চা গাছ ছেঁটে ছেঁটে ২৬ ইঞ্চির বেশি বাড়তে দেয়া হয় না। চা শ্রমিকের জীবনটাও ছেঁটে দেয়া চা গাছের মতোই, লেবার লাইনের ২২২ বর্গফুটের একটা কুঁড়ে ঘরে বন্দি। মধ্যযুগের ভূমিদাসের মতোই চা মালিকের বাগানের সঙ্গে বাধা তার নিয়তি। চা শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম একটি বৃহৎ শিল্প। জাতীয় অর্থনীতিতে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মৌলভীবাজারসহ দেশের প্রায় ১৬৫টি চা বাগানের শ্রমিকরা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। প্রায় ২০০ বছর ধরে মৌলভীবাজারের ৯২টি চা বাগানে বংশ পরম্পরায় কাজ করছেন চা শ্রমিকরা। তাদের শ্রমে এই শিল্পের উন্নয়ন হলেও শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। দৈনিক একজন শ্রমিকের মজুরি ৮৫ টাকা। আর সেই সঙ্গে সপ্তাহ শেষে তিন কেজি খাওয়ার অনুপযোগী আটা। তাও আবার ওজনে কম। মৌলিক চাহিদা পূরণে দীর্ঘদিন ধরে মজুরি বৃদ্ধি, ভূমি অধিকার, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবি তাদের। কিন্তু বাস্তবায়ন না হওয়ায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন চা শ্রমিক পরিবারের সদস্যরা। চা বাগানের শ্রমিকরা তাদের শ্রম দিয়ে চা বাগান আগলে রাখলেও তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসা এখন সেই অবহেলিত রয়ে গেছে। সরকার তাদের আবাস্থল নিজ নিজ মালিকানায় করে দিবে বলেও এখনো এর কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। আর এ জন্য দীর্ঘদিন ধরে ভূমি নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছেন চা শ্রমিকরা। চা শ্রমিকরা জানান, বাগানের হাসপাতালে ভালো চিকিৎসার যথেষ্ঠ অভাব রয়েছে। বাগানে যে কয়েকটা ছোট হাসপাতাল রয়েছে তাতে পর্যাপ্ত পরিমাণে ওষুধ ও ডাক্তার না থাকায় রোগমুক্তি হচ্ছে না। অকালে ঝরে যাচ্ছে অনেক প্রাণ। তাছাড়া বাগানের কিছু কিছু ছেলে-মেয়েরা উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও চাকরির ক্ষেত্রে বড় কোনো পদ পাচ্ছেনা। শ্রীমঙ্গলের ফুলচড়া চা বাগানের মহিলা চা শ্রমিক কুমারি মুন্ডা। সারা বছরই যিনি চা শ্রমিকদের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যদিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, প্রতি বছর চা বাগানের অনেক মানুষ নিয়ে আমরা মে দিবস পালন করি। আমাদের দুঃখ-দুর্দশা সবার কাছে তুলে ধরি। কিন্তু আমাদের এই আন্দোলন কে শুনবে, কি হবে আর মে দিবস পালন করে। শ্রীমঙ্গল কালিঘাট ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও চা শ্রমিক নেতা পরাগ বাঁড়ই বলেন, চা শ্রমিকরা সেই ব্রিটিশ আমল থেকে এ দেশে বাস করছে। তারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযোদ্ধে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। সেই চা শ্রমিকরা আজও অবহেলিত। বর্তমান শ্রমিক বান্ধব সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে শ্রমিকদের পক্ষ থেকে দাবি জানাচ্ছি- এই অবহেলিত চা শ্রমিকদের বাসস্থানের জায়গাটুকু যাতে তাদের নিজের নামে করে দেয়া হয়। যাতে বাগান কর্তৃপক্ষ তাদের যখন তখন ভূমি থেকে উচ্ছেদ করতে না পারে।সকালে লবণ দিয়ে এক মগ চা আর সঙ্গে দুমুঠো চাল ভাজা খেয়ে বাগানে যেতে হয়, তার উৎপাদিত চা ও দুধ চিনি দিয়ে খাওয়ার সামর্থও তার নেই। সারাদিন এক পায়ে দাঁড়িয়ে, মাইলের পর মাইল হেঁটে কঠোর পরিশ্রম। যারা পাতা তোলেন, ২৩ কেজি পাতা তুললেই কেবল দিনের নিরিখ পূরণ হয়, হাজিরা হিসেবে গণ্য হয়। দিনে অন্তত ২৫০টি গাছ ছাঁটতে হয়। এক একর জমিতে কীটনাশক ছিঁটালে তবে নিরিখ পূরণ। দুপুরে এক ফাঁকে মরিচ আর চা পাতার চাটনি, সঙ্গে মাঝে মাঝে মুড়ি, চানাচুর। এই হচ্ছে তাদের দৈনন্দিন জীবন।বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রাম ভজন কৈরী জানান, চা শ্রমিকদের ২০ দফা দাবি মালিকপক্ষকে লিখিত দেয়ার পর কয়েক দফা দ্বি-পক্ষীয় আলোচনা হয়েছে। তবে মালিকপক্ষ কালক্ষেপণ করছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।শ্রীগোবিন্দপুর চা বাগানের মালিক মহসীন মিয়া জানান, বড় বিনিযোগে পরিচালিত চা বাগানকে টিকিয়ে রাখতে এবং শ্রমিকদের স্বার্থ রক্ষা হবে এমন সুষ্ঠু সমাধান প্রয়োজন।লোকবলের অভাবে বাগানগুলোতে সঠিকভাবে শ্রম আইন বাস্তবায়ন হচ্ছে না স্বীকার করে কল কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শক অধিদফতরের উপ-মহাপরিদর্শক মো. আজিজুল ইসলাম জানান, শ্রমিক আইনের আওতাধীন চা শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে কাজ করছেন তারা।বাংলাদেশের চা পৃথিবীর ২৫টি দেশে রফতানি করা হয়। আর এই চা উৎপাদনের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত চা-শ্রমিকরা। কিন্তু চা-শ্রমিকরা সকল নাগরিক সুবিধা ভোগের অধিকার সমভাবে প্রাপ্য হলেও তারা পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার বলে প্রতিয়মান। চা শ্রমিকদের প্রতি সদয় আচরণ ও ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, সকলের দায়িত্ব। যাদের শ্রমে অর্জিত হচ্ছে হাজার কোটি বৈদশিক মুদ্রা, তাদের অবহেলিত না রেখে অধিকার বাস্তবায়ন করা হোক এমনটাই প্রত্যাশা চা শ্রমিক নেতাদের। এআরএ/এমএস
Advertisement