মতামত

রোহিঙ্গা সংকট ও সমাধানসূত্র

মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হাতে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পাড়ি দেয়া প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়ার সাত বছর পার হয়ে গেলেও সংকট সমাধানের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। রোহিঙ্গাদের নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ দিন দিন ফিকে হয়ে আসছে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বাণিজ্যিক স্বার্থের কাছে ঘুরপাক খাচ্ছে রোহিঙ্গা সংকট। অথচ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাইলে এই সমস্যার সমাধান আরো অনেক আগেই হয়ে যেতো।

Advertisement

মিয়ানমারের প্রতিবেশী দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারত ও চীন তাদের নিজ নিজ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাপানের মিয়ানমারে বিনিয়োগ থাকায় তাদের ভূমিকাও অস্পষ্ট। জাতিসংঘ, বিভিন্ন দাতা সংস্থা, প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো এ সমস্যার ব্যাপারে অবহিত হলেও সমাধানের ব্যাপারে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবসনই একমাত্র সমাধান হলেও নানা জটিলতায় আটকে আছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বহুমুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জরুরি। মিয়ানমার ও রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ বন্ধে এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে প্রভাবশালী দেশগুলোকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

সম্প্রতি বাংলাদেশে সফর করা মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত রোহিঙ্গা সংকটকে একটি তাজা টাইম বোমা আখ্যায়িত করে এটি যেকোনো সময় বিস্ফোরিত হতে পারে বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, এ সমস্যার সমাধান বাংলাদেশের হাতে নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের হাতে। আমরা অনির্দিষ্টকালের জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। এটি এমন এক বিষয় যা আমাদের যত দ্রুত সম্ভব সমাধান করতে হবে।

Advertisement

ড. ইউনূস বলেন, এটি বাংলাদেশের একার সমস্যা নয়, মালয়েশিয়ারও সমস্যা। আমাদের এই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে এবং আমরা আসিয়ান, মালয়েশিয়ার সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে একসঙ্গে কাজ করব।

এর আগে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি আলোচনা সভায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তখন তিনি বলেন, আমাদের সতর্ক হতে হবে, এই সংকটের সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চল সমস্যায় পড়বে।

রাখাইনে চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের যেখানে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে; রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য সেখানে অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। আমরা আশা করতে পারি জাতিসংঘ, প্রভাবশালী ও দাতা দেশ, মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানকারী সংস্থা, রোহিঙ্গাদের স্বার্থ ও অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো এ সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা রেখে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করবে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন করে ভাবার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, প্রথমত আমরা চাই জাতিসংঘ মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সব পক্ষের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করুন। সম্মেলনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আন্তরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসার কথা বলেন তিনি।

Advertisement

সম্মেলনে আইওএমের মহাপরিচালক অ্যামি পোপ বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এই সংকট সমাধানে আমাদের আরও কাজ করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি সমাধান প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উচ্চপর্যায়ের এই আলোচনায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য প্রায় ১৯ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের নতুন সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।

দীর্ঘ সাত বছর ধরে চলমান রোহিঙ্গা সংকট নানা দিক দিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। প্রত্যাবাসন বিলম্ব হওয়ায় দিন দিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ ভয়ংকর অপরাধেও তাদের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গিয়ে দেশের শ্রমবাজারের ক্ষতি করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। জঙ্গিবাদের সঙ্গেও তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ফলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে। যা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় এই পুরো অঞ্চলের জন্যও নিরাপত্তা হুমকি।

বিশ্বজুড়ে চলমান অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে এই সমস্যা যেন গুরুত্ব হারিয়ে না ফেলে সেদিকে আমাদের সবপক্ষকে সজাগ থাকতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে এবং প্রত্যাবাসন সহজতর করতে বড় দেশগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মিয়ানমারের সঙ্গে বরাবরই চীনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।

অতীতে জাতিসংঘে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে যেসব প্রস্তাব আনা হয়েছিল, তাতে বরাবর ভেটো দিয়েছে চীন। কারণ চীন চায় মিয়ানমারে যেন তাদের বন্ধুভাবাপন্ন একটি সরকার ক্ষমতায় থাকে। মিয়ানমারে চীনের ব্যাপক অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক স্বার্থও রয়েছে। মিয়ানমারের আরাকান এলাকায়ও চীনের স্বার্থ রয়েছে। এই সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের উচিত মিয়ানমারের ওপর তার চাপ বৃদ্ধি করা।

এই সমম্যার টেকসই সমাধান খুঁজতে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারতের আরো সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত। প্রত্যাবাসনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে আসিয়ান এবং জাতিসংঘসহ আঞ্চলিক অংশীদারদের সঙ্গে সংলাপ এবং সহযোগিতাকে অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। ভারত তার কূটনৈতিক প্রভাব ব্যবহার করে মিয়ানমারকে সংকটের মূল কারণগুলো মোকাবিলা করতে এবং রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে উৎসাহিত করতে পারে। এর ফলে এই পুরো অঞ্চলে শান্তি ফিরে আসবে।

একদিকে, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরে চীনবিরোধী জোটের শক্তির মহড়া, অন্যদিকে রাখাইনে পরিবর্তিত ভূকৌশলগত গুরুত্ব প্রভৃতি কারণে রোহিঙ্গারা এখন আন্তর্জাতিক ও মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ জান্তাবিরোধীদের রাজনীতির ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধ, রাখাইনে নতুন করে সংঘাত এবং বিদ্যমান রোহিঙ্গা সংকট মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য পুরো পরিস্থিতি জটিল করে তুলেছে।

একই সঙ্গে মিয়ানমারের রাখাইনকে ঘিরে ভূ-রাজনীতি এবং পরাশক্তিগুলোর স্বার্থের দ্বন্দ্ব থাকায় মিয়ানমারের সঙ্গে সংকট সমাধান বাংলাদেশের জন্য বড় কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ হিসেবেও সামনে এসেছে। রাখাইনে চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের যেখানে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে; রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য সেখানে অনেকটা অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। আমরা আশা করতে পারি জাতিসংঘ, প্রভাবশালী ও দাতা দেশ, মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানকারী সংস্থা, রোহিঙ্গাদের স্বার্থ ও অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো এ সমস্যা সমাধানে সক্রিয় ভূমিকা রেখে প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত করবে।

লেখক: সাংবাদিক।

এইচআর/জিকেএস