জাতীয়

বাতিল হচ্ছে ‘রাজনৈতিক বিবেচনায়’ পাওয়া ট্রেনের লিজ

যাত্রীসেবার মান বাড়াতে বাণিজ্যিক কার্যক্রমের আওতায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় কিছু ট্রেন লিজ দিয়েছিল রেলপথ মন্ত্রণালয়। তবে লিজ পাওয়ার পর কিছু প্রতিষ্ঠান চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে বছরের পর বছর ইচ্ছেমতো সেসব ট্রেন পরিচালনা করে আসছিল। যেখানে অনিয়মই হয়ে উঠেছিল নিয়ম। এতে যাত্রীসেবার মান যেমন কমছিল, পাশাপাশি ছাদে যাত্রী পরিবহন ও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়সহ সামনে আসছিল নানা অভিযোগ। এবার রাজনৈতিক বিবেচনায় বরাদ্দ পাওয়া বেসরকারি সব ট্রেনের চুক্তিপত্র বাতিল করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে৷

Advertisement

চুক্তির শর্ত লঙ্ঘনের অভিযোগে বেসরকারিভাবে পরিচালিত ২৪টি ট্রেনের লিজ বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। লিজ নেওয়া ইজারাদারদের বিষয়টি জানাতে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মো. নাজমুল হুদার গত ৩ নভেম্বর সই করা একটি চিঠি রেলওয়ের মহাপরিচালককে পাঠানো হয়৷

বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ২৪টি ট্রেনের লিজ আগামী ৩১ ডিসেম্বর বাতিল হবে। অবিলম্বে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ট্রেনগুলো লিজ দেওয়ার কার্যক্রম শুরু করতে হবে।- রেলপথ মন্ত্রণালয়

ওই চিঠিতে বলা হয়, বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ট্রেনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনায় বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায় এপ্রিল ২০১৯ সালে নতুন করে আর কোনো ট্রেনের বাণিজ্যিক কার্যক্রম বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়৷ চুক্তি অনুসারে শর্ত পরিপালনে ব্যর্থতায় যেমন ছাদে যাত্রী বহন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ইত্যাদি ক্ষেত্রে চুক্তিপত্র বাতিলের সংস্থান রয়েছে৷

Advertisement

আরও পড়ুন

লিজ দেওয়া ট্রেনের আয়ের হিসাব দিলেও নেই ব্যয়ের হিসাব টিকিট ছাড়া টাকা আদায়, ট্রেনের ৩ কর্মকর্তা-কর্মচারী বরখাস্ত অর্ধকোটি টাকার মালামাল আত্মসাৎ, রেলের ২ কর্মকর্তার নামে মামলা

মন্ত্রণালয়ের পাঠানো ওই চিঠিতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ২৪টি ট্রেনের লিজ আগামী ৩১ ডিসেম্বর বাতিল হবে বলে জানানো হয়। অবিলম্বে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে ট্রেনগুলো লিজ দেওয়ার কার্যক্রম নিতেও বলা হয়৷

বিভিন্ন জটিলতার কারণে ২০১৯ সালে বেসরকারিভাবে ট্রেন পরিচালনার সিদ্ধান্ত বাতিল হয়েছে- উল্লেখ করা হয় চিঠিতে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, আগে বেসরকারিভাবে যেসব ট্রেন পরিচালিত হতো সবগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় দেওয়া হতো৷ লিজ নেওয়া এসব ঠিকাদার মন্ত্রীদের ঘনিষ্ঠ হওয়ায় কেউ কিছু বলার সাহস পেতো না৷ এজন্য ট্রেন পরিচালনায় অনিয়মই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷

Advertisement

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ওই সিদ্ধান্তের পরই বাংলাদেশ রেলওয়ের উপ-পরিচালক (টিসি) মো. আনসার আলীর সই করা একটি চিঠি রেলের পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপককে পাঠানো হয়৷ সারাদেশে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত ২৪টি ট্রেনের লিজ গ্রহীতাকে আগামী ৩১ ডিসেম্বর লিজ বাতিল করা হবে মর্মে নোটিশ দেওয়াসহ উন্মুক্ত দরপত্র পদ্ধতিতে ট্রেনগুলো লিজ প্রদানের পরবর্তী প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নিতে বলা হয়৷

মন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে টেন্ডার করার জন্য একটি সিদ্ধান্ত দিয়েছে৷ আমরা সেই সিদ্ধান্ত জিএম পূর্ব এবং পশ্চিমকে দিয়েছি৷ তারা পরবর্তী কার্যক্রমের দিকে এগোবেন।- রেলওয়ে ডিজি

বাংলাদেশ রেলওয়ে জনবল সংকটের কারণে ১৯৯৭ সাল থেকে বেসরকারি খাতের সঙ্গে কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে সারাদেশে ৩৭টি ট্রেন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে৷ ২০২২ সালে রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি বেসরকারি খাতে রেল পরিচালনার সব চুক্তি বাদ দেওয়ার সুপারিশ করে। কিন্তু সে সিদ্ধান্তও রাজনৈতিক বিবেচনায় আটকে যায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার শাহাদাত আলী জাগো নিউজকে বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে টেন্ডার আহ্বানের সিদ্ধান্ত হয়েছে৷ আমরা সেই সিদ্ধান্ত জিএম পূর্ব এবং পশ্চিমকে দিয়েছি৷ তারা পরবর্তী কার্যক্রমের দিকে এগোবেন।

আরও পড়ুন

রেলওয়েতে দুর্নীতির ১০ খাত শনাক্ত করেছে দুদক রেলপথ নির্মাণে বাঁকে বাঁকে অনিয়ম

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব নাজমুল হুদা জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালাতে গেলে লোকবল লাগবে৷ সেই সেটআপ আছে কি না...। মূলত অথরিটি এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে৷

রেলওয়ে না পারে নিজেরা সার্ভিস দিতে, না পারে অন্যদের থেকে সার্ভিস আদায় করতে৷ কোনো সংস্থা যদি সত্যিকার অর্থে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে জনগণকে সেবা দেবে, লোকবল কম থাকলেও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ করে।- ড. এম শামসুল

তবে রেলওয়ে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করছে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক।

তিনি জাগো নিউজকে বলেন, রেলওয়ে না পারে নিজেরা সার্ভিস দিতে, না পারে অন্যদের থেকে সার্ভিস আদায় করতে৷ কোনো সংস্থা যদি সত্যিকার অর্থে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে জনগণকে সেবা দেবে, নিজেদের লোকবল কম থাকলেও আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ করে, যেন চুক্তির বাইরে কিছু করলে তাকে বাদ দেওয়া যায়৷

‘এই কাজটি রেলওয়ে পেশাদারত্বের সঙ্গে করতে পারে না বলেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যে শর্তে এসে সেবা দিতে চায় সেই উদ্দেশ্য থেকে সরে আসে’- বলেন এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ৷

এনএস/এমকেআর/এমএস