দেশের ১০০ উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ (টিএসসি) স্থাপন প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে। ৯২৪ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের কাজ শতভাগ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালের জুনে। অথচ অবহেলা-অপরিকল্পনায় বারবার বেড়েছে সময়। একই সঙ্গে ব্যয় বেড়েছে ২৭৩ শতাংশ। ১ হাজার ৫৯৬ কোটি টাকা বেড়ে এখন প্রকল্পের মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৫২০ কোটি ৪০ লাখ টাকায়। এরপরও প্রকল্পের কাজ শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি।
Advertisement
সম্প্রতি পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) প্রকল্পের কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শন করে এমন প্রতিবেদন তৈরি করেছে। আড়াই বছরের প্রকল্প ১২ বছরে গড়ানোর মধ্যে তিনবার করে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে প্রকল্পের আওতায় নানান ধরনের অপ্রাসঙ্গিক খরচও সচল রাখা হয়েছে। এতে সরকারি অর্থের বিপুল অপচয় হয়েছে বলে মূল্যায়ন সরকারি প্রকল্প তদারকি সংস্থার।
ব্যয় ও সময় বৃদ্ধিপ্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৯২৪ কোটি তিন লাখ টাকা। অনুমোদিত সময় ছিল জানুয়ারি ২০১৪ থেকে জুন ২০১৬ পর্যন্ত। তিন দফা সময় বাড়িয়ে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। তবে এই সময়েও কাজ শতভাগ বাস্তবায়ন হয়নি। ফলে ডিসেম্বর ২০২৫ নাগাদ নতুন করে মেয়াদ বাড়ছে প্রকল্পের। ১০০টি টিএসসিতে এসএসসি (ভোকেশনাল) ও এইচএসসি (ভোকেশনাল) কোর্সে প্রতি বছর ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এক লাখ আট হাজার শিক্ষার্থীর অধ্যয়ন করার কথা। গত আট বছরে লক্ষাধিক শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
এ নিয়ে শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশে কারিগরি শিক্ষা যত বাড়বে ততই মঙ্গল। এই মঙ্গলজনক কাজ বিলম্ব করে জাতির দুটি ক্ষতি হয়েছে। একটি হচ্ছে অর্থ নষ্ট, অন্যটি হলো দেশের শিক্ষার্থীরা কারিগরি শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাই জড়িতদের দ্রুত শাস্তির দাবি জানিয়েছেন তারা।
Advertisement
প্রকল্পের আওতায় ৫৫টি টিএসসির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে ৫৩টি শর্তসাপেক্ষে হস্তান্তর হয়েছে। অবশিষ্ট ৪৫টি টিএসসির মধ্যে ১৯টির পূর্ত ও নির্মাণকাজ হয়েছে ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ, ১৪টির ৫০ শতাংশ ও তিনটির ২৫ থেকে ৪৯ শতাংশ কাজ হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘দেশে যত বেশি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে ততই জাতির জন্য মঙ্গল। দেশের ১০০টি উপজেলায় টেকনিক্যাল (কারিগরি) স্কুল ও কলেজ স্থাপন প্রকল্পের উদ্দেশ্যও দেশের জন্য মঙ্গল। তবে কী কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে দেরি হলো তার কারণ খুঁজে বের করতে হবে। যারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের জরিমানা করা উচিত। এটি বড় অপচয়। এক টাকার কাজে এখন তিন টাকা লাগছে। জড়িতদের শাস্তি দিতে হবে। রাষ্ট্রের টাকা অপচয় হলো, বিষয়টি শুধু তা নয়। আমাদের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হলো, এটাও বড় ক্ষতি।’
‘১০০টি কারিগরি প্রতিষ্ঠান ২০১৬ সালে সমাপ্ত হলে একদিকে টাকা অপচয় হতো না, অন্যদিকে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে দেশের জন্য বড় অবদান রাখতে পারতো। এই অবদান কিন্তু টাকার অঙ্কে হিসাব করা যাবে না। যাদের গাফিলতির জন্য বিলম্ব হতে পারে, ঠিকাদার, ইঞ্জিনিয়ার অথবা কর্মকর্তা যেই হোক; সবাইকে শাস্তি দিতে হবে। শাস্তি হলে ভবিষ্যতে বিলম্ব কমতে থাকবে।’ বলছিলেন অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান।
আইএমইডি প্রতিবেদন জানায়, নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় এক হাজার ৮৭৪ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বা ৭৪ দশমিক ৩৭ শতাংশ। প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। সার্বিক সময় বিবেচনায় প্রকল্পের অগ্রগতি মন্থর, যা ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা।
Advertisement
প্রকল্প প্রসঙ্গে আইএমইডি সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জমি সংক্রান্ত সমস্যা আছে। এ কারণে বারবার সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে। সঠিক পরিকল্পনা করলে এ সংক্রান্ত সমস্যা থাকার কথা নয়। আমরা যাচাই-বাছাই করে পরবর্তীসময়ে সিদ্ধান্ত নেবো।’
আবারও সময় বৃদ্ধির প্রস্তাব প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ‘আমরা আগে সময় বৃদ্ধির যৌক্তিকতা দেখবো। যদি দেখি আগামী ছয় মাসে প্রকল্পের কাজ শতভাগ বাস্তবায়ন হবে তখন মেয়াদ বৃদ্ধি করা হবে। যদি দেখি মেয়াদ বৃদ্ধি করে কোনো কাজ হবে না, তাহলে অসমাপ্ত রেখে সমাপ্ত ঘোষণা করা হবে।’
আইএমইডি জানায়, বারবার প্রকল্প পরিচালক পরিবর্তন ও ভূমি অধিগ্রহণে বিলম্ব, অপরিকল্পিত বাস্তবায়ন এবং রেট শিডিউল পরিবর্তনের ফলে প্রায় ২৭৩ শতাংশ ব্যয় এবং ৩৪০ শতাংশ সময় বৃদ্ধি করা হয়। এছাড়া কর্মপরিকল্পনাগুলোয় নির্দিষ্ট সময়ভিত্তিক ও সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি। প্রকল্পের সব স্তরে সংশ্লিষ্টদের নিবিড় মনিটরিংয়ের অভাব ও প্রণীত কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবায়নের লিংক না থাকার কারণে প্রকল্পের টাইম অ্যান্ড কস্ট ওভাররান হয়েছে। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা এবং চুক্তি ব্যবস্থাপনা বাস্তবায়নের দুর্বলতা দেখা গেছে।
দেশের যেসব উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ নেই অথবা সরকারি ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও সরকারি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার নেই সেসব উপজেলা থেকে নির্বাচিত ১০০টি উপজেলায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। বারবার সময় বৃদ্ধির ফলে সুফল বঞ্চিত হয়েছেন শিক্ষার্থীরা
আইএমইডি আরও জানায়, প্রকল্পটি এর আগে সময়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও নিবিড় মনিটরিং নিশ্চিতে বিভাগ থেকে সুপারিশ করা হলেও তা বাস্তবায়নে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। স্মার্ট প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিনির্মাণে সহায়ক সফটওয়্যার প্রকল্প সংক্রান্ত তথ্য আপলোড করা হলেও নিয়মিত আপডেট করা হচ্ছে না। প্রকল্পের যাবতীয় তথ্য আপলোড ও নিয়মিত আপডেট রাখা অত্যন্ত জরুরি।
আরও পড়ুন:বাদ পড়তে পারে অনেক প্রকল্প, মেগায় কাটছাঁটবিভিন্ন প্রকল্পে কৃচ্ছ্রসাধন, সাশ্রয় হবে ৩৫ হাজার কোটি টাকা সাবেক এমপিদের প্রকল্প বন্ধ করে ২২৫৭ কোটি টাকা সাশ্রয়!আইএমইডি আরও জানায়, প্রকল্পের আওতায় ৫৫টি টিএসসির নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। এরমধ্যে ৫৩টি শর্তসাপেক্ষে হস্তান্তর হয়েছে। অবশিষ্ট ৪৫টির মধ্যে ১৯টির পূর্ত ও নির্মাণকাজ হয়েছে ৯০ থেকে ৯৯ শতাংশ, ১৪টির ৫০ শতাংশ, তিনটির ২৫ থেকে ৪৯ শতাংশ পর্যন্ত।
আইএমইডি জানায়, প্রকল্পের কাজের পরিধি/ব্যাপ্তি বিবেচনায় অগ্রগতি সন্তোষজনক নয় এবং প্রকল্প দপ্তর সংশ্লিষ্টদের প্রকল্প ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতার অভাব দেখা গেছে। এরই মধ্যে প্রকল্পটি ১১ বছর সময় অতিক্রান্ত হয়েছে। প্রকল্পটি প্রণয়নের শুরুতে কোনো সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং নিট অ্যাসেসমেন্ট করা হয়নি। নানান দুর্বলতা প্রকল্প ব্যবস্থাপনার ফলে প্রকল্পটি এত দীর্ঘ সময় ধরে বাস্তবায়ন হচ্ছে। সুতরাং এরই মধ্যে অর্জিত ব্যবস্থাপনাগত জ্ঞান অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অবশিষ্ট কার্যক্রম সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নপূর্বক পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে বাস্তবায়নে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন বলে জানায় আইএমইডি।
প্রকল্পে বারবার সময় ব্যয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে প্রকল্পের সহকারী পরিচালক মো. জমিউল আখতার খোন্দকার জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ চলমান। তবে আরও এক বছর মেয়াদ বৃদ্ধির জন্য আমরা প্রস্তাব করেছি। সময় এখনো বাড়েনি। জমি অধিগ্রহণ ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ স্লো হওয়ায় প্রকল্পের কাজে ধীরগতি হয়েছে।’
অবহেলা ও পরিকল্পনা সমস্যার কারণে ১১ বছরে সময় ও বারবার ব্যয় বেড়েছে বলে দাবি আইএমইডি’র। এ প্রসঙ্গে সহকারী প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো মতামত দিতে পারবো না।’
প্রকল্পের আওতায় প্রধান কার্যক্রম ছিল ১০০টি একাডেমিক প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ (প্রতিটি ২২৬৫ বর্গমিটার), দেড়শ একর জমি অধিগ্রহণ, ভূমি উন্নয়ন, মেশিনারি ও যন্ত্রপাতি ক্রয়, আসবাবপত্র ক্রয়, বাউন্ডারি ওয়াল ও অভ্যন্তরীণ রাস্তা নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম পরিচালনা করা।
প্রস্তাবনায় প্রকল্প এলাকা নির্বাচনের যৌক্তিকতার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, দেশের যেসব উপজেলায় টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ নেই অথবা সরকারি ভোকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ও সরকারি টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার নেই সেসব উপজেলা থেকে নির্বাচিত ১০০টি উপজেলায় এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। অথচ বারবার সময় বৃদ্ধির ফলে সুফল বঞ্চিত হয়েছেন শিক্ষার্থীরা। অন্যদিকে অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সম্পদ। কারণ প্রকল্পটি শতভাগ সরকারি কোষাগারের অর্থে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
এমওএস/এমএইচআর/এমএমএআর/জেআইএম