`বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। সেই মায়ের কোল যদি সন্তানের জন্য অনিরাপদ হয়ে ওঠে এরচেয়ে সভ্যতাবিরোধী ঘটনা বোধহয় আর কিছুই হতে পারে না। রাজধানীর বনশ্রীতে দুই সন্তান হত্যায় তাদের মা মাহফুজা মালেক জেসমিন জড়িত বলে দাবি করেছে র্যাব। এই স্বীকারোক্তির ঘটনা যদি সত্যি হয় তাহলে ভাবতে হবে আমরা কি মধ্যযুগে ফিরে যাচ্ছি? মধ্যযুগেও কি মা তার সন্তানের হন্তারক হতেন? একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার চরম উৎকর্ষের সময়ে এ কেমন মায়ের দেখা পেলাম আমরা যে তার নিজ সন্তানকে হত্যা করে? সোমবার রাতে চাইনিজ খাবার খেয়ে দুই ভাই-বোনের মৃত্যুর খবরে আটক করা হয় সংশ্লিষ্ট চাইনিজ রেস্টুরেন্টের মালিক, ম্যানেজারসহ তিনজনকে। পরে ময়নাতদন্ত রিপোর্টে বলা হয় নিহতদের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ছিল। এরপরই তদন্ত নতুন মোড় নেয়। এদিকে দুই সন্তানের মরদেহ হাসপাতালে রেখে গ্রামের বাড়ি জামালপুরে চলে যায় তাদের পিতা-মাতা। র্যাব হত্যার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বাবা-মা এবং খালাকে জামালপুর থেকে আটক করে ঢাকায় নিয়ে আসে। পরে র্যাবের হেফাজতে থাকার সময় নুসরাত আমান (১২) ও আলভী আমানকে (৬) হত্যার দায় স্বীকার করে তাদের মা। র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে মা মাহফুজা মালেক জেসমিন জানান, ওড়না দিয়ে শ্বাসরোধ করে প্রথমে মেয়েকে এবং পরে ছেলেকে হত্যা করেছেন। হত্যার সময় মেয়ে জেগে ছিল আর ছেলে ঘুমাচ্ছিল। হত্যার কারণ হিসেবে বলা হয়- পারিবারিক অশান্তি থেকে এবং সন্তানেরা পড়াশোনা করতো না বলে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। এই মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন। এখনই চূড়ান্ত কিছু বলা যাচ্ছে না। তদন্তেই হয়তো সবকিছু বেরিয়ে আসবে। কিন্তু নিষ্পাপ দু`টি শিশু আর কোনোদিন ফিরে আসবে না। কেন দুটি ফুল না ফুটতেই অকালে ঝরে গেল এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠছে সঙ্গতই। সাম্প্রতিক সময়ে এমনিতেই শিশুহত্যা বেড়েই চলেছে। সেখানে নিজ ঘরে স্বজনদের কাছেও যদি শিশুরা নিরাপদ না থাকে এরচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে। আমরা কি পেছনের দিকে হাঁটছি। মানুষের মনুষ্যত্ব কি অবলুপ্ত হতে চলেছে? এমনকি মা-সন্তানের চিরন্তন নিঃস্বার্থ ও শর্তহীন ভালোবাসার ক্ষেত্রেও কি ঘুণপোকার আক্রমণে দেখা দিল? এ কেমন মা? পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় সবকিছু পাল্টে যাচ্ছে। সেখানেও পাল্টে যাবে মা। লোভ-লালসা জিজ্ঞাংসার কাছে পরাজয় হবে মাতৃত্বের। সমাজতাত্ত্বিকরা বলছেন, একটি সমাজ যখন উন্নত সামাজিক ব্যবস্থার দিকে প্রবেশ করে তখন সমাজে বেশকিছু বিষয়ে পরিবর্তন আসতে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম মানুষের আর্থিক সক্ষমতা। মানুষ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। চাহিদা আরও বাড়ছে। পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় যারা পিছিয়ে থাকে তাদের মধ্যে জেদ, মন কষাকষি, ক্ষোভ, না পাওয়ার আকুতি, আফসোসসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। এতে তারা নানা অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায়ই কি মা পরিণত হয় হন্তারকে? সন্তান গর্ভে ধারণ করলেই কি তিনি মা? আর এক মাকে দিয়ে কি সব মায়ের বিচার চলে? এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আজ অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে কোন পরিস্থিতি একজন মাকে ‘হত্যাকারী’ বানায় তার সূত্রসন্ধান অত্যন্ত জরুরি। শুধু আইন-কানুন দিয়ে এর সমাধান হবে না- মনে রাখতে হবে এটিও। এইচআর/পিআর
Advertisement