মতামত

গণতন্ত্রের অভিযাত্রায় সেনা আবশ্যকতার নতুন দৃষ্টান্ত

আন্দোলনের ভ্যানগার্ডরা মাঠে তৎপর। যেখানে যেভাবে পারছে ভূমিকা রাখছে। রয়েছে রাজপথের প্রধান দল বিএনপিসহ অন্যরাও। কিন্তু, গত দিন কয়েক ধরে সরকারকে বিরক্ত করা, পেয়ে বসা বা কাজে অসহযোগিতা করার মহলবিশেষের ক্রিয়াকর্মের আলামত স্পষ্ট। এর ফের বা রহস্য দুর্বোধ্য নয়। রাজনীতি না করা মানুষেরও তা বোধগম্য। ৫ আগস্টের পর দুই মাস না যেতেই বিপ্লবের সুফল বানচালের চেষ্টা বেশ জোরদার। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে কিছু বিবৃতি ও বক্তৃতা দেয়া শুরু হয়ে গেছে। এরর মাঝে বিপ্লবের বিরুদ্ধে কয়েকটি ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করতে হয়েছে ছাত্রদের। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রয়াত প্রেসিডেন্ট, ফ্র্যাঙ্কলিন রুজভেল্টের একটি কথা এখানে বড় প্রাসঙ্গিক। তিনি বলেছিলেন: ’বিজয়ীরা সমাধান খুঁজে পায়, পরাজিতরা ত্রুটির অজুহাত দেখায়’।

Advertisement

সেই নমুনার নতুন সংস্কারণ ঘটেছে বাংলাদেশে। বিরোধী দলগুলো বছরকে বছর আন্দোলন বারবার ব্যর্থ হওয়ায় ফ্যাসিস্ট ক্রমান্বয়ে শক্তিশালী হয়েছে। সেখানে ৩৪-৩৫ দিনে এই ছাত্রদের এই পরিকল্পিত নিরস্ত্র বিপ্লব ব্যতীত ফ্যাসিস্টকে উৎক্ষাতের আর কোন উপায় ছিল না। সেটাই তারা করেছে। সফলও হয়েছে। এখন ফ্যাসিস্টের পুনুরুত্থান রোধের পুরো দায়িত্ব ছাত্রদের নয়।

অন্তর্বর্তী সরকারের একার পক্ষেও তা সম্ভব নয় । অন্তর্বর্তী সরকারের এগিয়ে চলায় সেনাবাহিনীর একাত্মতা-সহায়তা এখন আরো বেশি। ৫ আগস্ট বিপ্লবের এই সারথীরা বন্যার্তদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতায় ফ্রন্টলাইনে নেমে গেছে। কোনো কোনো দুর্গত এলাকায় নৌ-বিমানবাহিনী সদস্যদের কর্মতৎপরতা্ও ছিল চোখে পড়ার মতো। নেমেছে বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড-বিজিবিও। পুলিশ সেভাবে রেনি। কারণ পুলিশ এখনো কাফফারা আদায়ের পর্যায়ে। মানুষ তাদের গ্রহণ করছে না।

বিপ্লবের পর রাজধানী ঢাকায় নিজ কার্যালয়ে বসে রয়টার্সকে একটি সাক্ষাৎকার দেন সেনাপ্রধান, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেখানে বলেন, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এ ছাড়া সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করার একটি রূপরেখাও দেয়া হয়েছে। ড. ইউনূস প্রসঙ্গে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আমি তাঁর পাশে থাকব। যাতে তিনি তাঁর মিশন সম্পন্ন করতে পারেন।’

Advertisement

ক্ষমতাকালে সদম্ভে অনেক কিছু করা যায়। তা মাত্রাগতভাবে বেশি করলে কখনো কখনো চরম পরিণতিও ভুগতে হয়। দিতে হয় কঠিন মাশুল। পরিবার-পরিজনকেও বাকি জীবন মাশুল গুনতে হয়। সেই আতঙ্কে বাহিনীপ্রধানসহ পুলিশের মহাপরাক্রমশালী কর্মকর্তাদের হাল অবস্থা গণমাধ্যমের কল্যাণে সাধারণ মানুষেরও জানা। দেয়াল টপকে, লুঙ্গি ড্যান্সে, হেলিকপ্টারে বা রিকশায় সাধারণ মানুষ সেজে পালানোর কিছু ঘটনাও প্রকাশ হয়েছে। একমাত্র ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে শেখ হাসিনার ভারতে চম্পট দেওয়ার পর পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত আইজিপি কামরুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম, আতিকুল ইসলাম, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদসহ বাঘা বাঘা পুলিশ কর্মকর্তার গুরুচরণ দশা এবং প্রাণভয়ে পালানোর কথা আর গোপন নেই। বর্ডার গার্ড বিজিবি এর কিছু আগে থেকেই নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। সেনাবাহিনী ‘নো ফায়ার’ ঘোষণা দিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যায় আরও ঢের আগেই। পুলিশ-র্যাবের বিশেষ কয়েক কর্মকর্তার হম্বিতম্বি চলতে থাকে তখনো। অথচ ৩ আগস্ট সেনাপ্রধানের সঙ্গে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈঠকে ‘জনগণের ওপর গুলি নয়’—বার্তাটি গোপন থাকেনি।

সরকারের পতনের পর সেনাবাহিনীর কপালে লাগানো কয়েক দিনের কালিমা দূর হতে সময় লাগেনি। দিন শেষে জনগণ সেনাবাহিনীকে ‘দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী’ নামেই বরণ করে নেয়। পুলিশ-র্যাব-বিজিবি সেই সুযোগ পায়নি। জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক যে কোনো তদন্তেই তা ঝরঝরে হয়ে আসবে। সেই তদন্তের আগেই পুলিশের ভোগান্তি শুরু হয়েছে। সেনা সহায়তায় জনতার সঙ্গে মিলেমিশে চলার ওয়াদা দিয়ে থানায় থানায় ফিরলেও আতঙ্কে পুলিশ সদস্যরা। ক্ষতবিক্ষত, দুমড়ে-মুচড়ে যাওয়া পুলিশকে কাজে ফেরানো দস্তুরমতো একটি উদ্ধার প্রক্রিয়া। এর মাঝে আবার ধর্মঘটী পুলিশ সদস্যদেরও নিবৃত্ত করতে হয়েছে।

ছাত্র-জনতার রোষের মুখে পুলিশের অধিকাংশ সুবিধাবাদী ও সরকার বা আওয়ামীঘেঁষা কর্মকর্তারা আত্মগোপনে চলে যান। ডিএমপির সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার আক্রান্ত হওয়ার পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জুনিয়র সদস্যদের ফেলে পালিয়ে যান। সেদিন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিস্থিতি বুঝেও শক্তি প্রয়োগে মনোযোগী ছিলেন। পরে আর ডানে-বামে না তাকিয়ে নিজেরা যে যেভাবে পেরেছেন পালিয়েছেন। সহকর্মী বা সাধারণ পুলিশ সদস্যদের কী হবে, তা ভাবার ফুরসতও পাননি। এখন প্রায়শ্চিত্তে ভুগছেন। কাফফারা দিচ্ছেন। জীবনে আর দলীয় লাঠিয়াল হবেন না বলে অঙ্গীকার করেও বিশ্বাস আদায় করতে পারছে না পুলিশ সদস্যরা।

এর একদম বিপরীত ভূমিকা ও অবস্থা সেনাবাহিনীর। সাবেক সেনা কর্মকর্তারাও শরীক হয়েছেন এ অভিযাত্রায়। কেবল বিবৃতি বা সেনিার-সিম্পোজিয়াম বক্তৃতা নয়, সাবেক সেনা কর্মকর্তারা মিছিলও করেছেন। মিছিলে সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তাদের পরিবারের সদস্য ও সাধারণ নাগরিকরাও অংশ নিয়েছেন। রাজনীতিতে বিজয় ধরে রাখা আরেকটি বৈপ্লবিক কাজ। সেখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা বেশ খোলাসা। এতে কোনো রাখঢাক নেই।

Advertisement

বিপ্লবের পর রাজধানী ঢাকায় নিজ কার্যালয়ে বসে রয়টার্সকে একটি সাক্ষাৎকার দেন সেনাপ্রধান, জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেখানে বলেন, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাঁর পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। এ ছাড়া সামরিক বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত করার একটি রূপরেখাও দেয়া হয়েছে। ড. ইউনূস প্রসঙ্গে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘আমি তাঁর পাশে থাকব। যাতে তিনি তাঁর মিশন সম্পন্ন করতে পারেন।’

এমন মন্তব্যের পর আর কিছু অস্পষ্ট থাকে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করছেন কয়েকটি প্যারাগ্রাফে। সর্বশেষ রবিবারও বাহিনীটির এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, সেনাবাহিনী দেশকে একটি চরম বিশৃঙ্খলার হাত থেকে উদ্ধার করেছেন। তার মানে সামনে এই ভরসাস্থলটির আরো অনেক কাজ বাকি। বিশেষ করে দেশকে শৃঙ্খলায় আনতে এবং চলমান সংস্কার বাস্তবায়ন কাজেও তাদের ভূমিকা অপরিহার্য। যার জের কেবল অন্তর্বর্তী সরকারের জন্যই সহায়ক নয়, ভবিষ্যৎ গণতন্ত্রেরে অভিযাত্রাকেও করবে নিরাপদ ও মসৃণ।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন।

এইচআর/এএসএম