দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে ও সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। নানান কারণেই আলোচিত তিনি। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে গাজীপুর-৪ (কাপাসিয়া) থেকে প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে একই আসন থেকে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান সোহেল তাজ। তবে ব্যক্তিগত কারণে একই বছর ৩১ মে মন্ত্রিসভা থেকে তিনি পদত্যাগ করেন। ২০১২ সালের ২৩ এপ্রিল সংসদ সদস্য পদ থেকেও পদত্যাগ করেন তিনি। সে সময় তার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা না হলেও একই বছর ৭ জুলাই তিনি আবার পদত্যাগপত্র দিলে সেটি গ্রহণ করা হয়।
Advertisement
রাজনীতির মাঠ ছাড়ার পর নানান কারণেই আলোচিত ছিলেন তরুণ এই রাজনীতিবিদ। পুনরায় তিনি রাজনীতিতে ফিরবেন কি না বারবার ঘুরেফিরে সেই প্রশ্ন আসে জনমনে। তবে রাজনীতিতে না ফিরে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সচেতনতা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে চান তিনি তাজউদ্দীন আহমদের ছেলে। মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগসহ নানান ইস্যুতে জাগো নিউজের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক ইসমাইল হোসাইন রাসেল।
জাগো নিউজ: আপনি এমপি ও প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। ক্ষমতার আসন থেকে নিজেই সরে এসেছেন। সেটির খুব বেশি ব্যাখ্যা আমরা পাইনি। কী কারণে আসলে সরে গিয়েছিলেন?
সোহেল তাজ: এটাতো আমি ভাবতাম আপনারা বুঝবেন। এটা ছিল অনিয়ম, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আমার প্রতিবাদ। একজন পদত্যাগ করার থেকে বড় প্রতিবাদ তো আর হতে পারে না। আমি নীরবে পদত্যাগ করে সরে গিয়েছিলাম, মেসেজ তো ছিল। এখন আপনারা কেন বোঝেননি, সেটা তো জানি না।
Advertisement
জাগো নিউজ: কী এমন অনিয়মের কারণে আপনি সরে গিয়েছিলেন? সেটি যদি একটু বিস্তারিত বলেন?
সোহেল তাজ: মর্নিং শোজ দ্য ডে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আমার দল (আওয়ামী লীগ) একটি নির্বাচনী ইশতেহার দিয়েছিল যেটার নাম ছিল দিন বদলের সনদ। দিন বদলের সনদটা ছিল এক্সাক্টলি আজ ছাত্ররা যেটা নিয়ে আন্দোলন করছে এবং মুক্তিযুদ্ধ করে লাখ লাখ শহীদ রক্ত দিয়েছি, সেই স্পিরিটটাই ছিল দিন বদলের সনদে। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম আমরা বাংলাদেশকে পরিবর্তন করবো একটি নতুন বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলবো। প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিক করবো, ইনস্টিটিউশনগুলো মজবুত করবো। বিচারবিভাগ স্বাধীনভাবে কাজ করবে। প্রশাসনে কোনো রাজনীতি হবে না। পুলিশ উন্মুক্ত একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে কাজ করবে। আমি চেয়েছিলাম রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত একটি রাজনৈতিক কালচার গড়ে তুলবো, যেটায় ভবিষ্যতের চাবিকাঠি হবে। কিন্তু যখন দেখলাম আমরা সেই পথে যাচ্ছি না। কারণ, এটাই আমি বলছি মর্নিং শোজ দ্য ডে, সকালই বলে দেয় দিন কেমন হবে। সেজন্য আমি আর রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করিনি। আমার প্রতিবাদের ভাষা ছিল আমি এখান থেকে সরে যাচ্ছি।
জাগো নিউজ: আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা শেখ সেলিম সরাসরি আপনার ওপর প্রভাব খাটানোর কারণে আপনি পদত্যাগ করেছেন বলে শোনা যায়, সেটি কতটা সঠিক?
আরও পড়ুন নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ফিরতে চাই না: সোহেল তাজ সম্মিলিতভাবে দেশকে নতুন করে গড়ার আহ্বান সোহেল তাজের ভুল-ত্রুটি নিয়ে আত্মোপলব্ধিও করছে না একটা রাজনৈতিক দলসোহেল তাজ: এটা ঠিক না। এটা একেবারেই ঠিক না। এরকম কোনো ঘটনাও ঘটেনি যে আমার ওপর কেউ আক্রমণ করবে। এটা কে বা কারা বলেছে জানি না। আমি সার্বিকভাবে পলিসি এবং যেভাবে কাজ চলছিল সেটার প্রতিবাদে চলে গিয়েছি। এখানে আরও কিছু বিষয় আছে বলে মনে করেছি, আমার যে ক্যাপাবিলিটি সেই অনুযায়ী কাজ করতে পারছিলাম না, স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছিলাম না। কারণ আমি উদ্যোগ নিয়েছিলাম দুর্নীতিমুক্ত করবো, উদ্যোগ নিতে চেয়েছিলাম প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযোগকেন্দ্র থাকবে। চেয়েছিলাম পুলিশকে একটি প্রফেশনাল ডিসিপ্লিন ফোর্স হিসেবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করবো। অনেক পরিকল্পনা ছিল যখন দেখলাম সেগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব না, তাই আমি সরে গেছি।
Advertisement
জাগো নিউজ: আপনি একজন প্রতিমন্ত্রী, তাহলে কেন সম্ভব হচ্ছিল না?
সোহেল তাজ: কারণ, আমি পরবর্তীতে একটা কথা বলেছিলাম, খেলা একই খেলোয়াড় বদলিয়েছে। সিস্টেম চেঞ্জ হয়নি এবং সিস্টেম চেঞ্জ হওয়ার কোনো আলামত সেসময় আমি দেখিনি।
জাগো নিউজ: বিগত সরকারের আমলে সবক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতেন শেখ হাসিনা, আপনি যেহেতু তার পছন্দেই মন্ত্রিসভায় জায়গা পেয়েছেন। আপনার প্রতি আন্তরিকতাও নানান সময় দেখেছি। তিনি কি আপনার এই ইতিবাচক চিন্তায় সমর্থন দেননি?
সোহেল তাজ: অনেক বিষয় আছে, যেটা দেখতে একরকম আবার এটা ওরকম নাও হতে পারে। এতটুকুই বললাম।
জাগো নিউজ: এখন তারুণ্যনির্ভর এক বাংলাদেশ আমরা দেখছি, কেমন বাংলাদেশ আপনি চান?
সোহেল তাজ: আমি এমন বাংলাদেশ চাই যেই বাংলাদেশের জন্য আজ ছাত্রসমাজ জেগে উঠেছে। এই বাংলাদেশ নিয়েই গত ১৫ বছর ধরে আমি কথা বলছি। কারণ আমিও রাজনীতিতে ঢুকেছিলাম এই বাংলাদেশ গড়ার জন্য। এটা কোন বাংলাদেশ? যে বাংলাদেশের জন্য লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছিল যেই বাংলাদেশের জন্য সেই বাংলাদেশ। একটি বাংলাদেশ যেখানে বৈষম্য থাকবে না। একটি বাংলাদেশ যেখানে সবার সমান অধিকার থাকবে। এখানে সবার শিক্ষার অধিকার থাকবে। স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। এখানে গরিব, ধনী কারও ভেতর ভেদাভেদ থাকবে না। সবার গণতান্ত্রিক অধিকার থাকবে। মৌলিক অধিকার নিশ্চিত থাকবে। এমন একটি বাংলাদেশ যেখানে আমরা সবাই ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মিলেমিশে বসবাস করবো, সেটাই কিন্তু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল। এটাই হচ্ছে আমারও বিশ্বাস। আজ যুব সমাজ-ছাত্র সমাজ যেটা করছে এগুলো সেটারাই মিলন। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষেরই এটা আশা আকাঙ্ক্ষা। আমি খুবই আশাবাদী, এখন আশা বুকে ধারণ করে কঠিন কাজ করতে হবে।
আমাদের কিছু কালচার তৈরি হয়েছে যেগুলো একেবারে নষ্ট, একেবারে পচা। আমাদের রাজনীতিক কালচারটা পচে গেছে, ধ্বংস হয়ে গেছে। এই কালচারটা ঠিক করতে হবে, এটা কিন্তু কঠিন কাজ। কারণ, এটা ছড়িয়ে গেছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। মানুষ হিসেবে মানুষকে জাগিয়ে তুলতে হবে যে এই দেশটা সবার। সবার দেশ হলে সবার একটা দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্বগুলো হচ্ছে একজন ভালো নাগরিক হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা।
জাগো নিউজ: বৈষম্য নিরসনের তাগিদেই কিন্তু ছাত্রসমাজ আন্দোলন করেছে। আপনি নিজেও সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন, বৈষম্য কীভাবে নিরসন করা যেতে পারে বলে মনে করেন?
সোহেল তাজ: এটার মূলে হচ্ছে সিস্টেম। এখানে ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউশনগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এটার মূল হচ্ছে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা। তার পেছনে আছে একটি জঘন্য ধরনের ক্যানসার সেটা হচ্ছে দুর্নীতি। আমাদের এগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সিস্টেমটাকে আবার গড়ে তুলতে হবে, মজবুত করতে হবে। সিস্টেমটাকে চলতে দিতে হবে। এই তিন জিনিসকে মোকাবিলা করতে হবে। দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা।
জাগো নিউজ: সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ নানান জায়গায় আপনি রাজনীতিতে ফিরতে পারেন বলে শোনা যায়, এ বিষয়ে মানুষের মধ্যে একটা আগ্রহও আছে। আসলেই কি আপনি রাজনীতিতে ফিরছেন?
সোহেল তাজ: আমার এই মুহূর্তে রাজনীতিতে আসার কোনোই ইচ্ছা নাই। আমি কোনো পরিকল্পনাও করিনি। আমার প্রিয় একটা টপিক স্বাস্থ্য। কারণ একটা মানুষের জীবনে স্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি মূল্যবান। আমি নতুন প্রজন্মের কাছে এটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। নিজেকে একজন ভালো মানুষ, শুধু শারীরিকভাবে না মানসিকসহ সার্বিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। স্বাস্থ্য এটার একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটাও একটা সার্ভিস। আমরা যে যেখানে আছি বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিজেদের অবস্থান থেকে কিছুটা অবদান রাখতে পারি। রাজনীতিই যে করতে হবে অবদান রাখতে, সেটা আমি বিশ্বাস করি না। যে যেখানে আছি, সাংবাদিকরা তাদের পবিত্র দায়িত্বটা সঠিকভাবে পালন করলে তারাও দেশের জন্য কিছু করতে পারবে। যিনি রাষ্ট্রের কাজ করছেন তিনি সঠিকভাবে দুর্নীতি না করে, অনিয়ম না করে তার দায়িত্ব পালন করলে সেও কন্ট্রিবিউট করছে দেশের জন্য। একজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা ঠিকভাবে করে নিজেকে সুশিক্ষিত করে গড়ে তুললে সেও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য অবদান রাখছে। আমরা যে যেখানে আছি বাংলাদেশের জন্য অবদান রাখতে পারি। সেটা আমার ব্যক্তিগত বিশ্বাস।
আইএইচআর/জেএইচ/জিকেএস