বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক অবস্থা দিন দিন জটিল থেকে আরও জটিলতর হয়ে যাচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতির কারণে দ্রব্যমূল্য লাগামহীনভাবে বাড়ছে। বিশেষ করে নিম্নবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য এই সময় আরও বেশি সংকটময়। তাদের আয়ের একটি বড় অংশ চলে যাচ্ছে খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস এবং ঋণের কিস্তির পেছনে। একদিকে আয় বাড়ছে না, অন্যদিকে সবকিছুর দাম বাড়ছে। এমতাবস্থায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আমাদের সামনে এসে দাঁড়ায়— এই পরিস্থিতিতে সঞ্চয় করবো কীভাবে? আদৌ কী সঞ্চয় সম্ভব?
Advertisement
এর উত্তর হলো—হ্যাঁ, সঞ্চয় সম্ভব। তবে এর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সঞ্চয়ের প্রতি মানসিকতা এবং সঠিক পরিকল্পনা। আমরা সঞ্চয় না করতে পারার পেছনে নানা অজুহাত খুঁজি—দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, আয়ের অভাব, ঋণের বোঝা, বা আর্থিক বিশৃঙ্খলা। কিন্তু সঞ্চয়কে বাস্তবায়িত করার প্রথম ধাপ হলো নিজের মনের মধ্যে সঞ্চয়ের সংকল্প তৈরি করা।
সঞ্চয় করতে না পারার প্রধান কারণগুলো
সঞ্চয় না করতে পারার পেছনে কয়েকটি প্রধান কারণ রয়েছে। প্রথমত, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ে, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের আয়ের ৫০ শতাংশেরও বেশি খরচ হয়ে যায় শুধু খাবার এবং প্রয়োজনীয় জিনিসের পেছনে।
Advertisement
আপনি হয়তো দ্রব্যমূল্যের জন্য অভিযোগ করছেন, কিন্তু সিগারেটের খরচ বন্ধ করেছেন কি? গাড়িতে চলাফেরা কমিয়েছেন? সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করেছেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর "না" হবে। কারণ, মানুষ তার আরাম-আয়েসের জন্য সহজে খরচ কমাতে চায় না।
কিন্তু এই অবস্থায়ও আমাদের একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে—আমরা সব ধরনের খরচ কমাই না। আপনি হয়তো দ্রব্যমূল্যের জন্য অভিযোগ করছেন, কিন্তু সিগারেটের খরচ বন্ধ করেছেন কি? গাড়িতে চলাফেরা কমিয়েছেন? সিনেমা হলে যাওয়া বন্ধ করেছেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর "না" হবে। কারণ, মানুষ তার আরাম-আয়েসের জন্য সহজে খরচ কমাতে চায় না।
দ্বিতীয় কারণ হলো ঋণের বোঝা। যাদের ঋণ বেশি এবং সে ঋণ থেকে কোনো রিটার্ন আসে না, তাদের পক্ষে সঞ্চয় করা কঠিন হয়ে পড়ে। ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে গিয়ে সঞ্চয়ের সুযোগই থাকে না। তৃতীয় কারণ হলো বাজেটিংয়ের অভাব। যাদের বাজেট নেই, তারা জানেই না তাদের টাকা কোথায় যাচ্ছে। প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খরচ হয়ে যায় শুধু আর্থিক পরিকল্পনার অভাবে।
চতুর্থ কারণ হলো হঠাৎ আসা জরুরি খরচ। জীবনের কোনো একটি মুহূর্তে হয়তো বড় অসুখ বা দুর্ঘটনা দেখা দিলো। তখন রাতারাতি বড় অঙ্কের টাকা ব্যয় করতে হয়, যার ফলে সঞ্চয়ের সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়াও আর্থিক বিশৃঙ্খলা এবং পার্সোনাল ফাইন্যান্স সম্পর্কে অজ্ঞতা সঞ্চয়কে আরও দুরূহ করে তোলে।
Advertisement
সঞ্চয়ের মানসিকতার গুরুত্বসবচেয়ে বড় কারণ হলো—সঞ্চয়ের মানসিকতা। মানুষ তার আরাম-আয়েশ বা বর্তমান আনন্দকে ত্যাগ করতে চায় না। কারণ সঞ্চয়ের জন্য আমাদের সাময়িক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, যা আমাদের মনে সুখকর অনুভূতি দেয় না। আর সঞ্চয়ের জন্য বাইরে থেকে কেউ আমাদের তাগাদা দেয় না। সংসারের জন্য আমরা যতটা প্রয়োজনীয় খরচ করি, ততটাই সঞ্চয়ের কথা ভুলে যাই।
ওয়ারেন বাফেটের একটি বিখ্যাত কথা রয়েছে—"আপনি যে আয় করেন তার একটি অংশ সঞ্চয় করুন, তারপর যা অবশিষ্ট থাকে তা খরচ করুন।" কিন্তু আমরা সাধারণত করি উল্টো। আমরা প্রথমে সমস্ত খরচ করি এবং পরে যদি কিছু অবশিষ্ট থাকে, তখন সঞ্চয়ের কথা ভাবি। এই অভ্যাসই আমাদের সঞ্চয়ের পথে সবচেয়ে বড় বাধা।সঞ্চয় করতে গেলে আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। নিজেকে রাজি করাতে হবে যে আমি সঞ্চয় করবো, যেভাবেই হোক। সেটা অল্পই হোক না কেন, তবু সঞ্চয় করবো। কারণ সঞ্চয় কোনো বড় অঙ্কের টাকা দিয়ে শুরু হয় না, বরং ছোট ছোট অঙ্ক থেকে শুরু হয়। আপনি যদি প্রতিদিন ১০ টাকা সঞ্চয় করতে পারেন, সেটাও একটা বড় অর্জন।
কীভাবে সঞ্চয় শুরু করবেন?সঞ্চয় শুরু করার জন্য আপনাকে প্রথমে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আপনি যদি মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন যে আমি সঞ্চয় করবো, তখন দেখবেন আপনার মন আপনাকে বাধ্য করবে সঞ্চয় করার জন্য। আপনার হাতে অল্প টাকা থাকলেও আপনি সঞ্চয় করবেন। দ্রব্যমূল্য বাড়লেও আপনার সঞ্চয় থেমে যাবে না।
প্রথমে আয় এবং খরচের মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করুন। বাজেট তৈরি করুন এবং কোথায় টাকা যাচ্ছে তা মনিটর করুন। দেখবেন অনেক অপ্রয়োজনীয় খরচ নিজের চোখে ধরা পড়ে যাবে। এসব খরচ বাদ দিয়ে সঞ্চয়ের জন্য একটি নির্দিষ্ট অংশ বরাদ্দ করুন।
সঞ্চয়ের উপকারিতাসঞ্চয় মানে শুধু টাকা জমিয়ে রাখা নয়। এটি ভবিষ্যতের একটি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। জরুরি মুহূর্তে সঞ্চয়ই আপনার পাশে দাঁড়াবে। যখন আপনার আয় কমবে, তখন সঞ্চয়ের টাকাই আপনাকে বাঁচিয়ে রাখবে। আপনার সন্তানদের পড়াশোনা, নিজের চিকিৎসা কিংবা একটি স্বপ্নের বাড়ি কেনার জন্য সঞ্চয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সঞ্চয় আপনাকে মানসিক শান্তি দেবে। আপনি আর্থিকভাবে যত বেশি সুরক্ষিত থাকবেন, ততই আপনার জীবন আনন্দময় হবে। সঞ্চয়ের মাধ্যমে আপনি ঋণের দায়মুক্ত হতে পারবেন এবং ভবিষ্যৎ জীবনে আর্থিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পারবেন।
সঞ্চয় করার জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিকতা। আপনি যদি সঞ্চয়ের জন্য দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হন, তাহলে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিও আপনাকে থামাতে পারবে না। আয় কম হোক কিংবা খরচ বেশি হোক, সঞ্চয়ের জন্য আপনার মনকে প্রস্তুত করুন।
সঞ্চয়ের শুরুটা ছোট হলেও চলবে, কারণ ছোট ছোট অঙ্ক জমতে জমতে একদিন বড় হয়। তাই নিজের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আজ থেকেই সঞ্চয় শুরু করুন। এক টাকা হলেও সঞ্চয় করুন, কারণ সঞ্চয়ই আপনাকে দুঃসময়ে বাঁচিয়ে রাখবে। আপনার সামর্থ্যের চেয়ে বেশি প্রয়োজন নয়, বরং মানসিক প্রস্তুতি এবং সঠিক পরিকল্পনাই সঞ্চয়ের মূল চাবিকাঠি।
সঞ্চয় করুন, নিরাপদ থাকুন, এবং সুখী ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যান।
লেখক: দি আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট বইয়ের লেখক, কলামিস্ট, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট।
এইচআর/এএসএম