সাহিত্য

যে কোনো পুরস্কার আনন্দ-প্রাণসঞ্চারি: সেলিনা শেলী

সেলিনা শেলী কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। তার জন্ম ১৯৬৭ সালের ১৭ জুলাই। মূলত কবি হলেও লিখেছেন কবিতাবিষয়ক একাধিক গদ্যের বই। তার কবিতায় সমকালীন রাজনৈতিক চেতনার সঙ্গে পুরাণকে একীভূত করে নতুনতর চেতনার উদ্বোধনে চিত্রকল্প ও উপমার ক্ষেত্রে দূরাগত বংশীবাদকের সুরের মতো তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। তার কবিতা মূলত মানবচিন্তার ভরকেন্দ্রে, হৃদয়ের অলিন্দে আলোড়ন-সম্ভব শিল্পিত উচ্চারণ। সেলিনা শেলী কবিতায় কেবল হৃদয়াবেগের স্রোতে ভেসে যেতে চাননি, হতে চাননি বাক্চাতুর্যপূর্ণ কবিতার বুদ্ধিবৃত্তিক রূপকারও। কারণ কবি বুদ্ধির সৌকর্যের চেয়ে প্রজ্ঞার অনুশাসনকেই বেশি সমীহ করেন। চাতুর্যের অহমিকার চেয়ে সততার নির্বুদ্ধিতাকেই শ্রেয় মনে হয় তার।

Advertisement

তার উল্লেখযোগ্য কবিতার বই হলো—‘অন্ধকার হে অন্তর্গত’, ‘নিভে আসে সূর্যসকাল’, ‘চিতাচৈতন্যের গান’, ‘দ্বিধাসংহিতা’, ‘তাচ্ছিল্যকুসুম’, ‘ছেঁড়া জিভের দাস্তান’। গদ্যের বই—‘কতিপয় কবিতার কথা’, ‘সেদিন কী দিন ছিল এদিন কী দিন’, ‘কবিতার ব্যঞ্জন ও ব্যঞ্জনা’, ‘কবে থেকে ট্রেনে ওঠে বাংলা কবিতা’। সম্প্রতি তিনি কাব্যসাহিত্যে ‘চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেছেন। তার পুরস্কারপ্রাপ্তি ও লেখালেখি সম্পর্কে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কথাশিল্পী ও সাংবাদিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—

জাগো নিউজ: জীবনের দীর্ঘ সময় পেরিয়ে এলেন। এই দীর্ঘ সময়ে কবিতাচর্চায় নিবিষ্ট চিত্তে নিয়োজিত ছিলেন। আর কবিতার জন্য পেলেন চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার। কেমন লাগছে?সেলিনা শেলী: ধন্যবাদ আপনাকে এবং চিন্তাসূত্রকে। কবি নিশ্চয়ই পুরস্কারের জন্য লেখেন না। কিন্তু পুরস্কার একজন সৃজনশীল ব্যক্তির জন্য প্রণোদনা জাগায়। ইতোপূর্বেও আমি আরও বেশ কিছু সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছি। এর মধ্যে কাব্যসাহিত্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ২১শে পদক, কবি ওহীদুল আলম পদক, আন্তর্জাতিক কবিসমাবেশ পদক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তবে যে কোনো পুরস্কার আনন্দ-প্রাণসঞ্চারি। সেক্ষেত্রে চিন্তাসূত্রর মতো গুরুত্বপূর্ণ গভীর মননশীল একটি সাহিত্যধারার পুরস্কার আমার জন্য একটু ভিন্নমাত্রায় উঠে আসে। কারণ চিন্তাসূত্র চির তরুণদের সাহিত্যপত্রিকা। এখানে লিটল ম্যাগের মতো প্রতিষ্ঠিতের পাশাপাশি বিরল, প্রান্তিক, প্ল্যাটফর্মের বাইরের প্রতিভাকে খুঁজে এনে তাদের লেখার পরিচর্যা করা হয়। নতুন স্বরকে চিহ্নায়নে পত্রিকাটির ভূমিকা আমি শুরু থেকে দেখে এসেছি। পাশাপাশি প্রবীণের নবীন সুর- সুরভিও তারা ধরতে পারেন। আজ শিল্পসাহিত্যের প্রযত্নকারী এই পত্রিকা আমাকে সম্মানিত করেছে—আমি সত্যিই আপ্লুত।

জাগো নিউজ: আপনার কবিতা প্রসঙ্গে জানতে চাইবো। তবে, তার আগে আপনার কবি হয়ে ওঠা নিয়ে যদি কিছু বলতেন। কবিতাকে সিরিয়াসলি নিলেন কবে থেকে?সেলিনা শেলী: আমি লিখছি সেই ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণি থেকে, অর্থাৎ পত্রিকায় ছোটদের পাতায়। আশির দশকের গোড়া থেকে আমরা চট্টগ্রামের একঝাঁক তরুণ একসাথে সাহিত্যের আড্ডা, লেখালেখি, পাঠ, অনুষ্ঠান—এসব করে এসেছি। তাঁদের অনেকেই আজ বাংলা ভাষার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কবি-লেখক। এমনকি জাতীয় পদকপ্রাপ্ত। কলেজ জীবন থেকেই আমি প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতি, অভিনয়, আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে যুক্ত ছিলাম। সেইসময় থেকে জাতীয় দৈনিকগুলোয় লিখছি। কখনো নারীদের জন্য বরাদ্দ কোনো পাতায় কবিতা-গল্প লিখিনি। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে আজ অবধি লেখালেখিকে উপাসনার মতো আমার অস্তিত্বের অংশ করে নিয়েছি।

Advertisement

জাগো নিউজ: আপনার কবিতায় জীবনচিত্র পাওয়া যায়। এর পেছনে কী কী অনুষঙ্গ ভূমিকা পালন করেছে?সেলিনা শেলী: ওই যে বললাম—আমি আর দশজন নারীর জীবন কাটাইনি। ছাত্র রাজনীতিতে প্রথম সারির নেতা ছিলাম।চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসুর সাংস্কৃতিক সম্পাদক মনোনীত হয়েছিলাম। আমার প্রগতিশীল নেতৃত্বের জন্য জামাত-শিবির আমাকে তিনবার আহত রক্তাক্ত করেছিল। আমি সারাদেশে মঞ্চনাটক নিয়ে কাজ করেছি। লিটলম্যাগ করেছি। সবচেয়ে বড় কথা বাবার বাড়ির বিশাল পাঠাগারে প্রচুর পড়াশোনা করেছি। সব ধরনের মানুষের সাথে মিশেছি। রাজনীতি, অর্থনীতি দর্শন, ইতিহাস, নৃতত্ত্ব ইত্যাকার তাবৎ বিষয়ে পড়াশোনা করতে শিখিয়েছিলো—আমাদের আশির দশকের রাজনীতি, যা এখনও আমাকে আলো দিচ্ছে।

জাগো নিউজ: প্রেমকে আপনি কীভাবে দেখেন? মানুষে মানুষে যে প্রেম, নর-নারীর যে প্রেম—এ প্রশ্ন এ কারণে যে, আপনার কবিতায় প্রেমের যে বিচিত্র রূপ, তা থেকে এটিকে ঠিক নিরূপণ করা মুশকিল। কোথাও দ্ব্যর্থতাপূর্ণ, কোথাও অবদমিত, কোথাও ধোঁয়াশাময়। সেলিনা শেলী: প্রেম তো বহুরৈখিক। এর রকম আর তল পাওয়া মুশকিল! আমি যখন কোনো প্রেমের কবিতা লিখি—সেটা একেবারেই আমার নিজস্ব ভাববার কোনো কারণ নেই। একজন কবি অতিস্পর্শিক অনুভূতি সম্পন্ন বলেই তিনি আশেপাশের অনেকের প্রেমকে নিজের কবিতায় রাঙান। আবার একজন মানুষের প্রেমও নানা বয়স, সময়, প্রেক্ষিতে নানারকম হতেই পারে। কাজেই আমার কবিতায় নানামাত্রিক প্রেম থাকাটা স্বাভাবিক। তবে বিশুদ্ধ প্রেমের কবিতার চেয়ে বৈশ্বিক সমাজ, রাজনীতি, মৌলবাদ বা অন্যান্য বিষয়ে লেখা আমার কবিতার সংখ্যা কম নয়, বরং বেশি।

জাগো নিউজ: বাংলা কবিতার তিরিশ পরবর্তী কোন কোন কবি আপনাকে বিশেষভাবে টানেন এবং এদের কারও দ্বারা আপনার লেখা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছে কি না?সেলিনা শেলী: জীবনানন্দ দাশ আর শঙ্খ ঘোষ আমার খুব পছন্দের কবি। আর কারো দ্বারা প্রভাবিত কি না, তা তো পাঠক বলবেন—আমি মনে করি না।

জাগো নিউজ: আপনি একবার বলেছিলেন, কবিকে নিরন্তর প্রচেষ্টায় যেমন হয়ে উঠতে হয়, পাঠকেরও তেমনি হয়ে ওঠার দায় আছে। পাঠককূল নির্দিষ্ট কবির সৃষ্টি অনুধাবনের উপযোগী হয়ে উঠবেন, নাকি কবি বৃহত্তর পাঠকের রুচি বুঝে লিখবেন। আপনি কী করেন? সেলিনা শেলী: কবি কেন বৃহত্তর পাঠকের রুচি বুঝে লিখবেন? প্রকৃত কবি তো অগ্রচিন্তক। ত্রিকালদর্শী। ইনসাইটফুল, ভিশনারি! তিনি তার মতো লিখবেন। পাঠককেই এগিয়ে আসতে হবে। নিজেকে পাঠের মধ্য দিয়েই পাঠক আরও অগ্রসর করবেন। মধুকবি তাঁর পঞ্চাশ বছর পরের সাহিত্যিক চেতনা নিয়ে লিখেছিলেন, জীবনানন্দের জীবৎকালে ৫-৬টি কবিতা মাত্র প্রকাশিত হয়েছিল—এরকম ভুরি ভুরি উদাহরণ টানা যায়—যাঁরা সমকালে দুর্বোধ্য ছিলেন! পরে পাঠক কবির বোধের দিকে এগিয়ে গেছেন। কবি যদি বৃহত্তর পাঠকের রুচির চর্চাই করেন, তো কবিতা বৃত্তায়িত হয়ে পড়বে, অগ্রসর হবে না।আমি মনে করি, সব ক্ষেত্রেই কবিকে ‘একলা চলোরে’ নীতিতে থাকতে হয়। আড্ডা, পড়াশোনা, অনুষ্ঠান সব করে তিনি যখন তার নিভৃত কলমটি নিয়ে বসেন, তখন তিনি একা, শুধু নিজেকে তৃপ্ত করার জন্যই লেখেন।

Advertisement

জাগো নিউজ: বাংলা সাহিত্যের একাডেমিক পড়াশোনা আপনার কাব্যসত্তায় কীভাবে প্রভাব ফেলেছে? কিংবা পরবর্তী সময়ে বাংলা সাহিত্যকে যেভাবে অভিজ্ঞতায় নিয়েছেন, সে ব্যাপারে জানতে চাই। সেলিনা শেলী: সত্যি যদি বলি—একাডেমিক পড়ালেখা কেবল একটি সনদ দেওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ করেনি।আমাদের শিক্ষক, শিক্ষাব্যবস্থা, সিলেবাস—এসব তেমন কাজে লাগেনি। এ ছাড়াও ছাত্র রাজনীতি, নাটক—এসবের কারণে নিয়মিত ক্লাসও করিনি। কিন্তু নিজস্ব বিভিন্ন পাঠ আমাকে ভালো ফলাফল করতে সহযোগিতা করেছে। মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছি পুলিশ পাহারায়। কেননা শিবির আমার ব্যাকবোন হকিস্টিক দিয়ে মেরে ফ্র্যাক্সার করে দিয়েছিল। আমাদের মেয়র (তখন আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক) এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী এবং আবদুল মান্নান স্যার (পরবর্তী ভিসি) আমাকে তিন মাস ফ্রি ক্লিনিক্যাল চিকিৎসা দিয়েছিলেন। আমি ভর্তি হই—পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে। সাংস্কৃতিক কাজ আর পাশের সুবিধার জন্য বাংলা সাহিত্যে চলে আসি।

জাগো নিউজ: বাংলা কবিতায় ইংরেজি অনুবাদ নিশ্চয়ই জরুরি। এ নিয়ে কেমন কাজ হচ্ছে বলে মনে করেন? সেলিনা শেলী: অনুবাদে মূল সুর, স্বাদ হারিয়ে যায়। তবু অনুবাদের তো কোনো বিকল্প নেই। এখন তো প্রচুর ইংরেজি অনুবাদ হচ্ছে। হওয়াটা জরুরি। এর বাইরেও বহু ভাষার কবিতা ইংরেজিতে বা বাংলায় অনূদিত হচ্ছে। বিশ্বসভায় যোগ দিতে এর বিকল্প নেই। আমার বেশ কিছু কবিতা ইংরেজিতে অনূদিত হয়েছে। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, শিক্ষক সমিতির সভাপতি বিখ্যাত সাহিত্যিক সফিকুননবী সামাদী তার হিন্দি অনুবাদের ভারত থেকে একটি কাব্যসংকলন করেছেন। সেখানে তিনি আমার একটি কবিতাও হিন্দিতে অনুবাদ করেছেন।

জাগো নিউজ: কবিতার আবৃত্তি কবিতাকে ম্লান করে বলে মনে করেন?সেলিনা শেলী: অনেকটাই। সম্প্রতি আমি এ বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখে শেষ করেছি। এখনো কম্পোজ করতে পারিনি। সেখানে আমি বলার চেষ্টা করেছি—যেসব কবিতা আবৃত্তিশিল্পীরা নির্বাচন করেন—তা প্রায়শ আখ্যান বা ডায়লগধর্মী, আজকের দিনের বাঁক বদলের কবিরা আর বিষয় লেখেন না, ভাবনার বহুস্তর রূপায়ন করেন। সেখানে বিশেষ কল্পনাশ্রয়ী দৃশ্যকল্প না থেকে কল্পদৃশ্য থাকে। সেই ক্যামোফ্লাজ, রূপকআশ্রিত আপাতআখ্যানহীন কবিতা কেবলি নিবিড় পাঠের, মঞ্চে আবৃত্তির নয়। বাচিকশিল্পীরা এই কবিতা বাছাই করেন না। কেননা এগুলো কানের ভেতর প্রবেশ করলেও মরমে প্রবেশ করে না। তাহলে আবৃত্তিশিল্পীরা কি একটি কালখণ্ডের পর নতুন কবিতা আর গ্রহণ করবেন না? তবে সাধারণ্যে কবিতাকে জনপ্রিয় করতে আবৃত্তি প্রয়োজন, একেবারে বাদ দেওয়া যায় না।

জাগো নিউজ: অনুজ কবিদের কাছে আপনার প্রত্যাশা কী? সেলিনা শেলী: এ বিষয়েও লিখেছি বহুবার। তাদের পড়তে হবে। সমকালের শুধু নয়, পূর্বজদের কাব্যসাহিত্যও। সেইসাথে দেশ-কাল-রাজনীতি, ধর্ম, ইতিহাস, অর্থনীতি, দর্শন—সবই তার পাঠ করতে হবে। বিশ্ব সাহিত্যের বিষয়-আশয়ে পাঠানুরাগী হতে হবে। আমাদের সময়ে তো নেট ছিল না। অনেক কষ্টে বইপত্র সংগ্রহ করে, ধার করে পড়তাম আমরা। বহু বছরে ইতস্তত করে একটা বই করতাম। এখন তো ৪০-৪৮টা কবিতা লিখেই কবির আর তর সয় না। তবে এখনকার কোনো কোনো তরুণ বেশ ভালো লিখছেন। আমি তরুণদের সঙ্গ ভালোবাসি। তাদের সাহিত্য পাঠ করি। অনবরত নিজেকে অতিক্রম করতে চাই। তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎকারে আর কী বলবো? চিন্তাসূত্র পরিবারকে আবারও ভালোবাসা জানাই। ধন্যবাদ আপনাকে।

এসইউ/এএসএম