সাহিত্য

মৃত্যু ভাবনায় রবীন্দ্রনাথ: পর্ব-০২

আগেই উল্লেখ করেছি মৃত্যু নিয়ে কবির ভাবনা বেশ খানিকটা দ্বান্দ্বিকতার সমন্বয়ের ভেতর দিয়ে অগ্রসরমান। কোনো কোনো সময় তাঁর মনে হয়েছে জন্ম আর মৃত্যু যেন একই সুতায় বাঁধা একটা অখণ্ড মালা। আবার মৃত্যুকে মনে হয়েছে অতি আগ্রাসী, নিচু ও সর্বগ্রাসী এবং একমুখী অন্ধকার পথ; অচেনা না-ফেরা এক ভয়াল অভিজ্ঞতা। ‘নৈবেদ্য’তে পরপর ‘জন্ম’ ও ‘মৃত্য’ নামে দুটো কবিতা এর সাক্ষ্য দেয়। যে বিপুল সুরধ্বনি এ বিশ্বজগতকে পরিপ্লাবিত করে চলেছে সেই অদেখা বিশ্বস্রোতে মহারণ্যে ফোটা ফুলের মতন আমাদের জন্ম। জীবনের সিংহদ্বার দিয়ে যখন আমরা প্রবেশ করি; তখন সব ছিল অজানা, সেই অজানা ক্ষণে পল্লবিত মুকুলের মত নিজেকে খুঁজে পেয়েছি অজ্ঞাত অপার রহস্যের মধ্যে। কিন্তু এর অপূর্ব জীবন-লীলার পেছনে রয়েছে রূপহীন জ্ঞানাতীত ভীষণ শক্তি। রূপহীন জ্ঞানতীত ভীষণ শকতিধরেছে আমার কাছে জননীমুরতি।।

Advertisement

এরপর ‘মৃত্যু’ কবিতায় উদ্বেগের সাথে মৃত্যুকে গ্রহণ করতে গিয়ে পরে তিনি একটা সান্ত্বনা খুঁজেছেন। এখানে তিনি মনে করছেন, মৃত্যু অজ্ঞাত, মৃত্যু শিহরণ জাগানো শ্বাসরুদ্ধকর এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। কিন্তু মৃত্যুকে ভালো না বেসে উপায় নেই। এত ভালোবাসি ব’লে হয়েছে প্রত্যয়,মৃত্যরে এমনি ভালো বাসিব নিশ্চয়।।

জন্ম-মৃত্যু এক অপূর্ব ভবচক্রের মধ্যে আবর্তিত। এখানে এক বড় সান্ত্বনা হচ্ছে—জন্ম হলে মৃত্যু হবে, আবার সেই মৃত্যুই জীবনতরীর স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে এক অজানা জীবনঘাটে, যেখান থেকে আবার শুরু হবে জন্মের এই হার না মানা যুদ্ধ। মহাভারত যেমনটি বলছে, জাতস্য হি ধ্রুবোমৃত্যু ধ্রুবং জন্ম মৃত্যুস্য চতন্মাদ পরিহার্যে হর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি জীবনের সিংহ দ্বার দিয়ে আমাদের প্রবেশ হয়তো অনেকটা অনাহূতের মতো। পরিচয়হীন আগন্তুকের মতো অতি সন্তর্পণে শুরু হয়েছিল এ যাত্রা, কোনো এক শক্তি এ বিপুল রহস্যের মাঝে আমাকে নিক্ষেপ করেছিল অর্ধরাতে মহা অরণ্যে মুকুলের মতো। ‘নৈবেদ্য’র ‘জন্ম’ কবিতায় কবি তাই লিখছেন, ‘যখনি নয়ন মেলি নিরখিনু ধরা/ কনককিরণ- গাঁথা নীলাম্বর–পরা, নিরখিনু সুখে দুখে খচিত সংসার—তখনি অজ্ঞাত এই রহস্য অপার’।

আগেই বলা হয়েছে, জগত সম্পর্কে কবির প্রাথমিক উপলব্ধি বেশ ছিল অনেকটা পরিষ্কার, কিন্তু ধীরে ধীরে সেই স্ফটিক ধারণার ওপর মেঘ জমতে থাকে। এক অস্পষ্টতা ঘিরে ধরে জগতের বিশালত্ব আর না-মেলা কিছু প্রশ্ন। তবে এটা ঠিক পরক্ষণেই তিনি ‘মৃত্যু’ কবিতায় এক ভিন্ন অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন, লিখছেন—মৃত্যু অজ্ঞাত, তার চিন্তায় শরীর শিহরিয়া ওঠে, ভয়ে বুক ওঠে কেঁপে, সংসার থেকে বিদায় নিতে চোখে জল আসে, চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে। দুই বাহু দিয়ে এ বিদায়কে রুখে দিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ জীবন সংসার তো ক্ষণিকের! শুধু অকারণ পুলকে ক্ষণিকের গান গাওয়া ছাড়া আর বুঝি কিছু নয়। তবে মৃত্যু যেন মৃত্যু নয়, মায়ের এক স্তন থেকে অন্য স্তনে শিশুকে স্থানান্তর করলে কিছুটা অস্বস্তিবোধ জন্মে, অনুভুত হয় সাময়িক বেদনা। কিন্তু ‘মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে’। সম্ভবত জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানের মুহূর্তটা এমনই অস্বস্তিকর। মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যেন এ কথাগুলো স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন, ‘অর্জুন, তুমি আমি সহস্র বছর ধরে জন্ম মৃত্যুর এই ধারাবাহিক শেকলের মাঝে আছি, পার্থক্য হোল, তুমি সেটা স্মরণ করতে পার না, আমি পারি।’

Advertisement

‘জন্ম ও মরণ’ কবিতায় কবির অনুভূতি আরেকটু ভিন্ন। শূন্য হাতে শুধু কান্না সম্বল করে আচমকা এক পথিকের অজানিত এক মহাশূন্যে নিক্ষিপ্ত হওয়ার মতো। হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা সেই পথিক ধীরে ধীরে স্থান করে নেয় নিজের, নব নব গীতে, নব উচ্ছ্বাসে নিজেকে বিস্তৃত করে চলে নতুন প্রেমের টানে। অর্থাৎ ‘প্রেম-আকর্ষণে/ যত গুঢ় মধু মোর অন্তরে বিলসে/ উঠিবে অক্ষয় হয়ে নব নব রসে,/ বাহিরে আসিবে ছুটি—অন্তহীন প্রাণে/ নিখিল জগতে তব প্রেমের আহ্বানে/ নব নব জীবনের গন্ধ যাবো রেখে/ নব নব বিকাশের বর্ণ যাবো এঁকে।’ কবির এহেন অনুভূতি অনেকটা অভিজ্ঞতাবাদী চিন্তাবিদের ন্যায়। মানুষের প্রথম আবির্ভাবে মনটা থাকে অলিখিত এক সাদা কাগজের মতো, দিনে দিনে সেখানে লেখা হয় নতুন অভিজ্ঞতার নানা রকম প্রয়াস। এখানে তিনি স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন মানুষের কর্তব্য তথা প্রয়োজনীয় কাজের কথা।

ব্যক্তিগত দুঃখ ও মৃত্যুর মিছিল ১৮৭৫ সালে ১৪ বছর বয়সে রবিঠাকুরের মাতৃবিয়োগ ঘটে। সেটাই ছিল প্রথম অতি আপনজনের বিদায়। এরপর ১৮৮৫ সালে তাঁর বৌদি কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করেন। কাদম্বরী দেবী ছিলেন কবির অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বন্ধু-বৌদি কাদম্বরীর হঠাৎ মৃত্যুতে রবীন্দ্র জীবনে নেমে আসে নিদারুণ এক দুঃখভার। এরপর একের পর এক আপনজনের বিদায় তাকে বিমর্ষ করেছে; মৃত্যু নিয়ে তিনি নতুন করে জীবনবোধে পৌঁছেছেন। স্ত্রী মৃণালিনী দেবী ১৯০২ সালে ৩০ বছর বয়সে মারা যান। এরপর ১৯০৩ সালের সেপ্টেম্বরে মাত্র ১৩ বছর বয়সে কন্যা রেনুকাকে হারান। এর ২ বছর পর তাঁর পিতৃবিয়োগ ঘটে। মৃত্যুর মিছিলের এই দুঃসহ শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ১৯০৭ সালে তাঁর ছোট ছেলে সমীন্দ্রনাথ কলেরায় আক্রান্ত হয়ে ১৩ বছর বয়সে কবিকে ছেড়ে চলে যান। এতো সব আপনজনের বিদায় রবীন্দ্রনাথকে শোকে শক্ত করে তোলে। দীর্ঘ ৮০ বছরের জীবনে তিনি হয়ে ওঠেন নিঃস্পৃহ, নির্লিপ্ত, ভাবলেশহীন, নীরব এক জীবন-ব্যাখ্যাকারক। তবে উল্লেখ করতে দ্বিধা নেই, তাঁর এ জীবন-চিত্র যেন কোনো এক শিল্পীর পটে আঁকা উদ্দেশ্যমূলক চিন্তার কাব্যিক প্রকাশ। জীবনস্মৃতির শুরুতে তাই তিনি লিখছেন, স্মৃতির পটে জীবনের ছবি কে আঁকিয়া যায় জানি না। কিন্তু যেই আঁকুক সে ছবিই আঁকে। অর্থাৎ যাহা-কিছু ঘটিতেছে, তাহার অবিকল নকল রাখিবার জন্য সে তুলি হাতে বসিয়া নাই। সে আপনার অভিরুচি-অনুসারে কত কী বাদ দেয়, কত কী রাখে। কত বড়োকে ছোটো করে, ছোটকে বড় করিয়া তোলে। সে আগের জিনিসকে পাছে ও পাছের জিনিসকে আগে সাজাইতে কিছুমাত্র দ্বিধা করে না। বস্তুত তাহার কাজই ছবি আঁকা, ইতিহাস লেখা নয়।রবিন্দ্রোক্তির এ প্রথম ভাষ্যানুসারে একটা কথা সহজেই অনুমান করা চলে, রবীন্দ্রদর্শনের মূল যে উপজীব্য যাকে তিনি জীবনদেবতা নামে আখ্যায়িত করছেন, তা অনেকটাই তাঁর ইচ্ছানিরপেক্ষ, অলঙ্ঘণীয় ও অমোচনীয় সত্তার আঁকা জীবন-পট। এখানে তাঁর নিজের ইচ্ছা সম্ভবত সেই পরমের ইচ্ছার সমাগত। বৌদি কাদম্বরী দেবী আত্মহত্যা করলে বৌদিকে নিয়ে লেখেন নষ্টনীড়। তখন সবে রবীন্দ্রনাথ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। এই পরিস্থিতি ও বেদনা থেকে কিছুটা প্রশমনের জন্য আসেন শিলাইদহে। ঠিক এসময় তিনি তাঁর ভাতুস্পুত্রী ইন্দিরা দেবীকে বন্ধু হিসেবে পান যাকে তিনি কয়েক বছরের মধ্যে আড়াই শতাধিক চিঠি লেখেন। চিঠিগুলো লেখা ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৫ সালের মধ্যে। চিঠিগুলো ছিন্নপত্র নামে পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়। ইন্দিরা দেবী ছিলেন অত্যন্ত বিদুষী নারী। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৮৯২ সালে প্রথম নারী হিসেবে বিএ পাস করেন অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে। পরে তিনি ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক থেকে ডিপ্লোমা করেন। ইন্দিরা দেবী ১৮৯৯ সালে সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরীকে বিবাহ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি বিশ্বভারতীর উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শিলাইদহ-শাহাজাদপুর-পতিশ্বরে অবস্থানকালে বাংলার জীবন, নদী, চর, সবুজে ঘেরা গ্রাম, আকাশ, প্রকৃতি, সাধারণ মানুষের জীবনবোধ ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় নিয়ে তিনি লিখেছিলেন চিঠিগুলোর মধ্যে। মূলত জমিদারীর উদ্দেশ্যে এখানে অবস্থানকালে অবসরের ফাঁকে তিনি এসব সাহিত্য রচনা করেন। তবে বলতেই হবে, যদিও তিনি ভূস্বামী হিসেবে কর্তব্য পালনের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। তবু বাংলার সহজ-সরল জীবনের সামগ্রিক জীবনবোধ উঠে এসেছে এখানে।

রবীন্দ্র ভাবনায় ব্যক্তিগত অর্থাৎ তাঁর নিজস্ব দুঃখ-অভিজ্ঞতা খুব বেশি স্থান পায়নি। পেলেও তিনি সেই দুঃখকে নৈর্ব্যক্তিক চিন্তার মোড়কে সর্বজনীন দর্শনে পরিণত করেছেন। মৃত্যু নিছক একটা অবস্থা, মৃত্যু একটা পরিবর্তন। দূর থেকে যতটা ভয়াল মনে হয়, যতটা নির্দয় মনে হয় আসলে মৃত্যু ততটা নয়। মৃত্যুকে জয় করলে কেমন মানসিক অবস্থা সৃষ্টি হয় তার দারুণ একটা চিত্র আমরা লক্ষ্য করি ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কবিতায়। দূর হতে ভেবেছিনু মনে–দুর্জয় নির্দয় তুমি, কাঁপে পৃথ্বী তোমার শাসনে তুমি বিভীষিকা,দুঃখীর বিদীর্ণ বক্ষে জ্বলে তব লেলিহান শিখা। তবে দুঃখের এ ভয়াল রূপের অবসান ঘটে মৃত্যুর নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকে। বলছেন, ‘শুধালেম ‘আরো কিছু আছে নাকি/ আছে বাকি/ শেষ বজ্রপাত?’/ নামিল আঘাত।। এই মাত্র? আর কিছু নয়? ভেঙে গেল ভয়।’ বাংলা ১৩৩৯ সালে লেখা এ কবিতায় কবি বলছেন, ‘আমি মৃত্যু-চেয়ে বড়ো’ এই কথা শেষ ব’লে/ যাব আমি চলে।’ ষোড়শ শতকের ইংরেজ কবির মধ্যে মৃত্যুর এই সুর প্রতিধ্বনিত হয়েছে Death Be Not Found কবিতায়— Death, be not proud, though some have called theeMighty and dreadful, for thou art not so;For those whom thou think’st thou dost overthrowDie not, poor Death, nor yet canst thou kill me.From rest and sleep, which but thy pictures be,

সম্ভবত রবীন্দ্রচিন্তার নির্যাস পাওয়া যায় তাঁর পত্রপুট কাব্যের ‘পৃথিবী’ কবিতায়। ১৯৩৫ সালে লেখা এ কবিতা বলতে গেলে রবীন্দ্রচিন্তার চরম দ্বন্দ্বের একটা উত্তম দৃষ্টান্ত। বস্তুবাদ ভাববাদের যে চিরাচরিত হার না মানা যুদ্ধ সেটার প্রকৃষ্ট উদাহারণ মেলে সঞ্চয়িতার প্রথম দিকের ‘সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়’ ও শেষের দিকের ‘পৃথিবী’ কবিতায়। কবিতা দুটোতে আপাত পারস্পারিক বৈপরীত্য প্রকাশ পেয়েছে, যাকে প্রকারন্তরে তাঁর চিন্তার সংশয়ী উত্তরণ হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে। বাংলা ১২৮৮ সালে ভারতী পত্রিকায় এ কবিতা প্রকাশিত হয়। অধুনা বিগ ব্যাং থিউরি নিয়ে বিজ্ঞানমহলে যে আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে তার প্রাথমিক সূত্র কেউ যদি এ কবিতার সাথে তুলনা করেন, তা কিন্তু বেমানান হবে না। তবে সৃষ্টির এক দারুণ অধিবিধ্যক রূপ কিন্তু কাব্যাকারে ধরা পড়েছে এখানে। সৃষ্টির প্রথম মুহূর্তে দেশ ও কালের যাত্রা। আদি বিস্ফোরণ থেকে ক্রমান্বয়ে প্রসারিত মহাবিশ্বের সাথে সাথে শব্দ, আলো, নিয়ম ও ছন্দ এক এক করে যে জাগতিক বন্ধন করে করেছে সে অবশ্যম্ভাবী লীলার অপূর্ব ছন্দ আমরা পাই এ কবিতায়। বলতে গেলে, সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে ‘এই কবিতাটাতে সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয়ের একটি কবিত্বময় সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। ইহাতে নানা দার্শনিক মতবাদ একত্র সন্নদ্ধ হইয়াছে।’ (চারু, ১০৬)।

Advertisement

চলবে...

এসইউ/এএসএম