সাংসদের নির্দেশে নারায়ণগঞ্জে একজন শিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বস করানোর ঘটনায় এখন দেশজুড়ে তোলপাড়। সবাই সাংসদ সেলিম ওসমানের শাস্তি চাইছেন। তবে নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার বলেছেন, সেখানে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার মত কিছু ঘটেনি। কিন্তু আইনমন্ত্রী এডভোকেট আনিসুল হক স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, সেখানে যা ঘটেছে তা পেনাল কোডেই অপরাধ এবং অপরাধীদের শাস্তি দেয়া হবে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদও বলেছেন, তদন্ত শেষে দায়ীদের শাস্তি দেয়া হবে, নিন্দা জানিয়েছেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুও। ১৪ দলের সমন্বয়ক ও স্বাস্থধ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম এ ঘটনায় ১৪ দলের পক্ষ থেকে নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, একজন সাংসদ এ ঘটনা ঘটিয়ে সাংসদদের মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছেন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। গণমাধ্যমে এ নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। প্রতিদিন টক শোতে নিন্দা জানাচ্ছেন সবাই। আর সামাজিক মাধ্যম তো অভিনব সব প্রতিবাদে সয়লাব। অনেকেই কানে ধরে ছবি তুলে তা প্রোফাইল পিকচার বানিয়েছেন।নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তের বিরুদ্ধে ইসলাম নিয়ে কটূক্তির অভিযোগ আনা হয়েছে। বলা হচ্ছে, একজন ছাত্র তার বিরুদ্ধে এ অভিযোগ এনেছে। কিন্তু যে ছাত্রের কথা বলা হচ্ছে, সে টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছে, প্রধান শিক্ষক তাকে মেরেছেন। কিন্তু ইসলামের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি। কিন্তু এ অভিযোগেই এলাকার মাইকে ঘোষণা দিয়ে শিক্ষকের বিরুদ্ধে লোকজনকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছে। তারপর তাকে গণপিটুনি দিয়ে, কান ধরে ওঠ-বস করিয়ে, হাত জোর করে মাফ চাইতে বাধ্য করা হয় এবং পুলিশের হাতে তুলে দেয়া হয়। এখন তিনি পুলিশ প্রহরায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।নির্যাতিত শিক্ষক দাবি করেছেন, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মিথ্যা। ব্যবস্থাপনা কমিটির বিরোধের জের ধরে তাকে ফাঁসানো হয়েছে। বাংলাদেশে একজন সংখ্যালঘু শিক্ষককে ফাঁসানো খুব সহজ। তারপরও তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ সত্যি। কিন্তু অভিযোগ সত্যি হলেই তো একজন শিক্ষককে বা যে কোনো ব্যক্তিকে কান ধরে ওঠ-বস করানো যায় না। সেলিম ওসমান তো আইন প্রণেতা, আইন প্রয়োগকারী বা বিচারক নন। কিন্তু সাংসদ সেখানে অভিযোগ শুনে বিচার করে তার রায় দিয়ে, রায় কার্যকর করে ফেলেছেন। আইন প্রণেতার বিরুদ্ধেই আইন হাতে তুলে নেয়ার অভিযোগ। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উচিত ছিল আইন হাতে তুলে নেয়ার অপরাধে সাংসদকে গ্রেপ্তার করা। কিন্তু তারা গ্রেপ্তার করেছে নির্যাতিত শিক্ষককে।শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় বিচারের দাবিতে সবাই যখন সোচ্চার, তখন মঙ্গলবার বিকেলে খবর এলো, এ ঘটনায় একজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বাহ, ত্বড়িৎ অ্যাকশন দেখি। কিন্তু এ ঘটনায় মূল অভিযুক্ত তো একজনই, সাংসদ সেলিম ওসমান। তাহলে কি তাকেই...? না না অত উতালা হবেন না। বরখাস্ত একজন হয়েছেন বটে; তবে তিনি সেই শিক্ষক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে অসুস্থ হয়ে যিনি হাসপাতালে ভর্তি, বরখাস্ত করা হয়েছে তাকেই। মারহাবা মারহাবা। আইনের দারুণ শাসন বটে! শেষ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে, শিক্ষক লাঞ্ছনার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হবে না, দুই সপ্তাহের মধ্যে তা জানাতে রুল জারি করেছেন। একই সঙ্গে আদালত, এ ঘটনায় কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, তিনদিনের মধ্যে তা জানাতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে। তবে পুলিশ তো আগেই জানিয়ে দিয়েছে, সেখানে বেআইনী কিছু ঘটেনি। নিশ্চয়ই আদালতকেও তারা সেটাই জানাবেন। আমরা অপেক্ষায় থাকলাম, সর্বোচ্চ আদালতের ব্যবস্থা দেখার জন্য।তবে এখন পর্যন্ত একটা জিনিস প্রমাণিত, জাতীয় পার্টির সাংসদ সেলিম ওসমানের ক্ষমতা আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রীর চেয়েও বেশি। নইলে নির্যাতনকারী বহাল তবিয়তে ঘুরে বেড়াবে, আর নির্যাতিত হাসপাতালে শুয়ে বরখাস্ত হয়ে যাবেন, এটা হয় নাকি? এটা হয় মগের মুল্লুকে।লেখক : সিনিয়র সাংবাদিকprobhash2000@gmail.comএইচআর/পিআর
Advertisement