ক্যাম্পাস

যেসব অভিযোগে ভাঙলো ঢাবির সাদা দল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল ভেঙে একই নামে নতুন সংগঠন গঠন করেছে সাদা দলের একাংশ। এই অংশটির শিক্ষকরা বর্তমান নেতৃত্ব ও প্রস্তাবিত নেতৃত্বের অগ্রহণযোগ্যতার বিভিন্ন কারণ তুলে ধরেছেন। এনেছেন বিভিন্ন অভিযোগও।

Advertisement

সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) রাত ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে কারণগুলো উল্লেখ করেন শিক্ষক নেতৃবৃন্দ। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল ইসলাম তালুকদার।

এ সময় বেশকিছু কারণ দেখিয়ে সাদা দলের বর্তমান ও প্রস্তাবিত নেতৃত্বকে অগ্রহণযোগ্য বলে উল্লেখ করেন শিক্ষকরা। সেগুলো হলো-

বিশেষ সিন্ডিকেটের ইচ্ছায় গঠনতন্ত্রসাদা দল পরিচালনায় যোগ্য নেতৃত্ব গড়ে তোলার লক্ষ্যে দীর্ঘ সংগ্রামের পর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় অনুষদ এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সংঠনের একটি গঠনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এই গঠনতন্ত্রে সাদা দলের প্রতিটি কনভেনিং কমিটির মেয়াদ ছিল এক বছর। কিন্তু একটি বিশেষ গোষ্ঠী দীর্ঘদিন পদ আঁকড়ে থাকার অসৎ অভিপ্রায়ে ২০১১ সালে (২৬ অক্টোবর) প্রকাশিত গঠনতন্ত্রের মেয়াদ এক বছর থেকে অবৈধভাবে ২ বছর করে। অথচ গঠনতন্ত্র অনুসারে, কোনো পরিস্থিতিতে গঠনতন্ত্রের উল্লেখিত কমিটির মেয়াদ লঙ্ঘনের বিধান নেই। মেয়াদকাল ২ বছর করেই এরা ক্ষান্ত হননি। পদ আঁকড়ে একই পদে ২ থেকে ৩ টার্ম থাকেন। বিভিন্ন পদ মিলিয়ে এই সিন্ডিকেট বিগত ১৫/২০ বছর ধরে দলের কনভেনিং কমিটি নিয়ন্ত্রণ করেছে।

Advertisement

গঠনতন্ত্রবিরোধী বিশেষ বলয় কমিটিসাদা দলের বিভিন্ন ইউনিটের আহ্বায়ক ও কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধি নিয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির ক্ষমতা খর্ব করে ৬ সদস্যের একটি সংকীর্ণ বলয় (কোটারি) সিন্ডিকেট কমিটি গঠন করা হয়েছে, যা গঠনতন্ত্রবিরোধী। এই বিশেষ কমিটির কারণে সাদা দলের নেতৃত্ব ঘুরে-ফিরে একটি বিশেষ জায়গায় সীমাবদ্ধ রয়েছে। এই ছয় সদস্যের কমিটি সব পদ-পদবি ও সুযোগ-সুবিধা প্রদানের নিয়ন্ত্রণকর্তা ও দলের নীতি-নির্ধারণ করে। গণতান্ত্রিক পথ অবলম্বন না করে এই বিশেষ বলয় ঘুরে-ফিরে মাইম্যানদের বিভিন্ন জায়গায় বসিয়েছে। এছাড়া তারা বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী প্রশাসনের তল্পিবাহক হিসেবে কাজ করেছে।

স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক মনোভাবসাদা দলের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক সদস্য আছেন যারা বিগত ১০ থেকে ১৫ বছর কেন্দ্রীয় কমিটির বিভিন্ন পদ কুক্ষিগত করে রেখেছেন। তাদের এই স্বৈরাচারী এবং অগণতান্ত্রিক মনোভাবের বিরুদ্ধে দলের ভেতর কেউ কথা বললে এই সিন্ডিকেট নানামুখী চাপের মাধ্যমে, এমনকি প্রশাসন ব্যবহার করে প্রতিবাদীদের দলের ভেতরে কোণঠাসা করে ফেলে। এ কারণে জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী সাদা দল আজ প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এমন মানসিকতা সাদা দলে বলিষ্ঠ ও সুনেতৃত্ব না আসারও অন্যতম কারণ। বিশেষ জায়গায় নেতৃত্ব কুক্ষিগত থাকায় সাধারণ শিক্ষক এমনকি জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষকরাও সাদা দলের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণে দীর্ঘদিন অনীহা প্রকাশ করে আসছেন।

ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলনের ব্যর্থতাসাদা দলের বর্তমান কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে অসংখ্য ইস্যু থাকা সত্ত্বেও যৌক্তিক ও কার্যকর আন্দোলন এবং জনমত গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী অপশাসন-অনাচারে ছাত্র-জনতা অতিষ্ঠ ছিল। কিন্তু সাদা দলের সিন্ডিকেট নেতৃত্ব কোনো ইস্যুতে যৌক্তিক আন্দোলন কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক পথ দেখাতে পারেনি। ক্ষেত্রবিশেষ তারা দু-একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দায় সেরেছে। আবার কখনোবা সংবাদ বিজ্ঞপ্তি (প্রেস রিলিজ) দিতেও সাহস করেনি। উপরন্তু, এসব নেতৃবৃন্দ ফ্যাসিস্ট আওয়ামী চেতনায় বিশ্বাসী নীল দলের বিতর্কিত এবং অত্যাচারী নেতাদের সঙ্গে মিলেমিশে বিভিন্ন সময়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি সফলভাবে সম্পাদনে গোপন সহায়তা করেছে।

আরও পড়ুনঢাবির সাদা দল ভেঙে একই নামে নতুন সংগঠন জুলাই ঘোষণাপত্র দেবে সরকার, শহীদ মিনারে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ 

দ্বিচারিতা ও বিশ্বাসঘাতকতাসাদা দলের বহু সদস্যকে আওয়ামী শাসনের সময় নানানভাবে নাজেহাল ও নিপীড়ন করা হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো সদস্যকে অবৈধভাবে সাময়িক বা স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- এই সিন্ডিকেটের কেউ কেউ ট্রাইব্যুনাল ও তদন্ত কমিটিতে থাকা সত্ত্বেও দলের সদস্যদের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হন। উপরন্তু, নীল দলের সদস্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভুক্তভোগীদের সাময়িক/স্থায়ী বহিষ্কারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেন। এছাড়া সাদা দলের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক সদস্য বিগত ১৬ বছর বিভিন্ন দলীয় নির্বাচনে নীল দলকে সহযোগিতা করেছেন। নীল দলের সঙ্গে আপসের মাধ্যমে ব্যক্তিগত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সাদা দলের বিগত নেতৃত্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অন্যায় অযৌক্তিক কর্মকাণ্ডে চুপ থেকেছে।

Advertisement

দলে অবৈধ প্রভাব বিস্তারসাদা দলের সাবেক দুই আহ্বায়ক বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অন্য দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষস্থানীয় পদে আছেন। কিন্তু সেখান থেকে তারা এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাদা দলের ইউনিট সভায় উপস্থিত থেকে দলে অবৈধ প্রভাব বিস্তার করছেন। এটা দৃষ্টিকটু। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এ ধরনের রাজনীতি পছন্দ করছেন না। এছাড়া সাদা দলের কিছু সদস্য বিএনপির কেন্দ্রীয় পদে অধিষ্ঠিত থেকে সাদা দলের কার্যক্রমে প্রভাব বিস্তার করছেন, যা সাদা দলের বিকাশে অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আস্থা হারানোবর্তমান নেতৃত্বের প্রতি সাদা দলের সাধারণ শিক্ষকদের কোনো আস্থা নেই। শিক্ষকদের কোনো যৌক্তিক দাবি, সুযোগ সুবিধা আদায়ে সাদা দলের সিন্ডিকেট নেতৃত্ব পুরোপুরি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে সাধারণ ছাত্র থেকে শুরু করে জাতীয়তাবাদী চেতনায় বিশ্বাসী শিক্ষার্থীরা নির্যাতিত হয়েছেন। কিন্তু সাদা দল শিক্ষার্থী নির্যাতন বন্ধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। সর্বোপরি শিক্ষক-শিক্ষার্থীবান্ধব কর্মসূচি প্রদান কিংবা দাবি-দাওয়া আদায়ে ব্যর্থ হওয়ায় সাধারণ শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে সাদা দল আবেদন হারিয়েছে।

নারী নেতৃত্বের প্রতি বৈষম্যসাদা দলের গঠনতন্ত্রের স্পিরিট অনুসারে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রতি সদস্য সমান অধিকার ভোগ করবে। কিন্তু বিগত সময়ে সাদাদলের বর্তমান নেতৃত্বের একটি বড় অংশ নারী নেতৃত্বের প্রতি বিভিন্ন সময়ে বৈষম্য প্রদর্শন করেছে। কয়েক বছর আগে তৎকালীন সাদা দলের নিবেদিত প্রাণ জ্যৈষ্ঠ অধ্যাপক ড. লায়লা-নূর-ইসলামকে ছলে-বলে কৌশলে সাদা দলের আহ্বায়ক হতে দেওয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তিনজন শিক্ষকের একজন নারী। নারী নেতৃত্ব গঠনে বৈষম্য করায় নারী শিক্ষকদের মধ্যে সাদা দল গুরুত্ব হারিয়েছে।

ইসলামি মূল্যবোধবিরোধী কর্মকাণ্ডসাদা দলের সদস্য সাবেক এক আহ্বায়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি থাকাকালীন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী আদর্শকে সমর্থন এবং ইসলামি মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এমন অনেক লিখিত বিবৃতি/বক্তব্য দেন। এটা সাদা দলের স্পিরিটের সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক।

এমএইচএ/কেএসআর