ভ্রমণ

বদলে যাওয়া ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে দর্শনার্থীর ভিড়

প্রতিষ্ঠার দুই যুগ পর অত্যাধুনিক রূপ পেয়েছে কক্সবাজারের ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক। নতুন খাঁচায় শোভা পাচ্ছে সবধরনের প্রাণীকূল। মানবপ্রেমেই আচ্ছন্ন বাঘ-সিংহ-হাতি-হরিণ-জেব্রা দেখে আনন্দিত হচ্ছে দর্শনার্থী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা।

Advertisement

কক্সবাজার-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে পার্কে প্রবেশের মূল গেট পর্যন্ত এলাকার আশপাশে বেদখল বনভূমি উদ্ধার করে তৈরি হয়েছে বাস-মাইক্রো ও মোটরসাইকেলের সুপরিসর পার্কিং।

আরও পড়ুন: যে দেশের রাস্তায় নেই ট্রাফিক সিগনাল, তবুও হয় না যানজট 

পার্কিংয়ের লাগোয়া পূর্বপাশেই সাদা উড়ন্ত পায়রা হাতে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালের চারপাশে গড়া হয়েছে সবুজের আবরণ, সাজানো ফুল বাগান। পার্কের দক্ষিণে গড়া হয়েছে পিকনিক স্পট, শিশু বিনোদন কেন্দ্র। এরই দক্ষিণে পাহাড়ের পাদদেশে চলমান আছে কৃত্রিম লেক গড়ার কাজ।

Advertisement

মহাসড়কের পাশেই বসেছে দৃষ্টিনন্দন প্রবেশ ফটক। প্রশস্ত করা দু'পাশের দুই লেনের সড়কের ফুটপাতে বসেছে টাইলস। গোছালো সুপরিসর টিকিট ঘর, পর্যটকদের লাগেজ ও প্রয়োজনীয় মালামাল রাখার লকার রুম হয়েছে। সাথে তৈরি হয়েছে ব্রেস্টফিডিং ও দর্শনার্থী অপেক্ষা কক্ষও।

সংস্কার হয়ে নতুনত্ব পেয়েছে ডরমেটরি ও ব্যারাক। আধুনিক মানের ওয়াশরুমে প্রফুল্ল দর্শণার্থীরা। সংস্কার হয়েছে পার্কের মাঝখানের শতাধিক ফুট উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। চলমান আছে বাচ্চাদের বিনোদনে আলাদা অ্যামিউজিং পার্ক ও পার্কে দর্শনার্থী প্রবেশ-বাহির পথ তৈরির কাজ।

আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে অসুখী দেশ কোনটি? 

কক্সবাজারের চকরিয়ার মালুমঘাট এলাকায় ১৯৯৯ সালের শেষ দিকে যাত্রা শুরু হয় ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের। এর আগে ১৯৮০ সালে এটি ছিল হরিণ প্রজননকেন্দ্র। ভেতর-বাইরে ৯০০ হেক্টর আয়তন নিয়ে যাত্রা করা পার্কে বিপুল পরিমাণ মাদার ট্রিসহ (গর্জন) আছে নানা প্রজাতির বনজ গাছ।

Advertisement

শুরু থেকেই সবুজের আবরণে দৃষ্টিনন্দন পার্কটি প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের বিনোদনের অনুষঙ্গ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। শিক্ষার্থীরা এই পার্ক থেকে প্রকৃতিবিষয়ক জ্ঞান আহরণ করতে পারে। সপ্তাহের মঙ্গলবার ছাড়া বাকি ছয়দিন দর্শনার্থীদের উচ্ছ্বাসে, প্রাণীকূলের কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে পুরো পার্ক।

প্রাপ্তবয়স্করা ৫০ টাকা আর ৫ বছরের বড় শিশু-কিশোররা ৩০ টাকায় ও শিক্ষার্থী (শর্তসাপেক্ষে) ১০০ জনে ৫০০ টাকা ও ২০০ জন ৮০০ টাকার টিকিটে পার্ক দর্শন করতে পারছেন।

আরও পড়ুন: কেন বিয়ে হয় না পাহাড়ি এই গ্রামের সুন্দরী নারীদের? 

হাঁটতে অক্ষম দর্শণার্থী চাইলে নির্ধারিত ফি দিয়ে কর্তৃপক্ষের নিজস্ব মিনিবাসে পার্ক ঘুরে দেখতে পারেন। প্রতিদিন গড়ে ৩০০০ দর্শনার্থী এই সাফারি পার্কে বেড়াতে আসেন বলে জানিয়েছে পার্ক কর্তৃপক্ষ।

কক্সবাজার শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার উত্তরে ডুলাহাজারায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কের অবস্থান। শতবর্ষী গর্জন বনের ভেতরে লোহার বেষ্টনীতে সুন্দর ও শ্রুতিমধুর নামে বাস করছে একেকটি প্রাণী।

প্রাণী হলেও পরিচর্যাকারিরা যে নামে ডাকেন তা উচ্চারণ করলেই সাড়া দেয় বাঘ-সিংহ। বেষ্টনীতে খেলাধুলা আর হুংকার ছেড়েই সময় পার করা এসব প্রাণী যা দেখে আনন্দ পান দর্শণার্থীরা।

আরও পড়ুন: যে দেশের নাগরিকত্ব মেলে খুব সহজেই 

তথ্যমতে, পার্কে দেড় ডজন বেষ্টনীতে সংরক্ষিত প্রাণীকূলে কঠোর নিরাপত্তায় পালিত হচ্ছে হাতি, বাঘ, সিংহ, জলহস্তি, গয়াল, আফ্রিকান জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্ট, ভাল্লুক, বন্য শূকর, হনুমান, ময়ূর, স্বাদু ও নোনা পানির কুমির, সাপ, বনগরুসহ দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির প্রাণী।

পার্কজুড়ে আরও আছে চিত্রা, মায়া, সম্বর ও প্যারা হরিণ। আছে জানা-অজানা বিচিত্র ধরনের কয়েকশ’ ধরনের পাখি। ৫২ প্রজাতির ৩৫০ প্রাণী পার্কে দেখা মেলে।

উন্মুক্তভাবে আছে ১২৩ প্রজাতির এক হাজার ৬৫ প্রাণী। এর মধ্যে গুইসাপ, শজারু, বাগডাশ, মার্বেল ক্যাট, গোল্ডেন ক্যাট, ফিশিং ক্যাট, খেঁকশিয়াল, বনরুই উল্লেখযোগ্য। হেঁটে পার্ক ভ্রমণের সময় অসংখ্য বানর, শিয়াল, খরগোশ, হরিণসহ বন্যপ্রাণীর দৌড়ঝাঁপ দেখা যায়।

আরও পড়ুন: খাগড়াছড়ির পর্যটন কেন্দ্রে সুনসান নীরবতা 

দেখা মেলে কালের সাক্ষী বিশালাকার দুর্লভ ও মূল্যবান বৃক্ষরাজির। সেসব গাছ ও দেয়ালে দেয়ালে বানরের লাফালাফি নজর কাড়ে সবার। এসব দৃশ্য মোবাইল ফোন ক্যামেরায় বন্দি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন দর্শনার্থীরা।

পার্কের প্রাণীকূলের চিকিত্সার জন্য রয়েছে হাসপাতাল। যেখানে সার্বক্ষণিক রয়েছে প্রাণী চিকিৎসক। প্রতিদিন সাফারি পার্ক ভ্রমণে আসা দর্শনার্থীদের মূল আকর্ষণ থাকে বাঘের বেষ্টনী। বাঘের দৌড়ঝাঁপ দেখে সবাই আনন্দে মাতেন।

পার্কের বাঘ-সিংহ ও তৃণভোজী প্রাণীদের জন্য তৈরির শেষ পর্যায়ে রয়েছে সাফারি। বাঘ-সিংহের জন্য শত একর জমির আলাদা সাফারি ও জেব্রা, গয়াল, হরিণসহ অন্যপ্রাণীদের জন্য বরাদ্দ হয়েছে কয়েকশ’ একর এলাকা।

আরও পড়ুন: ভ্রমণে যাওয়ার সময় ব্যাগ গোছাবেন কীভাবে? 

বেষ্টনী অনুসারে সাফারির চারপাশে তৈরি হয়েছে নিরাপদ পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ পথ। গড়া হয়েছে প্রবেশ-বাহিরের জন্য স্বয়ংক্রিয় ফটক, যান চলাচলে উপযুক্ত পাকা সড়কও। বাঘ-সিংহসহ হিংস্র প্রাণী বনে মুক্ত করে দেওয়া হলে খাঁচাযুক্ত গাড়িতে দর্শনাথীর্রা সংশ্লিষ্ট বেষ্টনীতে ঢুকে বিচরণরত বাঘ-সিংহ অবলোকন করেন।

স্থানীয় অধিবাসী নাজিম উদ্দিন বলেন, ঈদ ও নানা আয়োজনে স্বজনদের বিনোদনার্থে হাতের কাছে পার্কটি-ই আমাদের ভরসা। প্রায় দুই যুগ ধরে পার্কে আসা-যাওয়া হয়। কিন্তু গত অর্থবছরে নেয়া কিছু প্রকল্প পার্কের পুরোনো চিত্র পাল্টে ফেলেছে।

আবদ্ধ ও উন্মুক্ত প্রাণিকূলের এক বেষ্টনী হতে অন্য বেষ্টনী পর্যন্ত সহজে যেতে তৈরি হয়েছে সংযোগ সড়ক। অতিরোদ পড়া বেষ্টনীগুলো ছায়া ঘেরা পরিবেশে স্থানান্তর করা হয়েছে। তৈরি হয়েছে সুনিপুণ অবকাঠামো। এখন সহজে বিশাল পার্কে ঘোরা যায়।

আরও পড়ুন: যে দেশের নারীরা স্বামীর অবর্তমানে নারীকেই বিয়ে করেন 

সাফারি পার্কের ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, দেশের প্রথম সাফারি পার্ক ডুলাহাজারা। মূলত সাফারি পার্ক শিক্ষার্থী ও প্রকৃতি গবেষকদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে সহায়ক।

সাফারি বলতে, পার্কে থাকা প্রাণীগুলো উন্মুক্ত থাকে আর দর্শনার্থীরা থাকবে খাঁচায় আবদ্ধ। চলন্ত গাড়িতে ঘুরে তারা বন্যপ্রাণী দেখে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করেন। কিন্তু আমাদের দেশে এখনো সেভাবে সাফারি পার্ক গড়ে তোলা যায়নি।

তিনি বলেন, আমরা দক্ষিণ এশীয় পদ্ধতিতে পার্ক চালাচ্ছি। পার্কে থাকা প্রতিটি প্রাণীর জন্য আলাদা বেষ্টনী রয়েছে। আছে আলাদা খাবার সংরক্ষণ ও প্রাণীদের পরিচর্যার ব্যবস্থা ও নিরাপত্তাকর্মী।

আরও পড়ুন: মাটির নিচেই বাড়ি-বাজার, হোটেল-ক্লাব 

প্রতিষ্ঠার দুই যুগে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কটি এ অঞ্চলের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার বেড়ানো ও বিনোদনের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বার্ষিক পিকনিক করতে আসছে অনেক শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। তাই পার্কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হয়েছে। কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয় গত অর্থবছরে।

বন কর্মকর্তা মাজহার আরো বলেন, ‘অনেক বছর বাঘ-সিংহকে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। আমরা সত্যিকারের সাফারি পার্ক করার উদ্যোগ নিয়েছি। বাঘ-সিংহ ও অন্য প্রাণীগুলো সম্পূর্ণ মুক্ত করে বিচরণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’

‘প্রয়োজনীয় অনেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে, কিছু কাজ সমাপ্তের পথে-তাও দ্রুতগতিতে এগুচ্ছে। চলতি অর্থবছরের শেষের দিকে আমরা সে লক্ষ্য ছুঁতে পারব বলে আশা করছি।’

জেএমএস/জিকেএস