উত্তর-আধুনিকতা নিয়ে বোদ্ধা মহলে বেশ একটা টানাটানি আছে। কারো মতে, এটি খুব দুর্বোধ্য এক ব্যক্তিক পলিস্কোপ; যার ভেতর একসঙ্গে বহু ভাবনা প্রতিফলিত হয়। কাজেই এই ভাবনার মধ্যে সহজে দাঁত বসানো যায় না। আবার কেউ মনে করেন, উত্তর-আধুনিকতা হচ্ছে জীবনের বহুমাত্রিক প্রপঞ্চের এক অন্তর্মুখীন অনুভূতি। জীবন যেমন বহুতল ভবনের মতো বহুলাংশে অসংবৃত; তেমনি উত্তর-আধুনিকতাও এই বহু ভাবনার এক বিচিত্র সঙ্গম। বিরহ-বেদনা-আনন্দ-হতাশা আর আক্ষেপের এক সংশয়মুখর গৃহস্থল হচ্ছে জীবন। আর এই জীবনের নানা সঙ্গের বৈচিত্র্যময় ও বহুমুখী অনুবর্তনই হলো উত্তর-আধুনিকতা, দর্শনের ভাষায় যাকে বলা হয় প্লুরালিস্টিক এন্ডোর্সমেন্ট বা ফিলসফিক্যাল এক্লেক্টিসিজম। তবে উত্তর-আধুনিকতা শব্দটার ইংরেজি একটা গালভরা প্রতিশব্দ আছে পোস্ট-মর্ডানিজম, যা হাল আমলে একদল মানুষ পরম আদরের সঙ্গে ব্যবহার করে আসছেন।
Advertisement
উত্তর-আধুনিকতার ব্যাপ্তি বিপুল—বিজ্ঞান, সাহিত্য, শিল্পকলা, সমাজবিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস এবং অবশ্যই দর্শনের ব্যাপকতার জঠরে বেড়ে উঠেছে এই সাম্প্রতিক বোধ। আমরা প্রবেশ করেছি নতুন এক বৈদ্ধিক যুগে; ‘এক নতুন যুগের ভোরে’। নতুন এই যুগের কারিগর অনেকেই; অনেকের নামই এর সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িত। তবে সবার আগে কয়েকজন দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীর নাম উচ্চারণ না করলে আলোচনার শুরুতেই গলদ থাকবে। মিশেল ফুঁকো, জ্যাক দেরিদা, জ্যা ফ্রাংকুস লিওটর্ড, রিচার্ড রোটি, জ্যা বুডিলার্ড, ডগ্লাস কেলনার, ফ্রেড্রিক জেমসন, এমানুয়েল লেভিন্যাস, স্ল্যাভয় জিজেক, জিল দলুজ, গায়িত্রি স্পিভাক প্রমুখ ছাড়াও অনেক বিজ্ঞানের দার্শনিক যেমন- পপার, ফায়ারাবেন্ড, ল্যাকাটোসের নাম প্রায়ই উচ্চারিত হয়ে আসছে। তবে গোটা দুনিয়ায় যারা এই ভাবনাকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন, তাদেরও উত্তর-আধুনিক না বললে ভুল হবে। কারণ উত্তর-আধুনিকতা বিশেষ কোনো একটি নাম নয় বরং একটি প্রবণতা বা চিন্তার গতি-প্রকৃতি, যার মধ্য দিয়ে হাজার বছরের নির্মিত অনেক সৌধ ভেঙে গেছে অবলীলায়! আইনস্টাইন যেমন নিউটনের ক্লাসিক্যাল মেকানিক্সের দুর্গে রিলেটিভিটির বোমা ফাটিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি উত্তর-আধুনিকতা আধুনিকতার ইস্পাত কঠিন ব্যূহের ওপর বড় একটা জিজ্ঞাসার চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন। Stanley Grenz তাঁর A Primer on Post Modernism বইয়ে দারুণ একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন, “[Postmodernism] affirms that whatever we accept as truth and even the way we envision truth are dependent on the community in which we participate... There is no absolute truth: rather truth is relative to the community in which we participate.” চিরন্তন সত্য নিয়ে যাদের এতদিন গর্ব ছিল তাদের বিশ্বাসের ওপর সাংঘাতিক এক আঘাত এনে দিয়েছে এই নতুন চিন্তা। রিচার্ড রোটি এ সম্পর্কে খুব খোলামেলা এক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলছেন, সত্য হচ্ছে কোনো বাক্যের এক বিশেষ ধরনের গুণ, যেহেতু বাক্য নির্ভর করে শব্দ সমাবেশের ওপর, আর শব্দ গড়ে ওঠে মনুষ্য ব্যবহারের ওপর। তাই সত্য সত্যগুলো প্রকারন্তরে জীবনকে ঘিরেই। এটাকে অনেকেই বলছেন সাংস্কৃতিক রূপান্তর, গতিময় মহাবিশ্বের অকৃত্রিম চিত্র। মানুষের অধীনতার বিরুদ্ধে এক প্রকার শিকল ছেঁড়ার গান।
প্রচলিত চিন্তায় উঁচু-নিচু, ভালো-মন্দ, উত্তম-অধম, ন্যায়-অন্যায় যে কাঠি দিয়ে মাপা হতো, যে সরল আবরণ দিয়ে আমাদের চিন্তা থাকতো ঢাকা, সেই ঋজু পথের কিনারায় দেখা দিয়েছে অজস্র নতুন পথ। সরল পথ যেখানে শেষ হয়, সেখানে বহু পথের কিনারায় গিয়ে আক্ষেপ করতে দেখি। রবার্ট ফ্রস্টের মতন বলে উঠি, ‘দ্য রোড নট টেকেন’- যে পথে হাঁটা হলো না। এই আক্ষেপ ও সংক্ষুব্ধ বেদনার কারণে শুরু হয় ভাবনার বহুমাত্রিকতা যা থাকে অজস্র বর্ণিলতায় ঘেরা। কাজেই বহু পথের বৈচিত্র্যময়তার এক সংশয়ী মিশ্রণ হচ্ছে উত্তর-আধুনিকতা। এখানে খসে পড়েছে কর্তৃত্ববাদের একমুখী পাহারা আর তথাকথিত গ্র্যান্ড ন্যারেটিভের ছায়াতলে বেড়ে ওঠা সমন্বিত অখণ্ড বোধ। ভাববাদ, বস্তুবাদ, মার্কসবাদ, ফ্রয়েডবাদ, কাঠামোবাদ ইত্যাদি বাদানুবাদ শেষ করে মানুষ যেন খোলা আকাশের নিচেই দাঁড়িয়ে বুক ভরে নিশ্বাস নিতে পেরেছে। মাথার ওপর থেকে নিয়ন্ত্রণের ছাদ উঠে গেলে যেমন দক্ষিণা বাতাসে প্রাণ গেয়ে ওঠে অজানার আনন্দে; তেমনি মানুষের ভাব-চৈতন্যে একটা দোলা লেগেছিল গেল শতকের মাঝামাঝি। মানুষ মনের অজান্তে গেয়ে উঠলো, “বিদারিয়া/ এ বক্ষপঞ্জর, টুটিয়া পাষাণবন্ধ/ সংকীর্ণ প্রাচীর, আপনার নিরানন্দ/ অন্ধ কারাগার—হিল্লোলিয়া, মর্মরিয়া,/ কম্পিয়া, স্খলিয়া, বিকিরিয়া, বিচ্ছুরিয়া,/ শিহরিয়া, সচকিয়া আলোকে পুলকে,/ প্রবাহিয়া চলে যাই সমস্ত ভুলোকে/ প্রান্ত হতে প্রান্তভাগে, উত্তরে দক্ষিণে,/ পুরবে পশ্চিমে;’’ (বসুন্ধরা, রবীন্দ্রনাথ)।
উত্তর-আধুনিকতাকে আধুনিক উত্তর বা আধুনিক পরবর্তী ভাবনাও বলা হয়ে থাকে। কালের নিক্তিতে আমরা যে সময়-স্রোতকে ভাগ করেছি তার শেষ কিনারায় এসে উঁকি দিয়েছে আধুনিকোত্তর পর্ব। ঠিকঠাক বললে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর সময়-ভাবনাকে আমরা বলছি উত্তর-আধুনিক পর্বের সাম্প্রতিক যাত্রা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আধুনিকতার বিরুদ্ধে মানুষের মনের ভেতর যে দগদগে ঘা তৈরি হয়েছে তার থেকে মুক্তি চেয়েছে বিশ্বমানব, নিশ্বাস ফেলতে চেয়েছে খোলা আকাশে। যন্ত্রের যন্ত্রণায় জীবনের সব রঙিন পাঁপড়ি যখন নিরাসক্ত হয়ে উঠেছে তখন চেয়েছে মুক্তি। গেয়ে উঠেছে, “আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে/ আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে”। এই মুক্তি মানে কর্তৃত্ববাদের একচ্ছত্র থাবা থেকে অসীম আলোর অভিসারী হওয়া। সামগ্রিক মানুষ থেকে ব্যক্তিক মানুষের অসীম গগন বিহারী হয়ে ওঠা; এখানেই মুক্তি। আমার চেতনার রঙে পান্নার সবুজ হয়ে ওঠা, চুনির হয়ে ওঠা লাল। তাই আমরা থেকে আমি হয়ে উঠেছে জগৎ-কেন্দ্র। বিমানবিকীকরণ বা ডি-হিউমানাইজেশন থেকে আপন ঘরে ফিরে এসে মানুষকে ভবসিন্ধুর মাঝখানে আবার পুনর্প্রবর্তন করা হয়েছে। কেনই বা না, কারণ, “মানুষের অহংকারপটেই বিশ্বকর্মার বিশ্বশিল্প”। তবে বেশিরভাগ মানুষ হয়তো ভাবেন আধুনিকোত্তর ভাবনা সাম্প্রতিক সময়ের কিছু উন্নাসিক মানুষের খামকা প্যাঁচাল। কেউ বিশ্বাস করেন এর ভেতর দিয়ে মানুষ যাচ্ছে-তাই রকম স্বাধীন আর যথেচ্ছ কর্মকাণ্ড ঘটানোর সার্টিফিকেট পেয়ে ওঠেন। তাই স্বাধীনতার এক লাগামহীন অপপ্রয়োগ হলো এই নতুন চিন্তা। আসলেই উত্তর-আধুনিকতা শব্দটা একটা ভিন্নতর বোধের জন্ম দিয়েছে। এটা মানুষের চেতনা-সিঁড়ির এক নতুন উদ্বর্তন। তাই বিচ্ছিন্নভাবে বিষয়টা বুঝতে বেশ খানিক ঝক্কি আছে বৈ কি! যেহেতু উত্তর-আধুনিকতা শব্দটা আধুনিকতাকে ঘিরে। তাই আধুনিকতা সম্পর্কে একটা ধারণা থাকা খুব দরকার। তবে গভীরে প্রবেশের আগেভাগে মোটা কথায় বলে রাখা ভালো, উত্তর-আধুনিকতা হচ্ছে আধুনিকতার বিরুদ্ধে এক ধরনের বিশেষ সঙ্গবদ্ধ প্রতিক্রিয়া অর্থাৎ আধুনিকতার বিরুদ্ধে এক তীব্র মনভঙ্গী। জীবনের কোনো কিছুই যেমন এপ্রয়রি ফর্মে এগোয় না; তেমনি ভাবনার কোনো অনুষঙ্গই একটা সরল রাস্তার পথিক নয়, নয় পূর্ব ধারণায় সিক্ত কিছু। জীবন মানেই বিচিত্র ও অনানুধ্যানিক অবয়বের এক মহামিলন। জ্যা-পল-সার্ত ঠিক যেমন করে বলেছিলেন, “Life has no meaning a priori… It is up to you to give it a meaning, and value is nothing but the meaning that you choose.” সার্তের কথায় খুব পরিষ্কার, একটা গ্রান্ড নেরেটিভ বা সরল ও এক রৈখিক ভাবনার ছায়াতল থেকে আমরা পৌঁছাতে চলেছি বহুমাত্রিক চেতনার অবশ্যম্ভাবী পরিণতিতে। উত্তর-আধুনিক ভাবনা এই বহু বর্ণিল পথকে আমাদের মানসপটে তুলে ধরেছে। ক্ষণ পরিবর্তন ও ক্ষণস্থায়িত্বের এক সীমাহীন প্রকাশ হচ্ছে জীবন ও প্রকৃতি। তাই এই পরিবর্তনের অনিবার্য প্রকাশ উত্তর-আধুনিক চিন্তায়। রবার্ট ফ্রস্টের আরেকটা ছোট্ট একটা কবিতা শুনে নিই: Nature’s first green is gold,Her hardest hue to hold. Her early leaf’s a flower;But only so an hour.Then leaf subsides to leaf,So Eden sank to grief,So dawn goes down to dayNothing gold can stay.ফ্রস্ট বুঝেছিলেন জীবনের ব্যাপ্তি খুব সীমিত, খুব সংক্ষেপিত এই মহারণ অতি সামান্য সময়ের জন্য। একদিন এর পরিসমাপ্তি ঘটে। যে ঢেউ মানুষের জীবনকে পাল্টিয়ে দিয়ে চলেছে অবিরত; সেই মহাসৌন্দর্যের কল্পবাণীরও একদিন পরিসমাপ্তি ঘটে। শুরু হয় নতুন জীবনের আরেক রূপকল্প। উত্তর-আধুনিকতা এই পরিবর্তনকে ছেঁকে তুলেছে অপূর্ব দার্শনিক মমতায়। তবে প্রায়ই একটা কথা মনে আসে, উত্তর-আধুনিকতা কি আমাদের নিহিলিজমের ডেরায় নিয়ে চলছে? আমরা কি একটা এবসার্ড জগতের ভেতর প্রবেশ করতে চলেছি? একটা মহাশূন্যবাদের দিকে কি আমাদের অন্তিম যাত্রা শুরু হলো? ইত্যাদি। এর উত্তর পেতে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে দেখি আধুনিকতা কী?
Advertisement
আসলে আধুনিকতা বা উত্তর-আধুনিকতা শব্দ দুটোর বিভাজন কিন্তু যতটা সময়কে ঘিরে, তার থেকেও বেশি হচ্ছে সময়ের মেরিট বা কালের মর্জিকে নিয়ে। অর্থাৎ কী ধরনের চিন্তা থেকে আমরা জগতকে বোঝার চেষ্টা করে থাকি, সেটাই কালের বৈশিষ্ট্য। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, জগতকে বোঝার প্রাণান্ত চেষ্টার মধ্য দিয়ে আমাদের কাছে সত্য পরিষ্কার হয়ে ওঠে। তাই জগৎ ও মনের হার না মানা এক যুদ্ধের ফলাফল হচ্ছে সত্য। ‘কাল’ চিন্তার জন্য খুব অপরিহার্য একটা বিষয়। কাল হচ্ছে একমুখী এবং বহু ঘটনা বুকে নিয়ে চলার নিরব সাক্ষী। এই কাল তাই বহন করে চলেছে এক একটা চিন্তার বিচিত্র উপাচার। এক এক কাল সাক্ষ্য দেয় এক এক সময়ে মানুষের বেড়ে ওঠা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে এক এক ধরনের চিন্তা। চিন্তার এই স্রোতের ওপর দৃষ্টি রেখেই নামকরণ করা হয়েছে, প্রাচীন, মধ্য, আধুনিক, সমকালীন কিংবা উত্তর-সমকালীন যুগ, ইত্যাদি। তবে যেটাকে প্রাচীন বলছি, তার মধ্যেও আধুনিক এমনকি উত্তর-আধুনিক ভাবনার নানা উপকরণ পাওয়া যায়। তাই সঙ্গত কারণেই তথাকথিত এই বিভাজন বেশ ঝুঁকির বিষয়! তবে এটা সন্দেহ না রেখে বলতে পারি, আধুনিকতা ও উত্তর-আধুনিকতার মাঝে একটা সুস্পষ্ট বিভেদ রেখা নিশ্চিতভাবে আমাদের কাছে হাজির হয়েছে গেল শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। আধুনিকতা শব্দটা ইংরেজি মডার্নিজমের থেকে কম পরিচিত। যেহেতু প্রতীচ্য দেশ থেকে এর সূত্রপাত; সেজন্য উত্তর-আধুনিকতা থেকেও পোস্ট-মডার্নিজম শব্দটা আমাদের বেশি টানে। এক সময় আমাদের মননের ভেতর গভীরভাবে প্রাচীন মিথলজির রাজত্ব ছিল। জগত কীভাবে সৃষ্টি হলো, জগতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী, আমরা আমাদের চারদিকে যা উপলব্ধি করি সেটা কি ব্যক্তিক না নৈর্ব্যক্তিক? ইত্যদি। এই রহস্যবাদ শেষ করে মানুষ তার জীবন প্রবাহে পরিবর্তন এনেছে। পরিবর্তন এসেছে বিজ্ঞানের হাত ধরে। মধ্যযুগ শেষ করে পশ্চিম প্রান্তর বিভাসিত করে যে নতুন জ্ঞানের সূর্য উঠেছিল তার প্রথম শর্ত ছিল জ্ঞান। বুদ্ধির স্রোতে ভেসেছিল সেদিন ইংল্যান্ড আর ফরাসি দেশ। বেকন, ডেকার্ত, স্পিনজা, লক-এঁদের মধ্যে কেউ বুদ্ধি কেউ অভিজ্ঞতার ডিঙি চড়ে পার হয়েছিল কৃষ্ণসাগর। সেই ছিল আধুনিক সমুদ্রে প্রথম নৌবিহার।
বিজ্ঞান আস্তে আস্তে নৈর্ব্যক্তিকতার দৃঢ় বলয়ে আমাদের বন্দি করে ফেলেছে। তাই যারা এ পরিবর্তন মেনে নিয়েছেন তাদের বলছি আধুনিক। আর এ আধুনিকতার স্পর্শে পরিবর্তন এসেছে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের। কোনো নতুন কিছু দেখলেই আমরা বলি, আধুনিক। নতুন কাপড় পরলে আমরা বলি, আধুনিক। নতুন বাড়ি, হালফ্যাশানের গাড়ি, চাল-চলন, কথা-বার্তা শুনলে বলি আধুনিক! পুরোনো প্রাচীর ভেঙে যখন নতুন দেওয়াল তুলি; তখন বলি এটা আধুনিকতার ছাপ! এটা বলি কেন? বলি এজন্য যে যুক্তি, বিজ্ঞান, তথা মুক্তচিন্তার সঙ্গে নিজের অবস্থানের সামঞ্জস্য বিচার করার মধ্য দিয়ে যেটা গ্রহণ করা হয়, সেটাই আধুনিকতা। আঠারো শতকে ইউরোপে মানুষের জীবনের এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। পরিবর্তনটা এসেছিল বিজ্ঞানের হাত ধরে। পরে এটা সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা ও চিন্তার অন্যান্য শাখায় ছড়িয়ে পড়ে। আমরা জানি সাহিত্য, দর্শন, শিল্পকলা, সমাজবিজ্ঞান, কিংবা নৃ-তত্ত্বের নানা উপসঙ্গের মাঝ দিয়ে মানুষের জীবনের চিত্র ফুটে ওঠে। প্রাচীন অধিবিদ্যা মিশ্রিত এক প্রকার রহস্যবাদী কল্পযাত্রার অবসান শেষে নতুন আলোর দেখা মেলে এই সব চিন্তার নানা অবয়বে। প্রাচীন গতানুগতিক জীবনযাত্রার ওপর মানুষের ক্লান্তিকর বিশ্বাসকে পেছনে রেখে এই নতুধারার মোড় ঘোরে। পুরোনো বিশ্বাস আস্তে আস্তে মানুষের মনোজগৎ থেকে খসে পড়তে থাকে, যেমন করে শীতের শেষে গাছের পুরোনো পাতা ঝরে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে মানুষের এক ধরনের নতুন বোধোদয় ঘটে। ভিক্টোরিয়ান মরালিটি বা গতানুগতিক শিল্পচর্চা আর সাহিত্যের প্রকাশকে পেছনে ফেলে এই নবযুগের যাত্রা। আমেরিকান ঔপন্যাসিক হেনরি জেমস, ব্রিটিশ ছোটগল্পকার জোসেফ কনাড, আইরিশ সাহিত্যিক জেমস জয়েস, কিংবা আমেরিকান কবি টিএস এলিয়ট, সাহিত্যে; নিউটনিয়ান ক্লাসিক্যাল ফিজিক্স, আইনস্টাইনের অপেক্ষবাদ, প্ল্যাঙ্কের কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব, ফ্রয়েডের মনঃসমীক্ষণবাদ, ফারডিন্যাড ডি স্যুসরের ভাষার কাঠামোবাদ ইত্যাদি ছাড়াও শিল্প ও নৃতাত্ত্বিক ভাবনার বিবিধ অংশে এই আধুনিকতার পরিচয় মেলে। বলা হয়ে থাকে, ১৯২২ সালে প্রকাশিত দুটি গ্রন্থ জেমস জয়েসের ইউলিসিস আর টিএস এলিয়টের ওয়েস্ট ল্যান্ড আধুনিকতার বিশ্বস্ত পরিচয় দেয়। বলা হচ্ছে, জেমস জয়েস তাঁর উপন্যাস তথা সাহিত্য সাধনায় চেতনার অব্যাহত ও অবিরাম ধারা আয়োজন করে চলেছে। জয়েস চেতনার প্রবাহ, অযৌক্তিক নাটক, পৌরাণিক সমান্তরালতা এবং অন্যান্য কৌশলগুলোকে একটি আনুষ্ঠানিক মিলনে একত্রিত করেছেন, যা অন্য আধুনিকতাবাদী এবং ঔপন্যাসিকদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। অন্যদিকে এলিয়টও আধুনিকতাবাদের দারুণ এক সমার্থক। তাঁর কবিতার সবকিছুই উচ্চ আধুনিকতার কথা তুলে ধরে: আধুনিক অভিজ্ঞতাকে সাজাতে মিথের ব্যবহার; বিভিন্ন কণ্ঠস্বর, ঐতিহ্য ইত্যাদিকে বাহক হিসেবে গ্রহণ করে ফর্মের উপরে ফোকাস দিয়েছেন তিনি। তবে আধুনিকতায় চিন্তার মুক্তি এনে দিলেও সেখানে এক রকম গণ্ডিবদ্ধতা আছে, আছে চিন্তার শিকল। মোটকথা আধুনিকতা একটা ফর্ম, একটা রৈখিক পথের ঋজু নির্গমন। উত্তর-আধুনিকতাউত্তর আধুনিকতার ওপর আলোচনা শুরু করার আগে কাজী নজরুলের কয়েকটা লাইন মনে পড়লো, “আমি চিরদুর্দম, দুর্বিনীত, নৃশংস,/ মহা-প্রলয়ের আমি নটরাজ, আমি সাইক্লোন, আমি ধ্বংস!/ আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর,/ আমি দুর্বার,/ আমি ভেঙে করি সব চুরমার!/ আমি অনিয়ম উচ্ছৃঙ্খল,/ আমি দ’লে যাই যত বন্ধন, যত নিয়ম কানুন শৃঙ্খল!/ আমি মানি না কো কোন আইন,/ আমি ভরা-তরী করি ভরা-ডুবি, আমি টর্পেডো, আমি ভীম ভাসমান মাইন!/ আমি ধূর্জটি, আমি এলোকেশে ঝড় অকাল-বৈশাখীর/ আমি বিদ্রোহী, আমি বিদ্রোহী-সুত বিশ্ব-বিধাত্রীর!” নজরুলের এই চরম কবিতায় উঠে এসেছে প্রচলিত কানুনের ওপর সাংঘাতিক এক বিদ্রোহ, কী ভয়ানক এক অনাস্থা! এখানে একটাই কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে, সেটি হলো, ‘আমি’। সবার ওপরে এই আমির জয়গান মানুষকে নিয়ে ভেঙে দিয়েছে সামাজিক বেড়ার দুর্ভেদ্য স্তর। উত্তর-আধুনিকতা হলো এই দুর্ভেদ্য স্তর ভেঙে এক নতুন বোধ তৈরি করা। সাহিত্য, দর্শন, স্থাপত্য, এমনকি বিজ্ঞানের মাধ্যমে আমরা যে জগত-ব্যাখ্যা পাই; সেটাকে বহুলাংশে বাতিল ও অসম্পূর্ণ মনে করে উত্তর-আধুনিকতা। তাহলে সম্পূর্ণটা কী? আগে যেমন সুস্পষ্ট বিভাজন ছিল ভালো-মন্দের, ন্যায়-অন্যায়ের, উঁচুতলা-নিচুতলার সেই তথাকথিত বিভাজন উঠে গেছে উত্তর-আধুনিক চিন্তায়। বৃটিশ নাট্যকর হেরল্ড পিনটার চমৎকার একটি সংজ্ঞা দিয়েছেন উত্তর-আধুনিকতার: “There are no hard distinctions between what is real and what is unreal, nor between what is true and what is false. A thing is not necessarily either true or false; it can be both true and false.” উত্তর-আধুনিকতার কয়েকটা দার্শনিক প্রেক্ষাপট আছে। এটা সর্বাংশে একটা এন্টি-রিয়েলিস্ট অবস্থান গ্রহণ করেছে। যার অর্থ দাঁড়ায়, আমার চিন্তার বা মনের বাইরে স্বাধীনভাবে সত্তার অবস্থান অসম্ভব। এ কারণে উত্তর-আধুনিকতা সব সময় সামাজিক গঠনবাদ বা সোশ্যাল কনস্ট্রাকশানিস্ট ভিউ গ্রহণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে এটাও অস্বীকার করেছে, সুনির্দিষ্ট কোনো মেথড বা চিন্তার পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা সেই সত্তা সংক্রান্ত জ্ঞানের একটা বস্তুগত ভিত বানাতে সক্ষম হই। গেল শতাব্দিতে বিজ্ঞানের দর্শনে একটা স্লোগান বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, ‘এনিথিং গোজ’। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সুনির্দিষ্ট কাঠামোর ভেতর বিশেষ পদ্ধতি বা মেথডের মাধ্যমে চিন্তা করার দিন শেষ। যেমন খুশি তেমন করে ভাবনার ভেতর দিয়েই বৈজ্ঞানিক সত্য পাওয়া সম্ভব। যত মত, তত পথ–এই সত্যটাই বিশেষভাবে মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। উত্তর-আধুনিকতা বহুত্ববাদী সমাজের এক অবিচল চিত্র।
আমাদের সমাজটি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, এখানে নানা রকম বৈচিত্র্যময় মানুষে ঠাসা। সাদা-কালো, কেজো-অকেজো, অটিস্টিক, চতুর, উদ্ভাবনশীল, অলস, নাস্তিক, ধার্মিক, সমকামী, অসমকামী, তৃতীয় লিঙ্গ, গোঁড়া, মুক্তমনা, একগামী-বহুগামী, একান্নবর্তী, সিঙ্গুলার, একক অভিভাবক, ডিভোর্সি, একেশ্বরবাদী, বহুশ্বরবাদী, মিস্টিক, সুফি, কবি, দার্শনিক, শিল্পী, বিজ্ঞানী ইত্যাদি নিয়ে আমাদের সমাজ। যত মানুষ তত তাদের ভাবনা, তত তাদের চাওয়া। সংস্কৃতির বিভাজনও তত। উত্তর-আধুনিকতার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বহুসংস্কৃতিবাদ। বিশ্বসভায় সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ অত্যন্ত অপরিহার্য এক ঘটনা; প্রতিটা ভাষা, তাদের নিজস্বতা, জীবনবোধ এবং সামাজিক প্রতিক্রিয়া আলাদা আলাদা। উত্তর-আধুনিকতা বিশেষ কোনো অবস্থান থেকে এগুলোকে না দেখে প্রত্যেকটাকে মূল্যবান মনে করে। বলাই বাহুল্য, আমাদের ভাষাকে কেন্দ্র করে বিশ্বের জন্য যে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা উদযাপনের আয়োজন, সেটা ভাষারই উত্তর-আধুনিকতার প্রেক্ষাপট। কারণ ভাষার পরিধি ও ব্যবহার যত ছোটই হোক না কেন, তার গুরুত্ব ভাষা ব্যবহারকারীদের কাছে অপরিসীম। এর ওপর সমধিক গুরুত্ব দিয়েই ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একটি বিশেষ দিনকে ধার্য করেছে। এটি বেশ একটা আশার দিক।
খুব সঙ্গত কারণেই উত্তর-আধুনিক প্রেক্ষাপট থেকে নতুন আরেক বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে সোশ্যাল কন্সট্রাকটিভিজম বা সামাজিক গঠনবাদ। সত্য এবং মূল্য সমাজ বাস্তবতা থেকে নির্মিত হয়, কোনো সুনির্দিষ্ট আদর্শ তার সামনে নেই। যত সমাজ তত মূল্যবোধ, আর যত মূল্যবোধ তত সত্যের রূপ। তাহলে চূড়ান্ত সত্য বলে কী আছে? গেওরগি প্লেখানভের একটা উক্তি খুবই প্রাসঙ্গিকভাবে মনে পড়ছে, “We know today that there is no such thing as absolute truth, that everything is relative, that everything is dependent on the conditions of time and place; but precisely for that reason, we should be very cautious in judging the “ignorance” of various historical periods. Their ignorance, to the extent that it is manifested in their characteristic social movements, aspirations and ideals, is also relative.” বিনির্মাণ উত্তর-আধুনিকতার প্রাণ। বিনির্মাণের ভেতর দিয়ে নির্মাণ হয় নতুন এক মনভঙ্গি, নতুন জীবনবোধ বা টেক্সট। বোধ থেকে বোধান্তরের নির্মীয়মান ভাষ্য যেন জীবনেরই চিত্র। ফরাসি দার্শনিক জ্যাক দেরিদা এই বিনির্মাণতত্ত্বের উপস্থাপক। জ্যাক দেরিদা বিশেষজ্ঞ তপোধীর ভট্টাচার্য লিখছেন, “দেরিদার বিনির্মাণপন্থা আসলে সমস্ত বাচনিক, প্রতীতিগত (ধারণা সম্বন্ধীয়), মনস্তাত্ত্বিক, নান্দনিক, ঐতিহাসিক, নৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও পাঠকৃতি বিষয়ক দৃশ্য-প্রপঞ্চ-পরিস্থিতিকে আমূল আলোড়িত-রূপান্তরিত-পুনঃস্থাপিত করার কৃতকৌশল”। (জ্যাক দেরিদা, তাঁর বিনির্মাণ, পৃ. ১১২)। দেরিদার কথা হচ্ছে, প্রতিটি পাঠ এক একটা নতুন টেক্সট তৈরি করে। আর সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়ে পূর্বের পাঠ। পথের পাঁচালী দশ বছর আগে পাঠকের মনের ওপর যে ছাপ ফেলেছিল, এখন পড়লে তা অন্যরকম হবে। আলবেয়ার কামুর আউটসাইডার পড়ে যে উপলব্ধি হয়েছিল ছাত্রাবস্থায়, এখন নিশ্চিতভাবে তার পাঠ যাবে উল্টে। আর এর সঙ্গে সঙ্গে লেখকের মৃত্যু ঘটে! নতুন পাঠের মধ্য দিয়ে লেখকের এই মৃত্যু অতি সাধারণ এক ঘটনা। এটি মাথায় রেখেই ১৯৬৭ সালে ফরাসি দার্শনিক রোলা বার্থ লিখেছিলেন, “দ্য ডেথ অব দ্য অথর”। লেখকের এই মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একটা কর্তৃত্ববাদের অবসান ঘটেছে, সঙ্গে সঙ্গে পাঠকের মনে ভিন্ন ভিন্ন ছাপ আঁকা হয়েছে। দেরিদা এ কারণেই লেখক-পাঠকের মাঝে অবশ্যম্ভাবী একটি জায়গা সৃষ্টি হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। সেটি হলো পাঠ বা টেক্সট।
Advertisement
উত্তর-আধুনিক চিন্তা কি আমাদের একটি নৈরাশ্যবাদের দিকে নিয়ে ঠেকিয়েছে? অনেকেই মনে করেন, বিশেষ করে ইতালিয়ান দার্শনিক ভ্যাটিমস দেখিয়েছেন ইতিহাসের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। পশ্চিমাদেশ ইতিহাসের শেষ কিনারায় গিয়ে পৌঁছেছে। টয়েনবি, বুরডিল্যাড, মিল মনে করেন উত্তর-আধুনিকতা মানেই এক ধরনের শূন্যবাদ। এই অভিযোগের খুব বেশি উত্তর পাওয়া যায় না উত্তর-আধুনিকতাবাদে। তবে শূন্যবাদ জীবনের যে বিপুল নৈরাশ্যের ইঙ্গিত দেয়, উত্তর-আধুনিকতায় কিন্তু এই নৈরাশ্যের জায়গা নেই বরং এখানে আছে জীবনের ঘনিষ্ঠতা; আছে স্বাধীনতা, আছে মুক্তি।
পরিশেষে একটি কথা উল্লেখ না করলে অসম্পূর্ণ থাকবে; সেটি হচ্ছে উত্তর-আধুনিকতা সময়ের হাত ধরে এক অবধারিত জীবন-ব্যাখ্যার কাছাকাছি নিয়ে গেছে আমাদের। এমিলি ডিকেন্সনের একটি কবিতা দিয়ে শেষ করি:“Faith” is a fine inventionWhen gentleman can see—But Microscopes are prudentIn an Emergency.
এসইউ/জিকেএস