মিষ্টি খেতেও এখন গুনতে হবে বাড়তি টাকা। দেশে চলমান অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে শতাধিক পণ্য ও সেবায় ভ্যাট এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। মিষ্টি ও মিষ্টিজাত পণ্যে ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ শতাংশ। এরই মধ্যে দাম বাড়ানোয় কমেছে বিক্রি। ক্ষুব্ধ ক্রেতারা। স্বাদের মিষ্টিও যেন তেতো ঠেকছে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের কাছে।
Advertisement
খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলমান মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষ নাজেহাল। তার ওপর অর্থবছরের মাঝে এভাবে হঠাৎ শুল্ক বাড়ানো ব্যবসায় মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আরও কমবে। গত ডিসেম্বরেও খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল প্রায় ১৩ শতাংশ। এমন পরিস্থিতিতে শতাধিক পণ্যের শুল্ক ও কর বাড়ানো সাধারণভাবেই মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় আরেক দফা বাড়াবে।
২৮০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি করতাম তা এখন ৩৪০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার একটু ভালো মানের মিষ্টি যেগুলো ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকায় বিক্রি করতাম সেগুলো এখন ৫৪০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। ফলে ক্রেতাদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দ্বন্দ্ব হচ্ছে। আমরা ক্রেতা হারাচ্ছি।- রসের ফোঁটা মিষ্টির দোকানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার তানজিল রহমান
সরেজমিনে রাজধানীর মিষ্টির দোকানগুলো ঘুরে দেখা যায়, অলস সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা। ক্রেতার আনাগোনা কম। কিছু দোকানে মিষ্টির দাম এরই মধ্যে প্রতি কেজিতে বেড়েছে ২০-৭০ টাকা। আবার অনেক দোকানে দাম না বাড়লেও শিগগির বাড়ানো হবে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা।
Advertisement
রাজধানীর মিরপুর-১ রসের ফোঁটা মিষ্টির দোকানের অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার তানজিল রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘৯ তারিখ ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর পর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের ব্র্যাঞ্চে। বিক্রি ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ কমেছে। পাশাপাশি আমদের প্রতিদিন গড়ে আট থেকে ১০ হাজার টাকার মিষ্টি নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার আসলে কী করছে আমি বুঝতে পারছি না। প্রথমে সুদহার বাড়ালো, এখন আবার ভ্যাট বাড়লো। সব স্টিমরোলার কেবল সাধারণ জনগণের ভোগ করতে হচ্ছে। একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ তার ওপর করের বোঝা। আমাদের তো বেঁচে থাকাই দায় হয়ে যাচ্ছে।–মিষ্টি ক্রেতা আজিজ
তিনি বলেন, ‘হঠাৎ শুল্ক বাড়ানোর ফলে আমরা প্রায় সব ধরনের মিষ্টির দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছি। আমাদের সাধারণ সাদা মিষ্টি যা ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি করতাম তা এখন ৩৪০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। আবার একটু ভালো মানের মিষ্টি যেগুলো ৪৫০ থেকে ৪৮০ টাকায় বিক্রি করতাম সেগুলো এখন ৫৪০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। ফলে ক্রেতাদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে দ্বন্দ্ব হচ্ছে। আমরা ক্রেতা হারাচ্ছি। যার আয় কম তিনি এক কেজি মিষ্টি কীভাবে কিনে খাবেন। আমরা চাই যত দ্রুত সম্ভব একটা ন্যায্য সমাধান হোক। অন্যথায় আমাদের ব্যবসা বন্ধ করতে হবে।’
খাবার পণ্যের ভ্যাট ১৫ শতাংশ বাংলাদেশে যৌক্তিক নয়মরণ চাঁদ গ্র্যান্ড সন্স মিরপুর ব্র্যাঞ্চের ম্যানেজার গোপাল ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা ভালো মানের মিষ্টি সুলভমূল্যে বিক্রি করি। লাভ সীমিত হয়। আগে আমরা ২ টাকা হলেও লাভ করতে পারতাম। কিন্তু ভ্যাট বাড়ানোর কারণে এখন দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছি, ফলে বিক্রি কমেছে। ক্রেতাদের সঙ্গে তর্ক হচ্ছে। আসলে খাবার পণ্যের ভ্যাট ১৫ শতাংশ বাংলাদেশে যৌক্তিক নয়।’
Advertisement
প্রিন্স সুইটস অ্যান্ড বেকারি মিরপুর শাখার ক্যাশ ম্যানেজার বলেন, ‘ভ্যাট বাড়ানোর বিষয়টা অনেক কাস্টমার বোঝে না। যদি আমরা মিষ্টির দামের সঙ্গে আলাদা ভ্যাট বসিয়ে বিক্রি করতাম তাহলে তারা বুঝতে পারতো যে ভ্যাট বাড়ার প্রভাবে দাম কেন বাড়ে। আমাদের মিষ্টির দাম এখনো বাড়াইনি। ব্যবস্থাপনা কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে যে দাম কতটা বাড়ানো হবে।’
‘হঠাৎ ভ্যাট বৃদ্ধি ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ যে আগে দুই কেজি মিষ্টি কিনতো সে এখন এক কেজি কিনবে অথবা কিনবেই না। ফলে আমাদের সেল কমবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ডিসেম্বর থেকে জানুয়ারির বেচাকেনা কম হচ্ছে। এভাবে চলতে পারে না।’ বলেন ওই ম্যানেজার।
আমরা শঙ্কিত যে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবো কি না। এর প্রভাব বোঝা যাবে কিছুদিন পর। বড় বড় মিষ্টির ব্র্যান্ড ছাড়াও যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আছেন তাদের অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে।- বাংলাদেশ মিষ্টি প্রস্তুতকারক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ননী গোপাল ঘোষ
মিষ্টি ও বেকারি ব্যবসার পরিচিত নাম মিঠাই। ব্র্যান্ডটির অ্যাসিস্ট্যান্ট ব্র্যান্ড ম্যানেজার মাসুম বিল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এখনো আমাদের মিষ্টির দাম বাড়াইনি। আমাদের ব্যবস্থাপনা কমিটির অভ্যন্তরীণ আলোচনা চলছে যে কী পদক্ষেপ নেওয়া যায়। ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ার প্রভাব এখনো দেখা যাচ্ছে না। হয়তো এই মাসের শেষ দিকে বোঝা যাবে। আমরা অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেবো।’
ক্ষুব্ধ ক্রেতারাব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ক্রেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। প্রিন্স সুইটস অ্যান্ড বেকারি মিরপুর শাখায় মিষ্টি কিনতে এসেছেন হাসান আজিজ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার আসলে কী করছে আমি বুঝতে পারছি না। প্রথমে সুদহার বাড়ালো, এখন আবার ভ্যাট বাড়লো। সব স্টিমরোলার কেবল সাধারণ জনগণের ভোগ করতে হচ্ছে। একদিকে মূল্যস্ফীতির চাপ তার ওপর করের বোঝা। আমাদের তো বেঁচে থাকাই দায় হয়ে যাচ্ছে।’
২০ হাজার কোটি টাকার ব্যবসাবাংলাদেশ মিষ্টি প্রস্তুতকারক সমিতির তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে তাদের এই সংগঠনের আওতায় নিবন্ধিত প্রায় ৪০০ সদস্য রয়েছেন। এর বাইরে সারাদেশে আরও দুই হাজারের বেশি স্থানীয় উদ্যোক্তা বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা দেশব্যাপী বছরে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার দই-মিষ্টির ব্যবসা করেন।
ভ্যাট বাড়ানো নয়, আরও কমানোর দাবিসমিতির সাধারণ সম্পাদক এবং ননী সুইটসের স্বত্বাধিকারী ননী গোপাল ঘোষ জাগো নিউজকে বলেন, ‘অর্থবছরের মাঝে এসে হঠাৎ করে এভাবে ভ্যাট বাড়ানোয় আমরা নিজেরাও চমকে গেছি। এর ফলে সার্বিকভাবে আমাদের মিষ্টি ব্যবসায় মারাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সমাজের উচ্চবিত্ত থেকে শুরু করে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ আমাদের ক্রেতা। আগে থেকেই মূল্যস্ফীতির চাপ বিরাজ করছে। এটা বাড়তি চাপ তৈরি করবে। ক্রয়ক্ষমতা আরও কমে যাবে, যা আমাদের ব্যবসায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।’
আগে মিষ্টিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল, যা কমিয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে প্রথম যখন ভ্যাট আইন হয় তখন থেকে মিষ্টিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ভ্যাট ১৫ শতাংশই ছিল। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদের দাবির মুখে ভ্যাট কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করা হয়। ভ্যাট কমানোয় আমাদের ব্যবসা ভালো হচ্ছিল এবং সরকারের এ খাত থেকে রাজস্বও বেড়েছিল। আবার ভ্যাট বাড়ালে আমাদের বিক্রি কমার পাশাপাশি সরকারের রাজস্বও কমবে।’
‘আমরা শঙ্কিত যে ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে পারবো কি না। এর প্রভাব বোঝা যাবে কিছুদিন পর। বড় বড় মিষ্টির ব্র্যান্ড ছাড়াও যারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা আছেন তাদের অনেকেই ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন। কারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমবে।’
সরকারকে উদ্দেশ্য করে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘অর্থবছরের এই সময়ে এসে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো তা যত দ্রুত সম্ভব প্রত্যাহার করা উচিত। যেহেতু ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৭ শতাংশ করার ফলে রাজস্ব বেড়েছে, তাই এটা আরও কমানো গেলে রাজস্ব বাড়বে বলে আমরা মনে করি। গত অর্থবছর আমরা মিষ্টির ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করার আবেদন করেছিলাম। আমরা সেটার বাস্তবায়ন চাই।’
আরও যেসব পণ্যে ভ্যাট/সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছেপটেটো ফ্ল্যাকস, কর্ন, মেশিনে প্রস্তুত বিস্কুট, হাতে তৈরি বিস্কুট, আচার, চাটনি, টমেটো পেস্ট বা টমেটো কেচাপ বা সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প, তেঁতুলের পেস্ট, ট্রান্সফরমারের তেল, লুব্রিকেন্ট তেল, এলপি গ্যাস, আমদানি করা বাল্ক পেট্রোলিয়াম বিটুমিন, বিআরটিএ থেকে নেওয়া লেমিনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্স, কঠিন শিলা, ফেরো-ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো-সিলিকো ম্যাঙ্গানিজ, ফেরো সিলিকন অ্যালয়, এইচআর কয়েল থেকে সিআর কয়েল, সিআর কয়েল থেকে জিপি শিট, জিআই তার, ৫ কেভিএ থেকে ২ হাজার কেভিএ বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, চশমার প্লাস্টিক ফ্রেম, চশমার মেটাল ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, নারিকেলের ছোবড়া থেকে তৈরি ম্যাট্রেসের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। এসব পণ্যের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এছাড়া রেস্তোরাঁর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ, ইনভেন্টিং সংস্থার ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। কিচেন টাওয়েল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু, হ্যান্ড টাওয়েল, সানগ্লাস, নন-এসি হোটেল, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটা, নিজস্ব ব্র্যান্ড-সম্বলিত তৈরি পোশাকের শোরুম বা বিপণিবিতান– এসব পণ্য ও সেবার ওপর প্রযোজ্য ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
বৈদ্যুতিক খুঁটি, মোটরগাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ, ডকইয়ার্ড, ছাপাখানা, চলচ্চিত্র স্টুডিও, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী (সিনেমা হল), চলচ্চিত্র পরিবেশক, মেরামত ও সার্ভিসিং, স্বয়ংক্রিয় বা যন্ত্রচালিত করাতকল, খেলাধুলা আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার, বোর্ড সভায় জোগানকারী, টেইলারিং শপ ও টেইলার্স, ভবন রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থা, সামাজিক ও খেলাধুলা-বিষয়ক ক্লাব ইত্যাদি সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
এসআরএস/এএসএ/জিকেএস