মতামত

নতুন যা তা নতুনই হওয়া উচিত

হাসিনা সরকার বিদায় নেয়ার সাথে দেশে আওয়ামী- বলয় যেমন ভেঙে পড়েছে, তেমনি অন্যান্য শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। শূন্যস্থান পূরণ করবার জন্য দ্বন্দ্ব, মারামারি, হানাহানি শুরু হয়েছে মসজিদ-ইজতেমা ময়দান থেকে শুরু করে সচিবালয়, হাসপাতাল, বাজার, জলমহাল, খেলার মাঠ, পতিত জমিসহ আরো অনেক জায়গায়। কোনো নিয়ম-কানুনের ধার না ধরেই ‘জোর যা মুল্লুক তার’ এই পথেই চলছে সবাই। এই দখল কায়েম করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যেও হচ্ছে হাতাহাতি, খুনোখুনি। এতদিন যে খেলা আওয়ামী লীগ খেলেছে, আজ সুযোগ পেয়ে সেই খেলা অন্য দলগুলো খেলতে শুরু করেছে।

Advertisement

জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের পর অনেকেই ভেবেছিলেন দেশে এমন একটা পরিবর্তন আসবে, যার ফলে সেই কাড়াকাড়ির কালচার আর দেখতে হবে না। দখল নিতে একদল আরেক দলকে আক্রমণ করবে না, মানুষ অন্যায়ভাবে নিহত-আহত হবে না, রক্তপাত, অরাজকতা, সন্ত্রাস, সহিংসতা ও ডাকাতির ঘটনা হ্রাস পাবে। জনগণ আরো ধারণা করেছিল রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের সংশোধন করার চেষ্টা করবে। তারা জনসেবা করবে, আত্মসেবা নয়। অথচ আমাদের দেশে রাজনৈতিক পরিণতি সেই আত্মসেবা ও দখল বাণিজ্যের দিকেই এগুচ্ছে বলেই মনে হচ্ছে। যদিও ভবিষ্যৎ দেখার জন্য আরো অপেক্ষা করতে হবে, চার মাস তেমন কোনো লম্বা সময় নয়।

তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যে সরকারই আসুক না কেন, তাদের কাছে যদি সেই ক্ষমতার রাজনীতি ও দখল বাণিজ্যই মুখ্য হয়ে ওঠে, তাহলে পরিস্থিতি বদলাবে না। বিগত সরকারের রীতিনীতির সাথে তেমন কোনো পরিবর্তন হবে না, শুধু ক্ষমতায় থাকা মানুষগুলোর পরিবর্তন হবে। দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি সেই একই থাকবে। এখনো কোনো রাজনৈতিক দল নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় বসেনি। অথচ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় দেশের বিভিন্ন খাত যেমন ব্যাংক, বীমা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, হাসপাতাল, প্রশাসন সব চলে যাচ্ছে দখলবাজদের হাতে।

জনগণ এই পট পরিবর্তনের পর যেমন দ্রুত নির্বাচন চাইছেন, সেই সাথে চাইছেন রাজনৈতিক সংস্কার ও প্রকৃত অপরাধীদের বিচার। বাংলাদেশ দ্রুত এমন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করবে, যেখানে থাকবে না দখলবাজ, চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজ শক্তি। সংস্কার হতে হবে এমন, যাতে আর কেউ স্বৈরাচার না হতে পারে। নতুন যা, তা নতুনই হওয়া উচিৎ। এত প্রাণের বিনিময়ে নতুন রূপে পুরোনো ব্যবস্থা মানুষ চাইছে না।

Advertisement

রাজনীতি যখন বাণিজ্যে পরিণত হয়, সমাজে তখন দখলের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়, তখন সেটাকে দখল বাণিজ্য বলে। ৫ আগস্টের পর থেকে দেখছি রাজনৈতিক পরিচয় খাটিয়ে সেই দখল বাণিজ্য শুরু হয়ে গেছে। কোথাও কেউ প্রতিরোধ করছে না, সরকার কোনো কথাও বলছে না, সুশীল সমাজ মুখে কুলুপ এঁটেছেন। যে ছাত্ররা বিপ্লবের নেতৃত্বে ছিলেন এবং এখন পদ লাভ করেছেন, তারাও এই বিষয়ে কোনো রা করছেন না। এর মানে কি এটাই যে ‘যে লংকায় যায় সেই রাবণ হয়’ এই প্রবণতা রোধ করার মতো কোনো পদ্ধতি দেশে আজও গড়ে ওঠেনি।

আওয়ামী সরকারের সময়ে দেশের সম্পদ পাচার করেছে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী। প্রশাসন, পুলিশ সব ছিল তাদের হাতে এবং সেটাকে ব্যবহার করে পুকুর চুরি করেছেন অনেকেই। যারা দুর্নীতি করে ধরা পড়েছেন, তারা এর কর্মফল ভোগ করছেন। অথৈ জৌলুসের ভেতরে বসবাস করে এখন যে জীবন তারা কাটাচ্ছেন, তা ভয়াবহ। সর্বোপরি আছে লোকলজ্জা, অসম্মান। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি আরো কঠিন হবে।

তবে বাংলাদেশের একটি শ্রেণি যে আদতেই লুটেরা, জুলাই বিপ্লবের পর তা আবারও প্রমাণিত হলো। বিপ্লব সফল হওয়ার পর যখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হলো, তখনই বিভিন্ন স্থাপনা লুট হতে দেখেছি আমরা। গণভবনের পানির বোতল, হাস-মুরগি, পুকুরের মাছ থেকে শুরু করে চেয়ার-টেবিল, বালতিসহ বিভিন্ন ব্যক্তিগত সামগ্রী কিছুই বাদ যায়নি লুটতরাজের হাত থেকে। যেহেতু বিজয়ী জনতা সেদিন নির্বিবাদে এগুলো লুট করতে পেরেছে, তাই এরপর থেকে শুরু হলো বিভিন্ন দোকানপাট, হাট-বাজার, কারখানা, গোডাউন লুট করার উৎসব। এমনকি মাজার, মন্দিরের সম্পদও এর হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। শুধু লুটতরাজ নয়, হামলা-মামলা, দখল সব চলতে থাকলো এবং এখনো চলছে।

রাজনীতি যখন অনৈতিক বাণিজ্যে পরিণত হয়, তখন দেশ ও জাতিকে এর দায়ভার বহন করতে হয়। জুলাই বিপ্লবের পর মানুষ ভেবেছিল এখন এমন শক্তিকে আমরা পাবো যারা রাজনীতিকে ভিন্নখাতে নিয়ে যাবে। মানুষ বিকল্প কিছু আশা করেছিল। আওয়ামী লীগের সাম্রাজ্য অন্যকোনো রাজনৈতিক দল দখলে নিয়ে আবার সেই একই শক্তি প্রদর্শন করবে, এটা দেখতে চাইছে না কেউ। কিন্তু সর্বত্রই সেরকমই ঘটতে শুরু করেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে রিপোর্ট আসছে যে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলের নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন, অন্যদিকে তাদের দখলে থাকা বাজার, মাছঘাট, বালুমহালসহ অন্যান্য স্থাপনা একে একে দখলে নিচ্ছেন অন্য দলের নেতা-কর্মীরা।

Advertisement

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে ‘মৃদুস্বরে’ দখল, নৈরাজ্য, লুটপাট থেকে বিরত থাকতে ‘কঠোর’ নির্দেশনা দিলেও কাজে আসছে না। উল্টো দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের লোকজনের বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর চালানোর পাশাপাশি অনেক সাধারণ মানুষের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও হামলার ঘটনা ঘটছে। এমনও সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে মেঘনার মধ্যে শত শত একর আয়তনের চরে উন্মুক্তভাবে চড়ে বেড়ানো কৃষকের গরু, মহিষসহ গবাদিপশু ট্রলারে করে ছিনতাই হয়ে গেছে।

সরকার পতনের পর শিক্ষা, চিকিৎসা ও পরিবহন অঙ্গনসহ সর্বত্র শুরু হয়েছিল অরাজকতা। ‘আওয়ামী লীগ সমর্থক’ বলে বিবেচিত অনেক চিকিৎসক, শিক্ষক-কর্মকর্তা এখনও কর্মস্থলে অনুপস্থিত, এতে ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষাদান কর্মসূচি ও চিকিৎসা সেবা। আর প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন শিক্ষক ও কর্মকর্তার পদত্যাগ দাবিতে চলছে বিক্ষোভ-সমাবেশ। এমনকি দেশের পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রণও পাল্টে গেছে। মুহূর্তেই দখল হয়ে গেছে বেশিরভাগ টার্মিনাল আর রুট, এবং নৌঘাট। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চলছে তালা বন্ধ করার প্রক্রিয়া ও ভাঙচুর এবং আগুন দিয়ে পুড়িয়েও দেয়া হচ্ছে।

অনেকে বলতে পারেন যে, ফ্যাসিস্ট সরকারের সাথে যাদের ন্যূনতম সম্পর্ক ছিল তাদের উপর চড়াও হলে, অসুবিধা কোথায়? অসুবিধা আছে, কারণ এই চর্চা শুরু হলে থামানো কষ্টকর হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে স্বপরিবারে হত্যা করার পর এবং এরশাদ সরকারের পতনের পরও বড়ধরনের রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল কিন্তু আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এভাবে ভেঙে পড়েনি, আর এভাবে দখলের রাজনীতিও তখন দেখিনি।

বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, অধিদফতর, ব্যাংক-বীমাতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও মহাপরিচালককে দুর্নীতিবাজ, অযোগ্য ও ফ্যাসিস্টের দোসর আখ্যা দিয়ে সরানো হচ্ছে, আবার সেই পদেই নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তাদের, যারা ১৪/১৫ বছর আগে যারা বিভিন্ন কারণে চাকুরিচ্যুত হয়েছিলেন। এমনকি দুর্নীতির দায়ে চাকরি হারানো ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ফিরে আসছেন, কোন নিয়মকানুন না মেনে। এককথায় বলা যায় বিগত সরকার পতনের পর চাকুরি অঙ্গনেও চলছে অস্থিরতা। বর্তমানে যারা নিজেদের ক্ষমতাশালী মনে করছেন, তারা বলছেন যে যারা গত ১৫ বছর নানা ধরনের ‘অরাজকতা’ করেছেন, তারাই ভয়ে চাকুরি ও পদ থেকে সরে যাচ্ছেন নিজ ইচ্ছায়। আসলেই কি তাই ঘটছে?

তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ থেকে শুরু করে শহরের আড্ডায়, অফিস-রেস্টুরেন্টে চা পানরত ব্যক্তিবর্গ এবং ঘরের চৌহদ্দিতে আলোচনার একটি বড় ইস্যু হচ্ছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসার পর সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ চলে এসেছে অন্যান্য পলিটিক্যাল দলগুলোর অনুসারীদের হাতে।

এদিকে শোনা গিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি থাকবে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে। কিন্তু এখন শুনতে পারছি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কাজ নিয়ে পুরোদমে এগিয়ে যাচ্ছে। তাদের সাথে আছেন বিপ্লবী, সুশীল সমাজ এবং রাজনীতিবিদ। কথা হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছত্রছায়ায় একটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলে দলটি যেমন বিতর্কিত হবে, তেমনি সরকারও কি নিরপেক্ষতা হারাবে না? এর ফলে এই সরকারের অধীনে নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ওঠাটাই স্বাভাবিক। কারণ মানুষ মনে করে কিংস পার্টিকে সরকার আনুকূল্য ও সহায়তা দিলে সেই সরকার নিরপেক্ষতা বা গ্রহণযোগ্যতা হারাবে।

জনগণ এই পট পরিবর্তনের পর যেমন দ্রুত নির্বাচন চাইছেন, সেই সাথে চাইছেন রাজনৈতিক সংস্কার ও প্রকৃত অপরাধীদের বিচার। বাংলাদেশ দ্রুত এমন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করবে, যেখানে থাকবে না দখলবাজ, চাঁদাবাজ, অস্ত্রবাজ শক্তি। সংস্কার হতে হবে এমন, যাতে আর কেউ স্বৈরাচার না হতে পারে। নতুন যা, তা নতুনই হওয়া উচিৎ। এত প্রাণের বিনিময়ে নতুন রূপে পুরোনো ব্যবস্থা মানুষ চাইছে না।

২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪

লেখক : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলাম লেখক।

এইচআর/এএসএম