পৌষের শীতের নরম বিকেল। লাল লেপের মধ্যে শীর্ণ দেহটাকে লুকিয়ে গান শুনছিলাম। লোপামুদ্রা মিত্রের কণ্ঠে, ‘কেউ বা খেল প্রচুর খেল কেউ পেলো না মোটে, ভাবছি নতুন শতাব্দিটার কপালে কী জোটে!’ হঠাৎ কক্ষে মেজ ভাইয়ের প্রবেশ। গান দ্রুত বন্ধ করে তার কথার দিকে মনোযোগ দিলাম। মেজ ভাই বললেন, ‘একটু বাইরে যা। ছয়টা ভাপা পিঠা আর ছয়টা চিতই পিঠা নিয়ে আয়।’ বলে আমার হাতে একশ টাকার একটি নোট দিলেন।
Advertisement
মেজ ভাই, তার তিন ছাত্র, মমিন ভাই এবং আমি। এই হলো ছয়জন। বুঝলাম যে, শীতের বিকেলে ছাত্রাপ্যায়ন হবে পিঠা দিয়ে। দ্রুত অলস দেহটাকে বিছানা থেকে ওঠালাম। টাকা ও মুঠোফোন পকেটে নিলাম। মুখে মাস্ক পরলাম। বের হওয়ার সময় মেজ ভাই বলে দিলেন, ‘পাঁচটা বাজার আগে আসিস কিন্তু।’আমি বাসা থেকে বের হতে হতে বললাম, ‘আগে দেখি পিঠাওয়ালা এসেছে কি না!’
বাসা থেকে বের হয়ে বামদিকে মাত্র পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড হাঁটলেই পিঠার দোকান। দশতলা বিল্ডিংয়ের সামনে, দশ নম্বর রোডের বামপাশের মোড়ে সপ্তাহে ছয় দিন বসে এ পিঠার দোকান। এর আগেও বহুবার এখান থেকে পিঠা কিনেছি। তাই পিঠা বিক্রেতারা আমার সামান্য চেনাজানা।
স্বামী-স্ত্রী ও এক ছেলে মিলে পিঠা বিক্রি করেন। একদিন জেনেছিলাম তাদের বাড়ি হবিগঞ্জ। ফলে তাদের অর্ধেক কথাই আমার বুঝতে দারুণ অসুবিধা হয়। স্বামীর বয়স নিশ্চিত পঞ্চাশের ধারে কাছে ঘুরঘুর করছে। স্ত্রীর বয়স তার তুলনায় তোরো-চৌদ্দ বছরের ছোট হতে পারে। ছেলেটির বয়স বাইশ-তেইশের মতো। স্বামীর মাথার মধ্যভাগে টাক। কালচে গালে অগোছালো যথেষ্ট দাঁড়ি। লোকটি লম্বা-খাটোর মাঝামাঝি। মোটাও না আবার আমার মতো শুকনোও নয়। একদম উত্তম পন্থা। স্ত্রীর মুখ সর্বদাই পানে ভর্তি থাকে। বেশ পানাসক্ত। দেখলে মনে হয়, যেন তার মুখের মধ্যে টিউমার আছে। হাসলে উপরের মাড়ি সম্পূর্ণ উন্মুক্ত হয়। কোদাল আকৃতির খয়েরি বিশ্রী দাঁত। চেহারার রং অনুজ্জ্বল। মেঘ করেছে। ফেস কাট আহামরি কিছু নয়। বাকি রইল ছেলেটি। সে বেশ জোয়ান। গতরে গোশতের ঘাটতি নেই। দেখতে সুদর্শন পুরুষ বলেই মনে হয়। এ তিনজনের মধ্যে একটি বিষয়ে চমৎকার মিল। পোশাকে! প্রত্যেকের পোশাকে গৌরবময় মলিন ভাব স্পষ্ট।
Advertisement
অন্যদিন পৌঁছতে পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড লাগলেও আজ আমি অর্ধমিনিটের মধ্যেই হাজির। পা চালিয়েছি দ্রুত। কারণ মেজ ভাই বলে দিয়েছেন পাঁচটার আগে যেতে। হাতে সময় ত্রিশ মিনিট। যথেষ্ট সময় মনে হলেও তেমন কিন্তু নয়। গিয়ে দেখি লোকটি জিনিসপত্র কেবল সাজাচ্ছেন। অল্প কিছুক্ষণ আগেই বোধহয় এসেছেন। আপাতত তাকে একাই দেখছি। বুঝতে পারলাম, মাঠ নিয়ন্ত্রণে নিতে আগে প্রতিনিধি পাঠানো হয়েছে। স্ত্রী-পুত্র আসবেন আরেকটু পরে। পিঠার দোকানে সচরাচর প্রচুর ভিড় থাকে। তাই লোকজন আসার আগে প্রথম অর্ডারটা করে রাখলাম। অর্ডারের উত্তরে লোকটি যা বললেন তাতে বুঝলাম, আমাকে বেশকিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। অনির্দিষ্ট অপেক্ষা আমার কাছে ভালো লাগে না। তাই নির্দিষ্ট করে জানতে চাইলাম, ‘কত মিনিট লাগতে পারে?’উত্তর এলো, ‘পঁচিশ-ত্রিশ মিনিট।’উমম, একদম কানের গোড়া দিয়ে গেল। তবুও তাকে বললাম, ‘সমস্যা নাই, ঠিক আছে।’
লোকটি আর কিছু না বলে প্রস্তুতির কাজগুলো করতে লাগলেন। চুলোয় আগুন ধরানো শেষ করে দোকানের চারপাশে অবহেলিত ধুলোয় পানি ছিটিয়ে দিলেন। আর কিছু টুকটাক কাজ করলেন। এরই মধ্যে তার রাজ্যের একমাত্র রানি উপস্থিত। সাথে রাজপুত্র আসেনি। তার বোধহয় আরও দেরি হবে। তার স্ত্রী এসে প্রথমেই মাটির সাজগুলো চুলোয় বসিয়ে দেন। মাটির চুলো ছিল মোট পাঁচটি। চারটিতে চিতই পিঠা আর বাকিটাতে ভাপা পিঠা তৈরি করা হয়। ভাপা পিঠার এক খোলায় তারা পাঁচটি করে পিঠা তৈরি করেন। ভাপা পিঠা তৈরি করা কিছুটা সময়সাপেক্ষ এবং চিতই অপেক্ষা জটিল। উপকরণও দরকার বেশি। গুড়, নারিকেল, চালের গুড়া, মশারির টুকরা আরও কত কী! চিতই পিঠা তুলনামূলক সহজ কৌশলে তৈরি হয়। চালের গুঁড়া পরিমাণমতো পানির সাথে মিশিয়ে আগুনে রাখা মাটির সাচে ছেড়ে দাও। দুই মিনিট ঢেকে রাখো আর খাও। কত সহজ! যত সহজ বলছি আবার ততটাও নয়। বানালে টের পাওয়া যাবে।
অন্যদিনের তুলনায় আজ বাতাসের বেগ প্রচণ্ড। তাড়াহুড়োর কারণে শীতের পোশাক পরতে খেয়াল ছিল না। বেখেয়ালি হওয়ার ফল এখন টের পাচ্ছি। বলতে গেলে বাতাস আমাকে কাবু করে দিচ্ছে। বাতাসের যন্ত্রণায় আগুনও ঠিকভাবে পাত্রের গায়ে তাপ দিতে পারছিল না। শীতের কবল থেকে আত্মরক্ষার্থে বুকের কাছে দু’হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে রইলাম। আচমকা দেখি, একটি মেয়ে দু’হাত ভর্তি পোশাক নিয়ে পিঠার দোকানের দিকে এগিয়ে এলো। ডানহাতে থাকা জ্যাকেটটি দিল পিঠা বিক্রি করা লোকটির হাতে আর বামহাতের আদরে থাকা চাদরটা দিলো মহিলার কাছে। ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বুঝতে অসুবিধে হলো না যে, মেয়েটি তাদের কষ্টার্জিত রত্ন। আগে কোনদিন এখানে মেয়েটিকে দেখিনি। তাই কৌতূহলী হয়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে নিখুঁতভাবে দেখতে লাগলাম মেয়েটিকে।
আহ! যেন গোবরে পদ্মফুল। গায়ের রং উজ্জ্বল। ওষ্ঠাধরে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। চেহারার নিচের অংশ উপরের অংশের চেয়ে বেশ খানিকটা চাপা, ওর মায়ের মতো। নাক বেশ চোখা। যা অনায়াসে যে কারো দিল ফুটো করে দিতে পারে। আমার মতো নরম দিল হবে সবার আগে। চোখের কালো কোটরে কঠিন সৌন্দর্য। মাঝারি আকৃতির কপাল। চুলগুলো সিল্কি, আমার মতো। মেয়েটার বয়স বারো-তেরোর বেশি নয়। সমস্ত দেহে নব কিশোরী ভাব। উচ্চতায় সাড়ে চার ফুট ছাড়িয়েছে নিশ্চিত। থ্রি-পিসে দেহাবৃত। সাদা পায়জামা। জামার রং কালোর মধ্যে সাদা। কালোর অংশ বেশি। ওড়না হলো গাঢ় নেভি ব্লু। সাদা, কালো, হলুদ আমার পছন্দ তা কে না জানে! আচ্ছা, মেয়েটিও কি এ খবর জানে! না জানলে কালো-সাদা পোশাক কেন! তার কাছে কে দিলো এ খবর। ভেবে-চিন্তে উত্তর পাই না।
Advertisement
মেয়েটিকে আমি খুঁটেখুঁটে পর্যবেক্ষণে মগ্ন ছিলাম। একপর্যায়ে টের পেলাম, বাবা-মায়ের সাথে ওর মনোমালিন্য চলছে। মেয়েটির সে কী রাগ! বাপরে বাপ! আমার চেয়েও দেড়গুণ বেশি রাগী বলে মনে হচ্ছে। রাগে গোলাপি ওষ্ঠাধর কম্পমান। মায়াবী চোখে জল আসার উপক্রম। গত একবছরে আমার দেখা শ্রেষ্ঠ মুগ্ধকর দৃশ্য। যেন এমন সব চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করার জন্যই বেঁচে আছি। মেয়েটির অপ্সরার মতো চেহারা আমার মনে ধরবে, বিষয়টি অতি স্বাভাবিক। তবে রাগান্বিত ও ক্রন্দনরত মেয়েদের আমার আবার বেশি ভালো লাগে। মেয়েরা হাসলে যতটা সুন্দর লাগে, তার চেয়ে ঢের বেশি সুন্দর লাগে রাগলে। রাগে চোখ-মুখ লাল হবে, একটি গাঢ় গম্ভীর ভাব থাকবে। আহ! কী চমৎকার! মনে মনে বললাম-হাসলে তোমায় দারুণ লাগে, রাগলে লাগে আরও,তোমার রাগ যে মেঘের চেয়ে আরও বেশি গাঢ়।
যদি রাগী অবস্থায় মেয়েদের চোখে জল থাকে, তবে সে সৌন্দর্য বর্ণনার ক্ষমতা আমার নেই। মনোমালিন্যের সমাপ্তি ঘটে সামান্য সময়ের ব্যবধানে। দশ টাকার একটি লাল নোট পেয়ে মেয়েটির মুখে গোলাপি হাসি ফুটে ওঠে। আর আমার জাগে আফসোস। আরও কিছুক্ষণ রাগী অবস্থায় থাকলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হতো শুনি! এর দ্বারা আবারও প্রমাণিত হলো সুখ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অন্তত আমার কপালে না। দশ টাকা পেয়ে মেয়েটি চলে গেল। চলে যাওয়ার সাথে সাথেই থেমে গেল শীতল বাতাস। মেয়েটির সাথে শীতল বাতাসের কোন যোগসূত্র আছে কি না, বুঝতে পারলাম না। মেয়েটি আসার আগে বাতাসের তীব্রতা কি তবে তার আগমনী বার্তা ছিল! তা-ও বুঝতে পারলাম না ঠিক।
অসীম আফসোসের সীমাহীন পাহাড় নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিক বাদে আমার পিঠা প্রস্তুত হলো। পাওনা শোধ করে বাসায় ফিরলাম। বেঁধে দেওয়া সময় থেকে সাত মিনিট দেরি হলো। যদিও তাতে আমার কিছু যায়-আসে না। মেয়েটি সেখানে থাকলে আমি আরও সাত ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে রাজি ছিলাম। সৌন্দর্য উপভোগ করার সুযোগ সর্বদা আসে না। পিঠা তো মেজ ভাই তার ছাত্রদের অন্যদিনও খাওয়াতেন পারবেন। কিন্তু মেয়েটিকে কি রোজ দেখতে পারব! আফসোস! জীবনটাই আফসোস।
সবার সাথে পিঠা খেলাম ঠিকই, তবু মন পড়ে রইল রাগে কম্পমান গোলাপি ওষ্ঠাধরের গোপন ভাঁজে। ইস! ওর নামটাও জানা হলো না। জানা থাকলে ওর নামে অন্তত একখানা কবিতা আওড়াতে পারতাম। কী দুর্ভাগ্য আমার। এখন থেকে রোজ শীতের বিকেলে এই সময়ে নিয়ম করে একবার যাব। যদি ওর দেখা পাই ফের, তবে চুপিচুপি নামটা জেনে নেবো।
এসইউ/জিকেএস