেওয়া উচিত নয়।

Advertisement

বিশেষত, ইউরোপের উদাহরণগুলো আমাদের এই সহাবস্থানের সফল মডেল দেখায়। সেখানে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতি একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করছে। কর্ধভার মতো স্থানে, যেখানে মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদিরা একত্রে বসবাস করে এবং একে অপরকে শ্রদ্ধা জানিয়ে কাজ করছে, সেখানে সহাবস্থানের দৃষ্টান্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

যদিও ভারত-বাংলাদেশ, রাখাইন এবং ফিলিস্তিনের মতো অঞ্চলে ধর্মীয় বিভাজন ও সংঘাত অত্যন্ত প্রকট, আমরা ঐতিহাসিক শিক্ষার আলো এবং বর্তমান উদাহরণগুলোতে সমাধানের দিক নির্দেশনা দেখতে পাই। এই অঞ্চলে ধর্মীয় বৈষম্য, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং জাতিগত সংঘাত আমাদের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এর সমাধান সম্ভব, কিন্তু তা সংঘাত বা বিভাজনের মাধ্যমে নয়, বরং চিরকালীন আলোচনা ও সমঝোতার মাধ্যমে।

এখানে তিনটি প্রধান আন্তর্জাতিক সংকট—রাখাইন, ফিলিস্তিন এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক—আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট এবং রাখাইন রাজ্যের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সমস্যা এবং ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত এবং পানি বিতর্ক একে অপরের সঙ্গে জড়িত। এই সংকটগুলোর মধ্যে মানবিকতা, সহমর্মিতা এবং সহাবস্থানের কোনো জায়গা নেই। তাই আমাদের উচিত আলোচনার মাধ্যমে, শান্তিপূর্ণ সমাধান খোঁজা, যা কেবল এই অঞ্চলগুলোর জন্য নয়, সারা পৃথিবীর জন্য প্রযোজ্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম, পরিবার ও সমাজের প্রচেষ্টার মাধ্যমে, আমাদের নতুন প্রজন্মকে মানবিক শিক্ষা, সহানুভূতি এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তাদের বুঝতে হবে যে, বৈচিত্র্য আমাদের শক্তি হতে পারে, যদি আমরা এটি সম্মান করি। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বর্তমান প্রজন্মই ভবিষ্যতের নেতা এবং তাদের মাধ্যমেই আমরা সহানুভূতি ও সম্প্রীতির পৃথিবী তৈরি করতে পারি।

Advertisement

আরও পড়ুন যুক্তরাষ্ট্রের হু ত্যাগ এবং ভবিষ্যৎ বিশ্লেষণ আধুনিক সমাজে সম্পর্ক-ফ্যাশনের বহুমাত্রিক রূপ

আমরা যদি সেই শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে পারি, তবে ঐতিহাসিক ও বর্তমান উদাহরণগুলোর আলোকে নতুন প্রজন্ম একটি মানবিক সমাজের ভিত্তি তৈরি করবে, যেখানে ধর্ম নয়, মানবতা হবে সবার প্রথম পরিচয়। ইতিহাস থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলো যেন বিভাজনের হাতিয়ার না হয়, বরং সংহতি ও শান্তির জন্য একটি শক্তিশালী পথ হয়ে দাঁড়ায়, তা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের কঠোর পরিশ্রম প্রয়োজন।

এখনই সময় সেই পরিবর্তন আনার, যা আমাদের সমাজ এবং বিশ্বের জন্য অপরিহার্য। ধর্মীয় সহাবস্থান ও সহনশীলতার অঙ্গীকারকে একটি শক্তিশালী আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে হবে, যা নতুন প্রজন্মের হৃদয়ে প্রোথিত হবে। কারণ কেবল ধর্ম নয়, মানবতা এবং সহমর্মিতার চর্চাই একটি শান্তিপূর্ণ ও টেকসই ভবিষ্যতের ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে।

আমাদের বিশ্বে, যখন ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মধ্যে বৈচিত্র্য বাড়ছে, তখন সহাবস্থানের প্রমাণস্বরূপ বহু ঐতিহাসিক স্থাপত্য আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। এক্ষেত্রে, স্পেনের কর্ডোবা মসজিদ একটি অনন্য উদাহরণ। কর্ডোবা, যেখানে মুসলিম, খ্রিষ্টান এবং ইহুদিরা একসাথে বসবাস করত, আজও তার স্থাপত্যে একত্রে বসবাসের একটি চিরস্থায়ী সাক্ষী হয়ে রয়েছে। এই মসজিদটি শুধু ইসলামি স্থাপত্যশিল্পের অসামান্য উদাহরণ নয়, বরং এটি সেই সময়ের সামাজিক এবং ধর্মীয় সহাবস্থানের একটি স্মৃতিচিহ্ন। আজও যখন আমরা এই মসজিদটির ভেতর দিয়ে হাঁটি, তখন মনে হয় যেন ইতিহাস তার গাঢ় কণ্ঠে বলছে, সহাবস্থানে কোনো বিভাজন নেই, বরং শ্রদ্ধা ও সম্মানই শক্তি।

এছাড়া ভারতের আগ্রায় দাঁড়িয়ে থাকা তাজমহল এক অনন্য নিদর্শন, যা শুধু মুসলিম ঐতিহ্যের নয়, ভালোবাসার এক অমর স্মৃতি। এটি শুধু স্থাপত্যের নয়, মানবিক সম্পর্কের শক্তিরও একটি জ্বলন্ত উদাহরণ। শাহজাহান ও মমতাজ মহলের প্রেমের এই অমর নিদর্শন আজও বিশ্ববাসীর কাছে প্রেম, শান্তি এবং ঐক্যের প্রতীক। তাজমহল আমাদের মনে করিয়ে দেয়, ধর্ম বা সামাজিক বিভাজন যতই প্রবল হোক, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা সব কিছুকে ছাড়িয়ে যেতে পারে।

তবে আজকের ভারতে, যেখানে একটা সময় ঐতিহ্যিক সংহতি ও সম্প্রীতি বিরাজ করত, সেখানে ধর্মীয় বিভাজন সমাজের হৃদয়ে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করছে। বিভাজন ও বিদ্বেষের এই প্রভাব সমাজের অগ্রগতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে এবং আমাদের ঐতিহাসিক ঐক্যের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করে তুলছে। এই অবস্থায়, যখন আমি স্পেনের কর্ডোবা মসজিদ কিংবা আগ্রার তাজমহলের মতো সহাবস্থানের উদাহরণগুলো দেখি, তখন মনে হয়—আমরা এমন একটি পৃথিবী কীভাবে হারালাম, যেখানে বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতি একসাথে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করত?

এই মুহূর্তে আমি স্পেনের কর্ডোবায় দাঁড়িয়ে আছি। মসজিদ-ই-কর্ডোবার সম্মুখে দাঁড়িয়ে ইতিহাস যেন আমার সামনে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। এই স্থানটি শুধুই একটি স্থাপত্যের নিদর্শন নয়; এটি সেই অতীতের এক প্রতীক, যখন ধর্ম ও সংস্কৃতি একসাথে সহাবস্থান করত এবং এক অসাধারণ সমাজ গড়ে তুলত। কিন্তু আজ, এই ইতিহাসকে উপলব্ধি করতে গিয়ে, সমাজের বর্তমান অবস্থা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিচ্ছে।

ধর্মের নামে বিভাজনের এই যে প্রকট বাস্তবতা, তা আমাকে কষ্ট দেয়। প্রশ্ন জাগে—কেন এমনটি হলো? কর্ডোবার মতো স্থান, যেখানে অতীতে বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির মিলনে এক সৃষ্টিশীল সমাজ গড়ে উঠেছিল, সেই উদাহরণ আমরা ভুলে যাচ্ছি কেন?

কর্ডোবা, আন্দালুসিয়ার এই ঐতিহাসিক শহর, একসময় শুধু ইউরোপ নয়, বরং পুরো বিশ্বের কাছে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর একটি কেন্দ্র ছিল। ৯২৯ সালে উমাইয়া খলিফা আবদ আর-রহমান তৃতীয় কর্ডোবাকে রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার পর এটি একটি সোনালি যুগে প্রবেশ করে।

এই সময় কর্ডোবা

• জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এখানে বিশাল গ্রন্থাগারে লক্ষাধিক পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত ছিল।• বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্য থেকে জ্ঞানপিপাসুদের আকর্ষণ করত।• বিজ্ঞান, দর্শন ও সাহিত্য ছিল এই শহরের পরিচয়ের অন্যতম ভিত্তি। আল-জাহরাভি, যাকে শল্যচিকিৎসার পথিকৃৎ বলা হয় এবং ইবনে রুশদ, যিনি দর্শনের এক নতুন ধারা তৈরি করেছিলেন, এই শহরের আলো ছড়িয়েছেন।• মসজিদ-ই-কর্ডোবা, যা ৭৮৫ সালে আবদ আর-রহমান প্রথম নির্মাণ করেন, ইসলামি স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। এর অশ্বক্ষুরাকৃতির খিলান এবং মার্বেল-অলংকৃত স্তম্ভের সারি এর সৌন্দর্যকে অসীম মহিমায় পূর্ণ করেছে।কিন্তু ১২৩৬ সালে খ্রিস্টানরা শহর দখল করার পর মসজিদের মাঝে একটি গির্জা নির্মাণ করা হয়। এই স্থাপত্যটি এখন দুই ধর্মের সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ।

বর্তমানের কর্ডোবা এখনো তার ইতিহাসের গৌরব ধরে রেখেছে। ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত এই শহরটি আজও পর্যটকদের মুগ্ধ করে। শুধু মসজিদ-ই-কর্ডোবাই নয়, ইহুদি কোয়ার্টার (La Judería) এবং রোমান নিদর্শনগুলো এখানে এক মিলনের বার্তা দেয়।

কিন্তু, কর্ডোবার অতীতকে অনুভব করতে করতে আমি বারবার ভাবি—আমরা আজ এই সহাবস্থানের শিক্ষা থেকে এতটা দূরে কেন? সমাজে ধর্মের নামে বিভাজন যখন মানুষের মধ্যে বিদ্বেষ তৈরি করে, তখন কর্ডোবার ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই আমাদের প্রকৃত শক্তি।

আজকের পৃথিবীকে কর্ডোবা এবং তাজমহলের মতো উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে ধর্ম যার যার, কিন্তু উৎসব সবার। মানবতা হবে আমাদের প্রথম পরিচয়। প্রেম, শ্রদ্ধা এবং সহাবস্থানই আমাদের সত্যিকারের শক্তি।

কর্ডোবা ভ্রমণের এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে, ধর্ম বা সংস্কৃতির ভিন্নতা নয়, বরং মানবিকতা এবং সংহতি একটি সমাজকে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যায়। এখন সময় এসেছে, আমরা সবাই মিলে এই বার্তাটি গ্রহণ করি এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি নতুন পৃথিবী গড়ে তুলি।

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন) Rahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/এএসএম