মতামত

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ড নাকি নথি নষ্টের নাশকতা?

দেশের সবচেয়ে সুরক্ষিত সরকারী অফিস পাড়ায় অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়েছে গত ২৫ ডিসেম্বর রাত দুটার দিকে। বড়দিনের সরকারী ছুটির রাতে নিঝুম নীরবতা ভেঙ্গে সুউচ্চ ভবনের ৬ তলায় আগুনের সূত্রপাত দেখে রাতে নিয়োজিত নিরাপত্তাকর্মীরা ছুটোছুটি করা শুরু করলেও তারা দেখতে পান লেলিহান শিখা মুহূর্তের মধ্যে ছয়তলা থেকে উপরের নয়তলা পর্যন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে। অগ্নিনির্বাপক দল খবর পাওয়ার পর আগুন নেভাতে এসে সচিবালয়ের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করলেও মূল ফটকগুলো তখনও বন্ধ থাকায় বড় গাড়ি নিয়ে সরাসরি ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। সংবাদে জানা গেছে, তারা তালা ভেঙ্গে পানির গাড়ি নিয়ে অনেক পরে ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছেন।

Advertisement

অগ্নি নির্বাপক দলগুলো তাদের ২০টি ইউনিটকে কাজে লাগিয়ে ৭ ঘণ্টার চেষ্টায় পরদিন সকাল ৯টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সমর্থ হয়েছেন। কিন্তু ততক্ষণে পুড়ে গেছে সরকারী অফিসের মূল্যবান নথিপত্র, আসবাব, কম্পিউটার, সিসি ক্যামেরা, লিফট, ও নানা দ্রব্যাদি। এতে সাতটি মন্ত্রণালয়ের ক্ষতি হয়েছে এবং পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের মূল্যবান ফাইল নষ্ট হয়েছে।

ডিসেম্বর ২৬ তারিখে সকালবেলা সচিবালয়ের অফিসার ও কর্মচারীগণ অফিসে এসে ঢুকতে পারেননি। তাদের অনেকের মূল্যবান জিনিস, সার্ভিসবুক ওই অফিসে রক্ষিত ছিল, সেগুলোও নষ্ট হবার আতঙ্কে রয়েছেন। অনেকের মনে নানা প্রকার ভীতি কাজ কাজ করছে। রাত শেষ হয়ে আজ সারাদিন গণমাধ্যমে সচিবালয়ের অগ্নিকাণ্ড দেশ বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হচ্ছে। তা দেখে জনমনে প্রশ্ন জেগে উঠছে-এটা কি নিছক কোন অগ্নিদুর্ঘটনা নাকি কোন গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ?

কারণ, সচিবালয়কে ঘিরে গত ৫ আগস্টের পর থেকে নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার জন্ম নেয়ায় ইতোমধ্যে গোটা জাতিক ভাবিয়ে তুলেছে। ছাত্রজনতার আন্দোলনের পর অনেকগুলো পালটা ঘটনা বা প্রতিবিপ্লবের জন্ম হয়েছিল। তারমধ্যে একটি হলো আনসারদেরকে দিয়ে সচিবালয় ঘেরাও করার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সরকারী অফিসের দখল নেয়া। ছাত্র-জনতা সেটাকে রুখে দিয়েছিল।

Advertisement

এরপর প্রায় প্রতিদিন রাজপথ বন্ধ করে বিভিন্ন দাবি আদায়ের চেষ্টার মাধ্যমে বিশৃঙ্খলা তৈরি করা একটি নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেটা কিছুটা কেটে গেলেও বন্ধ করা যায়নি। পোশাক কারখানায় বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, বকেয়া আদায় না হওয়া, অবৈধ ছাঁটাই ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যাপক আন্দোলন সৃষ্টি করে বড় বড় বিশৃঙ্খলা প্রতিনিয়ত ঘটেই চলেছে। কিন্তু কোনটিই পেরে উঠছে না সেভাবে।

তার ভেতরে সচিবালয়ের দিকে শ্যেনদৃষ্টি পড়েছে বিভিন্ন মহলের। যেখানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির গোপন তথ্যাবলির ফাইলপত্র রক্ষিত রয়েছে। এসব ফাইল নিয়ে এতদিন কারো কোন মাথাব্যথা ছিল না কিন্তু সম্প্রতি আলোচিত কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ব্যাপক দুর্নীতির নথি তলব করা হয়েছে মামলা সচল কারার প্রয়োজনে। বিশেষ করে যোগাযোগ, ডাক-তার ও স্থানীয় সরকার প্রভৃতি মন্ত্রণালয়ে যেখানে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করা হয়েছে বলে তথ্য প্রকাশিত হওয়ায় সেগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্টজনেরা বিচলিত হয়ে পড়েছেন বলে সংবাদ প্রচারিত হতে থাকে।

এছাড়া বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসের সদস্যদের মধ্যে পদোন্নতি, মামলা, হয়রানি ইত্যাদি নিয়ে ব্যাপক অসন্তোষ বিরাজ করছে দীর্ঘদিন যাবত। বিগত প্রশাসনের সময় পদবঞ্চিতগণ ৫ আগস্টের পর থেকে মুখ কুরতে শুরু করেছেন। তারা গত এক যুগাধিককাল চাকুরিতে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হয়ে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে একপ্রকার ‘হাইবারনেশনে’ছিলেন।

তারা অন্তর্বর্তী সরকারের শুরুতেই হঠাৎ সামনে বের হয়ে সাহসী হয়ে উঠেছেন নিজেদের দাবি আদায়ের জন্য। কিন্তু এতে করে ‘সুপারসেট’সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের দোসর বলে চিহ্নিতদের সাথে একসঙ্গে কাজ করতে গিয়ে চরম রেষারেষির মুখে পড়ে গছেন। ফলত: দেখা দিয়েছে চরম বিশৃঙ্খলা ও অসহযোগিতা। এই ধরনের বিশৃঙ্খলা সচিবালয়ের বাইরেও বিরাজমান। কিন্তু সচিবালয় একটি বৃহৎ অফিস পরিমণ্ডল হওয়ায় এবং সেখানে হাজার হাজার চাকুরিজীবী একত্রে কর্মরত থাকার সুবাদে খুব সহজেই সংগঠিত হয়ে মিছিল-মিটিং, আন্দোলন করার ফুরসত পাচ্ছেন।

Advertisement

তাইতো প্রায়শই: সেখানে চলছে আন্দোলন, কর্মবিরতি, হাতাহাতি। একদিন পূর্বে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের আহ্বায়ককে পদত্যাগ করার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন করার দৃশ্য অনেকেই গণমাধ্যমে দেখে হতাশ হয়েছেন।

এভাবে একসঙ্গে অনেকগুলো ঘটনা-দুর্ঘটনা সচিবালয়কে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে। তার সাথে যুক্ত হয়েছে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন এজেন্টের ঘৃণ্য ও ঘোলাটে ইস্যুর তৎপরতা। যেগুলোকে এর সাথে মিলিয়ে দেখলেও অত্যুক্তি হবে না। এই মুহূর্তে সেগুলোকে খাটো করে দেখার কোন উপায় নেই। কিন্তু গভীর রাতে একটি সুরক্ষিত সরকারী অফিসের বিভিন্ন ফ্লোরে খণ্ড খণ্ড জায়গায় আগুনের সূত্রপাত হবার প্রাথমিক আলামত লক্ষ্য করা গেছে কেন? সেজন্য আগুন নেভাতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। এই ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত কীভাবে হলো তা সুষ্ঠু তদন্ত করে বের করা প্রয়োজন।

এছাড়া সচিবালয়ের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সতর্কতা কই? বিপদের সময় মেইন গেট খুলে অগ্নিনির্বাপক দল যদি ঢুকুতে এত দেরি করেন তাহলে অফিস চলাকালীন সময়ে এরকম কোন দুর্ঘটনায় প্রাণহানির আশঙ্কা থেকেই যায়। অফিস ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল তথ্য বা ই-ফাইলের প্রতি দায়িত্ববান অফিসার, কর্মচারীকে নিজেদের তত্ত্বাবধানে বিকল্পভাবে সংরকক্ষণ করে রাখতে হবে সকল মন্ত্রণালয়কে। তাহলে গোপনীয় তথ্য হারানোর ঝুঁকি এড়ানো যেতে পারে।

মনে রাখতে হবে পোষা সাপেরও বিষদাঁত থাকে। সেটা একবার ভেঙ্গে ফেলে দিলেও কিছুদিন পর পর আবার গজায়। একটু নয়ছয় হলে তারা সেই মালিকের প্রাণসংহার করতে দ্বিধা করে না। তাই ঘৃণ্য দোসরদেরকে বাধ্যতামূলক অবসর না দেয়া পর্যন্ত সবসময় হুমকিতেই থাকতে হবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে।

বিপ্লব ও শত্রুর প্রতি সহানুভূতি একসঙ্গে চলতে পারে না। তাহলে সেটা কোন বিপ্লব নয়। ইতিহাসের শিক্ষা তাই বলে। আরেকটি বিষয় হলো সমমনাদের সাথে সমঝোতায় না গিয়ে একা একা চলতে গিয়ে অনেক জনপ্রিয় অভ্যুত্থানকারীরা অল্পসময়ে পরিণাম খুঁইয়ে ইতিহাসের তলানীতে চলে গিয়েছেন। সেসব কথা গভীরভাবে অধ্যয়ন করে সামনের পথ চলার গতি বাড়াতে হবে।

গণতন্ত্র আপাতত: সেই শিক্ষাই দেয়। এভাবে সবাই মিলে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎকে জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করা হোক আপাতত: সেই প্রত্যাশা। একই সঙ্গে সচিবালয়ের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে উপযুক্ত শাস্তির আওতায় আনা উচিত।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিন। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/এমএস