মতামত

দাবানল দেখালো মানুষ কতটা অসহায়

 

ক্যালিফোর্নিয়ার রাজধানী লস অ্যাঞ্জেলসে দাবানল শুরু হয় ৭ জানুয়ারি। ভয়াবহ ছয়টি সক্রিয় দাবানলে অন্তত ১৪৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা পুড়ে ছাই হয়েছে। ভৌগোলিক বিবেচনায় এ আয়তন নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটান এলাকার আড়াই গুণ। দাবানলের বিপর্যয়ে অন্তত ১২ হাজার অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। আরো ৫৭ হাজার অবকাঠামো ঝুঁকির মুখে রয়েছে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতিতে দাবানলদুর্গত এলাকাগুলো 'আগুনের টর্নেডো'র ঝুঁকিতে রয়েছে। শুরুর দশদিন পরও এর তেজ কিছুটা কমলেও দেখিয়ে দিল মানুষ কতটা অসহায়!

Advertisement

প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়েও দাবানল নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। ভয়াবহ দাবানলে ৬০ লাখের বেশি মানুষের জীবন হুমকির মধ্যে পড়েছে। অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও প্রবল বাতাসে দাবানল নিয়ন্ত্রণে হিমশিম খাচ্ছে কর্তৃপক্ষ। এই বাতাস কমার পূর্বাভাস নেই। লস অ্যাঞ্জেলসের বিধ্বংসী এই দাবানল এ পর্যন্ত অন্তত ২৫ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে।

২০১৮ সালে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকো থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার উত্তরে রেডিংয়ের কাছে একটি বিশাল এবং বিধ্বংসী দাবানলে তিনটি ফুটবল মাঠের আকারের সমান একটি আগুনের টর্নেডো সৃষ্টি হয়েছিল। সেখানে লোকজন তেমন ছিল না, তবে একজন দমকলকর্মী এর কবলে পড়ে প্রাণ হারান। বিজ্ঞানীরা পরে আগুনের টর্নেডোটিকে 'একটি বরফে ঢাকা মেঘের' মতো আকারের বলে বর্ণনা করেন। এটি বাতাসের সঙ্গে ৭ মাইল পর্যন্ত এগিয়েছিল এবং ঘণ্টায় ২৩০ কিলোমিটার গতিতে পর্যন্ত বাতাস সৃষ্টি করেছিল।

সেরকম আশঙ্কা জানুয়ারি ০৭, ২০২৫-এ এসে দাবানল ভয়ংকররুগে আবারো দেখা দিয়েছে! আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দাবানলদুর্গত এলাকাগুলো 'আগুনের টর্নেডো'র ঝুঁকিতে রয়েছে। এটি একটি বিরল বিষয় এবং এমন এক বিপজ্জনক অবস্থা, যেখানে দাবানল 'নিজস্ব আবহাওয়া' তৈরি করে থাকে।

Advertisement

আবহাওয়াবিদ টড হল বলছেন, বর্তমান চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ায় শক্তিশালী টর্নেডো সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার দমকলকর্মীরাও আগুনের টর্নেডোর মুখোমুখি হতে পারে।সান্তা বারবারার ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ুবিদ্যার অধ্যাপক লেইলা কারভালহো বলেন, অশান্ত ধোঁয়াসহ দাবানল একটি মেঘমালা তৈরি করতে পারে। এটি বজ্রপাতের মতো আগুন, ছাই বা ধোঁয়ার ঘূর্ণি তৈরি করতে পারে।

ইউসিএলএর একটি বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই দাবানলগুলো বর্তমান বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আরো বড় এবং আরো গরম হয়ে উঠেছে, যেখানে গ্রিনহাউজ গ্যাস দূষণ একটি বড় ভূমিকা রেখেছে। দাবানল প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রয়োজন ক্রমশ বাড়ছে এবং এর সঙ্গে জড়িত প্রতিটি জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার লড়াই এখন আরো কঠিন হয়ে উঠেছে।

লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টি, আনুষ্ঠানিকভাবে কাউন্টি অব লস অ্যাঞ্জেলেস ও কখনও কখনও সংক্ষিপ্তভাবে এল.এ. কাউন্টি হিসেবে পরিচিত। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের সবচেয়ে জনবহুল কাউন্টি। দশদিন পর ৬০ লাখেরও বেশি মানুষ মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলেস, আনাহেইম, রিভারসাইড, স্যান বারনারডিনো ও অক্সনার্ড এ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে প্যালিসেডস ও ইটন দাবানল দুটি এখন সবচেয়ে বিধ্বংসী দাবানল হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

কেন এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে দাবানল? লস অ্যাঞ্জেলেসে গত কয়েক দশক ধরে খরা, এরপর সাম্প্রতিক বছরগুলো ভারী বৃষ্টিপাত, পরে শরৎ ও শীতকালের শুষ্ক পরিস্থিতিতে ফিরে আসা সবই আগুনের জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। শক্তিশালী স্যান্টা আনা বাতাস গাছপালাগুলো শুকিয়ে ফেলে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে দিয়েছে। স্যান্ট আনা বাতাস হলো শক্তিশালী, শীতল, শুষ্ক, ঝড়ো বাতাস যাকে কখনো কখনো ডেভিল উইন্ডসও বলা হয়।

Advertisement

এই উচ্চ-চাপ বায়ু যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাঞ্চলের গ্রেট বেসিন এলাকা যা মূলত নেভাডা, ইউটাহ, আইডাহো ও দক্ষিণ-পূর্ব ওরেগনের উসর মরুভূমি অঞ্চল থেকে উৎপন্ন হয় এবং ক্যালিফোর্নিয়ার দিকে প্রবাহিত হয়। দাবানলের মধ্যেই তীব্র এই বাতাস আগুনকে দ্রুত ছড়িয়ে দেয়। এ ছাড়াও আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার জন্য সরঞ্জাম ও জনবল সংকটকে দায়ী করছেন অনেকে। বলা হচ্ছে, স্থানীয় সংস্থাগুলো তাদের সীমিত সরঞ্জাম নিয়ে বিশাল ও দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়া দাবানল ঠেকাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টির ফায়ার চিফ বুধবার বলেছেন, এই দাবানল মোকাবিলার মতো যথেষ্ট দমকলকর্মী তাদের নেই। লস অ্যাঞ্জেলেসের রাস্তাগুলোয় সাধারণ দিনেও যানজট থাকে। ফলে যখন সবাই ভূমিকম্প বা দাবানলের সময় পালানোর চেষ্টা করে তখন একেবারে অন্যরকম পরিস্থিতি দেখা দেয়। একারণে, দমকল কর্মীরাও মুক্তভাবে কাজ করতে পারেননি।

এছাড়াও এই এলাকার ভৌগোলিক গঠনকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার পেছনে কারণ হিসেবে কাজ করছে বলেও মনে করছেন কেউ কেউ। দাবানল খুবই ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগ । এর নাম শুনলেই মনের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি। যখন কোনো আগুনের উৎস প্রচণ্ড তাপমাত্রায় এবং যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসে, তখন দাবানলের সূত্রপাত ঘটে। তারপর বিভিন্ন বনভূমিসহ আবাসস্থল পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বহু এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ১০ দাবানলের ৮টিই গত ৫ বছরে হয়েছে। এর কারণ হিসেবে দেশটির পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা বলেছে, গ্রীষ্মের শুষ্ক মৌসুম লম্বা হওয়া এবং বসন্তের অপেক্ষাকৃত উষ্ণ আবহাওয়ার কারণে মৌসুমের আগেই দাবানল দেখা দিচ্ছে।’

আজকাল ৮৫ শতাংশ ক্ষেত্রে দাবানলের কারণ মানুষ। যদিও সেগুলোর বেশির ভাগই অনিচ্ছাকৃত। যেমন ক্যাম্পফায়ারের আগুন ঠিকমতো না নেভানো বা বৈদ্যুতিক তারের স্ফুলিঙ্গ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়ে দাবানলের সৃষ্টি হয়। গত কয়েক দশকে দ্রুত নগরায়ণ ও প্রকৃতির গভীরে মানুষের বসতি স্থাপনকে এ জন্য দায়ী করা হয়েছে।

একই দেশের একদিকে দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন, আরেক প্রান্তে হচ্ছে তুষারপাত। মানুষকে ঘর থেকে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে। আবার কোথাও বলা হচ্ছে, প্রাণ বাঁচাতে হলে দ্রুত ঘর ছাড়ুন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারী অনেকে লস অ্যাঞ্জেলেসের এ ঘটনাকে গাজার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীদের অনেকে আবার লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল এবং গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের নিয়ে সমবেদনা প্রকাশের ক্ষেত্রে পার্থক্য খুঁজেছেন। তারা বলছেন, দাবানলে ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি যেভাবে সমবেদনা প্রকাশ করা হচ্ছে ইসরায়েলি হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে তার বিপরীত দেখা যাচ্ছে। আবার অনেকেই বলছেন এটাই প্রকৃতির লীলা-খেলা ।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ধ্বংসাত্মক দাবানল নেভানোর কাজে শত শত কারাবন্দিদের নামানো হয়েছে। তাদের দিয়ে দমকলকর্মীর কাজ করানো হচ্ছে। আগুন নেভাতে পেশাদার ফায়ার ফাইটাররা যথেষ্ট নয়। তাই দাবানলের বিরুদ্ধে লড়াই করতে ৭৮৩ জন কারাবন্দিকে দমকলকর্মীর কাজে মোতায়েন করা হয়েছে। বন্দিদের ক্যালিফোর্নিয়ার বন ও অগ্নিসুরক্ষা বিভাগের অধীনে রেখে কাজ করানো হচ্ছে। সাথে প্রায় দুই হাজার অগ্নিনির্বাপক কর্মী দিনরাত কাজ করে আগুন নতুন এলাকায় ছড়ানো ঠেকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।

ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজায় অবশেষে টানা ১৫ মাস ধরে চলা নৃশংসতার কোন শেষ নাই যেন।২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে হামলা চালিয়ে ১২০০ জনকে হত্যা করে এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়। এরপর থেকে গাজায় ইসরায়েল ব্যাপক হামলা চালানো শুরু করে। এসব হামলায় গত ১৫ মাসে ৪৬ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে গাজায় হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

কেউ মন্তব্য করেছেন, ‘১০ কোটি আদিবাসী হত্যা করে বিশাল এই ভূখণ্ড দখল আর জাপান কোরিয়া ভিয়েতনাম কম্বোডিয়া লাওস ইরাক আফগানিস্তান লিবিয়া সিরিয়াসহ পৃথিবীর দেশে দেশে আগ্রাসন গণহত্যা আর লুটপাটের করা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী দেশে করোনায় ১২ লাখের বেশী মানুষ মারার পরও কোনো শিক্ষা হয়নি। তাই আবার প্রকৃতির শাস্তি নেমে এসেছে।’

দাবানলের ঝড়ো বাতাস যাকে কখনো কখনো ‘ডেভিল উইন্ডস’ বা শয়তানের বাতাসও বলা হয়। কেউ বলেন এটা দোজখের আগুন। তবে সেগুলো কিছুই নয় এই দাবানল।দোজখের আগুন এর চেয়েও অতি ভয়ংকর হবে।যা পৃথিবীর জীবিত মানুষরা কল্পনাও করতে পারবে না।

দাবানলের ফলাফল খুবই ভয়ানক। এতে প্রাণহানি কম হলেও আর্থিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দাবানল মূলত যেখানে শুরু হয় সেই এলাকার মূল্য শূন্য টাকায় নিয়ে আসে। কারণ তা দাবানলে কোন কিছুই নষ্ট হওয়ার বাকি থাকে না। তবে সতর্ক থাকলে দাবানল থেকে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হলেও এর করুণ মেসেজ হলো হঠাৎ ধনী-মানুষকে পথের ফকির করানো!

দাবানল একটি ধ্বংসাত্মক দুর্যোগ হলেও, যথাযথ সচেতনতা এবং প্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে এর ক্ষতি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। আমেরিকার লস এঞ্জেলস এলাকায় চলমান দাবানল সবকিছু পুড়ে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। আর এ বিষয়ে যারা আগে থেকেই সতর্ক ছিলেন তারা দাবানলে কিছুটা হলেও অন্যদের থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এরিয়া ছেড়ে চলে যেতে পেরেছেন। অনেকেই নিজেদের দামী সম্পদ দাবানল থেকে রক্ষা করতে পেরেছেন। এবারের দাবানলদুর্গত এলাকাগুলো 'আগুনের টর্নেডো'র ঝুঁকিতে ছিল। দশদিন পর অনেকটা দুর্বল হবার পর দাবানল দেখিয়ে দিল- প্রাকৃতিক দুর্যোগের কাছে মানুষ কতটা অসহায়। তাই আসুন সবাই দাবানল সম্পর্কে সঠিক তথ্য জেনে সচেতন হই।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন।fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/এমএস