মতামত

শুল্ক-করের বোঝা: শক্তের ভক্ত নরমের যম

সম্প্রতি ৬৫ পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়িয়েছে সরকার। বলা হচ্ছে,আইএমএফ -এর চাপেই এমন সিদ্ধান্ত। আইএমএফ– এর এই চাপ ভোক্তাসাধারণকে কঠিনতর চাপে ফেলবে সেই আলোচনা তুঙ্গে এখন। এই চাপাচাপিতে পড়ে ভোক্তাসাধারণের ত্রাহি অবস্থা সামাল দেবে কীভাবে? এমন চোখ টানটান পরিস্থিতিতে সামনে আসে আরেকটি সংবাদ-সরকার শিল্পে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ১৫২শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে। ডলার সংকট,সুদের উচ্চহার,আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি,আমদানিতে কড়াকড়ির মতো উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার উপসর্গগুলোকে উস্কে দিতে পারে গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধি একইসঙ্গে ভ্যাট, শুল্ক বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ।

Advertisement

মূল্যবৃদ্ধি উৎপাদন ব্যবস্থায় ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবে দেখা দিতে পারে, এমনটা মনে করা অস্বাভাবিক নয়। শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো অনেকদিন ধরেই প্রয়োজনীয় জ্বালানি বিষয়ে আর্তনাদ করে আসছে। শুধু মূল্য বিষয়েই নয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস না পাওয়ার ক্ষোভও দীর্ঘদিনের।বিষয়টি পেট্রোবাংলার তথ্যেও প্রমাণ হয়। তাদের হিসাবে গ্যাসের দিনে অনুমোদিত লোড ৫৩৫ কোটি ঘনফুট। অনুমোদিত লোড এর চেয়েও চাহিদা কম।এই সময় দৈনিক চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। এই হিসাবে উৎপাদন ব্যবস্থায় সমস্যা হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু সরবরাহের পরিসংখ্যানটা হতাশাজনক।প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্যাস সরবরাহ করতে পারছে ২৫০ কোটি ঘনফুট। অর্থাৎ প্রতিদিনই ঘাটতি থাকছে বিশাল।

এতদিন ৭৫% জ্বালানি দেশীয় গ্যাস থেকে ব্যবহার হতো। ২৫% আনা হতো বিদেশ থেকে।কিন্তু ২০১৮ সাল থেকে দেশে গ্যাসের উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করলে ঘাটতি পূরণের জন্য এলএনজি আমদানি শুরু হয়।অথচ দেশে উৎপাদন বাড়ানোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়নি।অথচ প্রয়োজন ছিল নতুন গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানো। উৎপাদন বাড়িয়ে মজুদ শেষ করতে না চাইলে অনুসন্ধানে জোর দেওয়া জরুরি ছিল। কিন্তু গত সরকার সেদিকে নজর দেয়নি।প্রাকৃতিক গ্যাস এর বিষয়টা এমন নয় যে, চাইলেই নতুন ক্ষেত্র আবিস্কার করা যায়। ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ বিষয়টি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

একটা সময় ছেদ পড়লে অতি সহজে তা গতিশীল করা কঠিন। যে কারণে গত সময়ের চাপ পড়ছে বর্তমানে। উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ থাকার পরও তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। দেশে মজুদ থাকার পরও উৎপাদন বৃদ্ধি করতে না পারার জন্য বিশেষজ্ঞগণ সংশ্লিষ্টদের অদক্ষতাকে দায়ী করেছেন। কেউ কেউ অবহেলার কথাও বলছেন। অদক্ষতা কিংবা অবহেলা যাই হোক না কেন, গ্যাসের দুরবস্থা চলছে তা আমাদের স্বীকার করতে হবে। এমন অবস্থায় আবার শিল্প ও বাণিজ্যখাতে চাহিদা পূরণও করতে হবে। যে কারণে আমদানি নির্ভরতা বাড়ছে।আমদানিকৃত গ্যাসে আবার শুল্ক ও করের বোঝাও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।৬৩ দশমিক৫৮টাকা প্রতি ইউনিট গ্যাস আমদানিতে শুল্ক ও কর দেওয়ার পর দাম পড়ে ৭৫টাকা ৭২ পয়সা। কিন্তু আমদানীকৃত এলএনজি দিয়ে চাহিদা পূরণেও প্রতিবন্ধকতা আছে।ডলার সংকটের পাশাপাশি এলএনজি টার্মিনালেরও সীমাবদ্ধতা আছে।এমতাবস্থায় পাইপলাইনে গ্যাস আমদানি অর্থসাশ্রয় ঘটাতে পারে। এখানে প্রতিবেশি দেশগুলোর দিকে তাকাতে হতে পারে।অথচ গ্যাস আমদানির এই পথটি কার্যকর নয়। রাজনৈতিক কারণে কতটা বাস্তবসম্মত এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়।চীন ও থাইল্যান্ড মায়ানমার থেকে গ্যাস আমদানির উদাহরণ আছে। কিন্তু আমরা পিছিয়ে আছি। এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণতর হয়ে উঠেছে।

Advertisement

সমস্যা সমাধানে নতুন কূপ খননের দিকে নজর দিতে হবে। ১৫০টি কূপ খননের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল সেগুলো শেষ করতে পারলেও সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কথা দীর্ঘদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে।কিন্তু বিভিন্ন কারণে নতুন টার্মিনাল নির্মাণ হয়নি।অতি গুরুত্বপূর্ণ এই খাতকে অবহেলা না করে চাহিদা অনুযায়ী এলএনজি আমদানির সুযোগ সম্প্রসারিত করতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যবসায়ীদের দাবি আমদানিকৃত এলএনজিতে যে কর ও শুল্ক ধার্য করা আছে তা পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

বর্তমানের উৎপাদন ব্যবস্থা কঠিন সমস্যাক্রান্ত,তার ওপর এই মূল্যবৃদ্ধিতে স্তম্ভিত উদ্যোক্তারা। প্রশ্ন আসতে পারে, শিল্পকারখানা বন্ধ হওয়ার যে হিড়িক পড়েছে সেই নেতিবাচক ঘটনা কি বাড়তেই থাকবে? ব্যবসা ও উৎপাদন বান্ধব পরিবেশকে তলানীতে ঠেলে দিয়ে অর্থনীতিকে কি স্থবির ও মহাসংকটে ফেলে দেবে না এই সিদ্ধান্ত?

গ্যাস এর মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি অবধারিত। উৎপাদিত পণ্যের মূল্য বাড়লে এর কুপ্রভাব পড়বে সাধারণ ক্রেতার ওপর।যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে ভ্যাট ও কর বাড়ানোর ফলে ভোক্তা পর্যায়ে এর প্রভাব হবে না।পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ক্রেতার আয় বাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়ায় সঙ্গত কারণেই ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পাবে অতি দ্রুত। জীবনধারণ কঠিন হবে মধ্যবিত্ত ও নিন্মআয়ের মানুষের জন্য। দারিদ্র্য বিমোচন অধরাই থেকে যাবে।

আগের সরকারের বিরুদ্ধে জনক্ষোভ তৈরি হয়েছিল যেসব কারণে তার অন্যতম ছিল দ্রব্যমূল্য।প্রভাবে সামাজিক বৈষম্য প্রকট হয়েছিল। বৈষম্য বিরোধী নামে আন্দোলন যে কারণে সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। আজও গত সরকারের সমালোচনাকালে দুর্নীতির পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য বিষয়টি চলে আসে সবার আগে।

Advertisement

গত জুলাই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সাধারণ মানুষের আয়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দ্রব্যমূল্যকে নামিয়ে আনা।কিন্তু কয়েক মাস যেতে না যেতেই সরকারের এমন সিদ্ধান্ত জনজীবনকে অস্বাভাবিক করে তুলছে।মানুষ এই মুহূর্তে অতীতের সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করতে শুরু করেছে।শতাধিক পণ্য ও সেবায় কর ও শুল্ক বৃদ্ধির কারণে অন্যান্য সেবা ও পণ্যের মূল্যেও এর প্রভাব পড়বে।এটা আমাদের এখানকার বাজার ইতিহাসের স্বাভাবিক গতি।দাম বেড়েছে এই বাহানা তোলে সবকিছুর দাম বাড়িয়ে দেওয়া বিক্রেতার স্বভাব।

এদিকে সামনে রোজা। রোজায় বিনা কারণেই পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি স্বাভাবিক বিষয়। এবার ভ্যাট ও করের দোহাই দিয়ে বাজার অস্থিতিশীল করে দিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।সরকার হয়তো আগের মতোই বাজার মনিটরিং এর নামে দুচারদিন মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করবে। গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার চালানো হবে, এত লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে। বাস্তবতা হচ্ছে, এগুলো গণমাধ্যমের খোরাক জোগাবে সংবাদ হিসেবে। কিন্তু সাধারণ মানুষের কোনো উপকারে আসবে না।

অন্যদিকে করের ক্ষেত্রে বৈষম্য কমানোর কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করা হয়নি। যাদের ওপর কর বৃদ্ধি করার কথা সেখানে হাত দেয়নি সরকার। বিদ্যমান কর ব্যবস্থাপনাকে সংস্কার না করে এবং কর আদায়ের ক্ষেত্রে অগ্রগতির উদ্যোগ না নিয়ে এভাবে ঢালাওভাবে করারোপ করে মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে দেওয়া হয়েছে।

আগেই বলা হয়েছে আইএমএফ এর প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী এই করারোপের কাজটি করা হয়েছে।যে কাজটি সব সরকারই করে কমবেশি।কিন্তু সরকারের বাইরে থাকাকালে এর বিরোধিতা করে তারাই। বর্তমান সরকারে থাকা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদগণও ইতিপূর্বে বিভিন্ন সরকারের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু সরকারে গিয়ে তাদের পূর্বমন্তব্যগুলো ভুলে গেছেন।

প্রশ্ন আসতেই পারে, কর ছাড়া রাজস্ব বাড়বে কীভাবে? কিন্তু রাজস্ব আদায়ে যখন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে ব্যর্থ হতে দেখা যায় তখন স্বাভাবিকভাবেই নতুন কর আরোপকে ইতিবাচক হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এই মুহূর্তে সরকার রাজস্ব আহরণ বাড়িয়ে দিলে বাড়তি করারোপ প্রয়োজন হতো না বলে অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন। এখনও সরকার চাইলে সেদিকে যেতে পারেন। মানুষ যেন ভাবতে না পারে শক্তের ভক্ত নরমের যম।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।

এইচআর/এমএস